শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

শাবান ১৪৩৯ হিঃ (৩/৪) | তোমাদের পাতা

ধারাবাহিক-৪

আ রা কা নে র ই তি হা স

বৃটিশ-বার্মা প্রথম যুদ্ধের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে কতিপয় সমরবিশেষজ্ঞ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, পরিস্থিতি অনুযায়ী বৃটিশপক্ষ অত্যন্ত উচ্চস্তরের যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেছিলো। শুরুতে তারা সর্বাত্মক অভিযানের নীতি গ্রহণ করেনি, বরং বর্মী বাহিনী-কে আগ্রাসী হামলায় প্ররোচিত করেছে, যাতে বিজয়ের নেশায় তারা বেশামাল হয়ে পড়ে এবং অরক্ষিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। বলাবাহুল্য, যুদ্ধে আনাড়ি বর্মী বাহিনী বৃটিশ-কৌশলের জালে সহজেই আটকা পড়ে গিয়েছিলো, যা থেকে শেষ পর্যন্ত আর বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

শুরুতেই বর্মী বাহিনী আসাম ও কাছাড়ে যথেষ্ট ভিতরে ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে ‘যুদ্ধ পরিচালনায় অতি অভিজ্ঞ’ বলে কথিত বর্মী সেনাপতি মহাবান্দুলা বিপুলসংখ্যক সৈন্য-সহ নাফনদী অতিক্রম করে রামুর কাছাকাছি চলে আসেন। বৃটিশ ক্যাপ্টেন মর্টন হাই কমান্ডের নির্দেশে ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর মাত্র তিনশ-জন সৈন্য নিয়ে মহাবান্দুলার গতিরোধ করার জন্য অগ্রসর হন। দশহাজার সৈন্যের বর্মী বাহিনীর মুকাবেলার জন্য তিনশ নেটিভ পদাতিক সৈন্য! মহাবান্দুলা যেমন বুঝতে পারেননি বৃটিশকৌশল তেমনি ক্যাপ্টেন মর্টনও ছিলেন বেখবর! তিনি শুধু হাই কমান্ডের নির্দেশ পালন করেছেন।

মর্টন নিহত হলেন। তার ক্ষুদ্রবাহিনী হলো কচুকাটা। যুদ্ধ তখনো বলতে গেলে শুরুই হয়নি, মহাবান্দুলাকে বর্মীরাজ জাতীয় বীর বলে ঘোষণা করে দিলেন! অন্তত যুদ্ধটা জমে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা! তাও না!!

এটা হলো মে মাসের মধ্যভাগের ঘটনা। অর্থাৎ মাত্র দু’মাস তখন যুদ্ধের বয়স!

এরই মধ্যে বৃটিশবাহিনী যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলো প্রায় ঝড়ের গতিতে। বর্মী বাহিনীকে হতভম্ব করে দিয়ে তারা রেঙ্গুন দখল করে নিলো। তখন বিধ্বস্ত বর্মী বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য সেনাপতি মহাবান্দুলা -কে আরকান ও রামু সেক্টর থেকে ডেকে পাঠানো হলো। তিনিও আস্পর্ধার চূড়ান্ত করে বর্মী রাজকুমার থারাওয়ার্দিকে বললেন, ‘আটদিনের মাথায় আমরা প্যাগোডায় বিজয়ের উৎসব ও কৃতজ্ঞতাপ্রার্থনা পালন করবো।’

মহাবান্দুলার পরিকল্পনা ছিলো বৃটিশবাহনীকে দক্ষিণে সাগরে নিয়ে ডুবিয়ে মারা। এ উদ্দেশ্যে তিনি ষাটহাজারের বিরাট পদাতিক বাহিনী এবং একটি বিধ্বংসী গোলন্দায ইউনিট সঙ্গে নিয়ে রেঙ্গুনের পথে অগ্রসর হলেন। তার সেনাবিন্যাস ছিলো অর্ধবৃত্ত আকারের এবং কেসেন্দাইন পাজুনগং নদী পর্যন্ত বিস্তৃত।

হঠাৎ করেই যুদ্ধপরিস্থিতির আরো নাটকীয় পরিবর্তন ঘটলো। মহাবান্দুলার পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগরে ডুবে মরার কোন আগ্রহ বৃটিশবাহিনীর মধ্যে দেখা গেলো না। ক্যালকাটা ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরিকল্পনা দেয়া হলো, স্যার আর্চিবল্ড ক্যাম্পবেল যেন তার বাহিনী নিয়ে রেঙ্গুনের যতটা সম্ভব কাছাকাছি মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। একান্ত যদি সরে আসতে হয়, গতি যেন হয় খুব ধীর।

এর মধ্যে ১৮২৫-এর জানুয়ারীতে জেনারেল মরিসনের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীকে আরাকান-ইয়ামো দুর্গম গিরিপথের মধ্য দিয়ে আরাকানের ভিতরে অভিযানে পাঠানো হয়। বৃটিশবাহিনীর হিসাবে ছিলো, আরাকানীরা, বিশেষত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বৃটিশবাহিনীকে স¦াগত জানাবে; অন্তত নিরপেক্ষ ও নির্লিপ্ত অবস্থানে থাকবে। বাস্তবেও তাই হলো, জেনারেল মরিশনের ক্ষুদ্র বাহিনী শাব্দিক অর্থেই বিনা বাধায় আরাকানের রাজধানী ¤্রােহং-এ পৌঁছে গেলো।

এভাবে বৃটিশ হাইকমান্ড ফোর্ট উইলিয়ামে বসেই ‘শ্যাম্পেন হাতে’ আরাকানের ভূখ-ে যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটালেন। বর্মী সেনাপতি তখন আরাকান থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনে কামান দাগিয়ে চলেছেন!

এই ছিলো বৃটিশদের যুদ্ধকৌশল, যার কাছে মহাবান্দুলাকে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। আসলেই বৃটিশ হাইকমাণ্ডের বিপক্ষে মহাবান্দুলা ছিলেন বিলকুল ‘বাচ্চা সেনাপতি’!

‘শ্যাম্পেন হাতে’ কথাটা যিনি লিখেছেন, রূপক অর্থে লিখেছেন। আসলেই বৃটিশ হাইকমান্ড এই যুদ্ধে বেশ ‘রিল্যাক্স’ মুডে ছিলো।

আরাকানঅভিযানে বৃটিশ স্থল বাহিনীর সহায়ক শক্তি ছিলো ছোট ছোট যুদ্ধজাহাযের ক্ষুদ্র একটি নৌবহর। তবে কার্যত ঐ নৌবহরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণই করতে হয়নি।

বর্ষা মৌসুমটা জেনারেল মরিশন মোটামুটি অলসভাবেই কাটালেন। বর্ষাশেষে পর্যাপ্ত যুদ্ধসরঞ্জাম ও তাজাদম সৈন্যের সরবরাহ এসে গেলো। আর জেনারেল মরিশন ঝড়ের বেগে সমগ্র আরাকান দখল করে নিলেন, ২৫-এর এপ্রীলের শুরুর দিকেই।

সেনাপতি মহাবান্দুলা আর তো কিছু করতে পারেননি, নিজেকে শুধু বোমাবিস্ফোরণে নিহত হওয়ার ‘সুযোগ’ করে দিয়েছেন।

যুদ্ধের জাল গুটিয়ে আনতে বৃটিশ হাইকমান্ড একটু গাছাড়া সময় নিয়েছিলো। কারণ ডিসেম্বরের মধ্যে পরাজয়ের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গেলেও বর্মী রাজ বায়জীদ পরাজয় স্বীকার করতে এবং বৃটিশদের শর্তমতে চুক্তি সই করতে তখনো প্রস্তুত ছিলেন না।

আসলে যুদ্ধের পরিস্থিতি বিচারে বৃটিশদের তাড়াহুড়া করারও কিছু ছিলো না।

১৮২৬-এর ফেব্রুয়ারী নাগাদ বর্মীরাজ পরাজয় স্বীকার করে নিতে ‘সদয় সম্মতি’ প্রদান করলেন। ২৪শে ফেব্রুয়ারী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো রেঙ্গুন থেকে ২৪ মাইল দূরে ইয়ান্দাবু শহরে। চুক্তির দফাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, বর্মীরাজ কতটা অসহায় অবস্থায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন! অথচ শুরুতে তিনি মানতেই প্রস্তুত ছিলেন না, তার সেনাপতি মহা নেমিউ প্রোমের যুুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন! ধারণা করা হয়, তখন যদি তিনি চুক্তিতে আসতেন, যথেষ্ট ছাড় পাওয়ার সুযোগ হতো।

চুক্তির প্রথম দফা অনুযায়ী বর্মীরাজাকে আরাকান ও টেনাসেরিম প্রদেশ ছেড়ে দিতে হবে। (চিন্তা করুন, আস্ত দু’টি প্রদেশ!)

দ্বিতীয় দফা মতে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ বৃটিশপক্ষ, বেশী না, একমিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং পাবে।

তৃতীয় দফা মতে আভাতে একজন বৃটিশ রেসিডেন্ট অবস্থান করবেন। এর বিপরীতে একজন বর্মীদূত কলকাতায় অবস্থানের সুযোগ পাবেন।

ৃবৃটিশ-বার্মা দ্বিতীয় যুদ্ধ

বর্মীরাজার কপালে দুর্ভোগের আরো কিছু বাকি ছিলো। হয়ত সে কারণেই তিনি চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের আত্মঘাতী কৌশল অবলম্বন করেন। ফলে ছাব্বিশ বছর পর ১৮৫২ সালে সীমিত আকারে সম্পূর্ণ একতরফা একটা যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়, যাতে সমৃদ্ধশালী পেগু প্রদেশটিও বার্মার হাতছাড়া হয়ে যায়। এর ফলে খণ্ডিত বার্মা স্থলবেষ্টিত দেশে পরিণত হয় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বেহাল অবস্থায় পতিত হয়।

১৮৮৫ সালে তৃতীয় যুদ্ধ শুরু করার জন্য বৃটিশবাহিনী অবশ্য কোন অজুহাত খুঁজতে যায়নি, প্রয়োজনও ছিলো না। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র বার্মা বৃটিশ সা¤্রাজ্যভুক্ত হয় এবং বার্মায় আগাগোড়া বৃটিশ প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপিত হয়। যথাÑ

১ Ñ বার্মা বৃটিশভারতের অধীন একটি প্রশাসনিক প্রদেশে পরিণত হয়।

২ Ñ বন্দরনগরী রেঙ্গুনকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়।

৩ Ñ নগরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ফলে বার্মার গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং সাধারণ মানুষ নগরমুখী হয়ে পড়ে।

এসময় বিভিন্ন স্তরের ভারতীয় লোকজন কোম্পানি সরকারের পৃষ্টপোষকতায় ব্যাপক হারে কর্মের সন্ধানে বার্মায় যাওয়া শুরু করে।

এর পিছনে দু’টি বড় বিষয় অনুঘটকরূপে কাজ করেছে। প্রথমত বৃটিশরা যে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলো, বার্মার জনসাধারণের কাছে তা ছিলো অপরিচিত। দ্বিতীয়ত এত বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য স্থানীয় জনশক্তিও ছিলো অপ্রতুল। পক্ষান্তরে ভারতে তখন কর্মসংস্থানের কিছুটা সঙ্কট ছিলো।

এসময় ভারত থেকে বড় বড় ব্যবসায়ী, মহাজন, উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মচারী ও সেনাকর্মকর্তা যেমন বার্মায় গিয়েছেন তেমনি শ্রমিক শ্রেণীর (রেল ও খনি) লোকজনও প্রচুর গিয়েছে। এমনকি নৌকার মাঝি ও ফেরিওয়ালাও বাদ যায়নি। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা থেকেও প্রচুর লোক তখন বার্মায় গিয়েছে। অবশ্য বাংলা অঞ্চলের জন্য বাড়তি কিছু সুবিধাও ছিলো। যেমনÑ

বৃটিশরা আরাকানে বিপুল পরিমাণ পতিত জমি কৃষিযোগ্য করার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়। এ উদ্দেশ্যে তারা ১৮৩৯ সালে একটি অধ্যাদেশও জারি করে। ফলে আরাকান থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী ও মগসম্প্রদায় মূলত অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আশায়, আর কিছুটা স্বদেশভূমির টানে আরাকানে ফিরে যায় এবং স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। অবশ্য বনজঙ্গল ছাফ করে বিশাল পতিত অঞ্চল আবাদযোগ্য করার জন্য এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছিলো। বহু মানুষ বিভিন্ন পাহাড়ী রোগব্যাধির শিকার হয়েছে, আবার অনেকে হয়েছে হিং¯্র পশুর খোরাক। এভাবে দেশটাকে সবুজ শ্যামল শস্যভাণ্ডাররূপে গড়ে তোলার পিছনে ছিলো তাদের বিপুল অবদান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে ঘরের কাছে আসামের নাম নেয়া যায়। ওখানকার পতিত ও জঙ্গল আবাদ করার জন্য পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষক সম্প্রদায় শুধু ঘামই ঝরায়নি, রক্তও ঝরিয়েছে। একসময় তো প্রতিটি কৃষক পরিবার ছিলো ম্যালেরিয়ার সহজ খোরাক। অস্ট্রেলিয়া, ফিজি ও দক্ষিণ আফ্রিকায়ও ঘটেছে একই ঘটনা। আর আমেরিকার ‘কালা আদমীরা’ তো এখনো দাসযুগের মর্মন্তুদ স্মৃতি নিয়ে ‘সাদা ভূমিতে’ই জন্ম নেয় এবং মারা যায়।

অকৃতজ্ঞ জনগোষ্ঠী এধরনের ঘাম ও রক্ত ঝরানো সেবা ভোগ তো করে, কিন্তু প্রয়োজন শেষে সব যেন ভুলে যায়! আরাকানে সেটাই ঘটেছে, আর আসামে যেন সেই প্রস্তুতিই শুরু হয়েছে।

এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মত এই যে, বার্মার মূলভূখণ্ডে যেমন বাঙ্গালীরা সংখ্যায় ছিলো নগণ্য, তেমনি ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা আরাকানে এসেছে খুবই কম, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। পক্ষান্তরে বার্মার মূলভূখণ্ডে ছিলো তাদের বিপুল উপস্থিতি। এ অবস্থা এমনকি এখনো বিদ্যমান।

লক্ষ্য করার মত দ্বিতীয় বিষয় Ñ যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরো গুরুত্বপূর্ণÑ এই যে, যদিও নতুন সুযোগের আওতায় রোহিঙ্গা ও মগ জনগোষ্ঠীর সবাই আরাকানে ফিরে যায়নি তবু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর আরাকান-প্রত্যাবর্তন ছিলো ব্যাপক হারে। পক্ষান্তরে মগসম্প্রদায় বিপুল সংখায় এ পারেই রয়ে গিয়েছিলো। একারণেই পুরো কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগামে এখনো বহু মগজনবসতি দেখা যায়।

অবশ্য তৃতীয় একটা বিষয়ও এখানে ছিলো। যেহেতু বাংলা-আরাকান অভিন্ন শাসকের অধীনে এসে গিয়েছিলো সেহেতু অভিন্ন দেশ ও অভিন্ন নাগরিক পরিচয়ে যাতায়তসুবিধা ছিলো অবাধ এবং যৌথ ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ ছিলো অবারিত। এ কারণে বাংলায় বসবাস করেও আরাকানে ব্যবসা পরিচালনা করা সহজ ছিলো।

আধুনিক যুগে বার্মা ও আরাকান

আগেও বলা হয়েছে যে, প্রথম ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধে স্বাধীনতাকামী আরাকানী (রোহিঙ্গ-মগ উভয়) জনগোষ্ঠী বৃটিশদের সমর্থন দিয়েছিলো। কারণ আরাকানীরা কোনভাবেই ভুলতে পারেনি যে, ১৭৮৪ সালে প্রধানত ধোকা ও প্রতারণার মাধ্যমে বর্মী রাজা বোধপায়া আরাকানের স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আরাকানকে বার্মার সঙ্গে একীভূত করে সরাসরি বৃহত্তর বার্মার প্রদেশে পরিণত করেছিলেন। আরাকানবাসীর আশা ছিলো, বৃটিশরা আরাকানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে; অন্তত বার্মা থেকে আরাকানকে আলাদা তো করবেই। কারণ তাতে বৃটিশদের স্বার্থ কোনভাবেই ক্ষুণœ হয় না। কিন্তু বৃটিশরা আরাকান-বার্মা দখল করলেও আরাকানকে বার্মা থেকে পৃথক করার বিষয়টি আলোচনার মধ্যেই আনেনি। বর্মী দখলদারির মত বৃটিশ দখলদারিতেও আরাকান বার্মারই অন্তর্ভুক্ত থেকে যায়।

এসময় একটা সমস্যা বেশ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তা এই যে, বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে যে সকল মুসলিম জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছিলো তাদের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক উন্নাসিকতা বিদ্যমান ছিলো। ফলে ঈমানি বন্ধনের ভিত্তিতে স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাই ভাই হয়ে জীবনযাপনের পরিবর্তে তারা নিজেদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার বিষয়ে খুব তৎপর ছিলো। ফলে স্থানীয় বর্মী ভাষী মুসলিমদের সঙ্গে ‘বহিরাগত’ মুসলমানদের মধ্যে একটা অপরিচয়, দূরত্ব ও বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরী হয়ে যায়। মুসলিমবিদ্বেষী মহল এটাকেই সুকৌশলে কাজে লাগায়।

আরাকানে স্বভাবতই এ সমস্যাটা  তেমন প্রকট ছিলো না, বরং ছিলোই না। কিন্তু এখানেও সুকৌশলে স্থানীয় মগ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ কথা বেশ জোরে শোরে প্রচার করা হয় যে, এরা বাংলা থেকে আগত বাঙ্গালী এবং ভারতীয়।

প্রথমে জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা একটি নির্দোষ আবরণ ব্যবহার করে। অর্থাৎ ১৯০৬ সালে রেঙ্গুন কলেজের ছাত্রযুবকদের সমন্বয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয় ণড়ঁহম গবহ'ং ইঁফফযরংঃ অংংড়পরধঃরংড়হ নামে; সংক্ষেপে (ণগইঅ)

্বলা হলো, বার্মা যখন বৃটিশ-দখল থেকে পূর্ণ মুক্ত হবে তখন যাতে বৌদ্ধ নাগরিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করা যায় এবং শিক্ষার বিস্তার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা যায়, সে জন্য এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠা।

তলে তলে অবশ্য মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি এরা ঠিকই চালিয়ে গিয়েছিলো।

বিপদের উপর বিপদরূপে এখানে আরেকটা বিষয় যুক্ত হয়েছিলো।

এর মধ্যে পর্দার আড়ালে শুরু হয়ে যায় নতুন দুর্যোগ। সেটা এই যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিলো। বার্মার আর্থসামাজিক অবস্থায়, বিশেষত প্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনে এর গুরুতর প্রভাব পড়েছিলো। এই সুযোগে ভারতীয় হিন্দু সূদখোর মহাজনেরা বেপরোয়া সূদী কারবারে মেতে ওঠে। ফলে মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত ও কৃষকশ্রেণী সর্বস্ব হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, এর স্বাভাবিক পরিণতি ছিলো, সর্বগ্রাসী ক্ষোভ ও বিদ্বেষ, যা আগ্নেয়গিরির মত ভিতরে ভিতরে লাভা পাকাতে শুরু করেছিলো। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে, ক্ষোভ ও বিদ্বেষ হিন্দু সূদখোর মহাজনদের  পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো না, মুসলিম বণিকগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষের উপরও তা আছড়ে পড়েছিলো। এর মধ্যে আবার কর্ম ও খাদ্যের সন্ধানে গ্রাম থেকে ক্ষুধার্ত কৃষকের দল শহরে এসে দেখতে পায়, এখানকার কর্মবাজার পুরোটাই মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ‘বহিরাগত’ ভারতীদের দখলে। ফলে ধূমায়িত ক্ষোভ ও বিদ্বেষ আরো যেন অনুকূল হাওয়া পেয়ে যায়। বলাবাহুল্য, জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে তোলার জন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষই সবচে’ উর্বর ক্ষেত্র। সুতরাং এটাকে সুকৌশলে কাজে লাগানো শুরু হলো, এমনকি আরাকানের ‘শান্ত’ জীবন-পরিবেশেও।

এ পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদী ‘হিং¯্র চেতনা’ বার্মার বৌদ্ধজনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ শিকড় গেড়ে বসে।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯১৭ সালে ইয়াম্বা থেকেই জেনারেল কউন্সিল অব বর্মিজ এসোসিয়েশন (জিসিবিএ) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়।

বার্মার মুসলিম নেতৃবৃন্দ অবশ্য পরিস্থিতির গতিবিধি সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল ছিলেন। তারা নিজেদের মত করে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন এবং বিচ্ছিন্ন-ভাবে কিছু চেষ্টাও করে যাচ্ছিলেন, যাতে স্থানীয়-বহিরাগত বিক্ষোভের অবসান ঘটিয়ে বিহৎ মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা যায় এবং স্থানীয়-অস্থানীয় ও ধনী-গরীব নির্বিশেষে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অভিন্ন আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর অধীনে নিয়ে আসা যায়। এ লক্ষ্যে প্রথম সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুরু হয় ১৯০৯ সালের শেষ দিকে।

উ বা অ (বর্মীনামধারী) রেঙ্গুনের অধিবাসী জনৈক মুসলিম ব্যবসায়ীর আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বার্মা সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। বার্মার পরিবর্তিত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করা ছিলো এ সংগঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

এখানে এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, ঐ ব্যবসায়ী ব্যক্তিটি তার মুসলিম বেরাদারির প্রতি যথেষ্ট নিবেদিত ছিলেন বলেই মনে হয়। কারণ যদ্দুর জানা যায়, নিজেকে তিনি শুধু পর্দার আড়ালেই রাখেননি, বরং ‘আর্থিককর্তৃত্ব’ থেকেও সর্বোতভাবে দূরে রেখেছেন।

সংগঠনটি ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার সাধ্যমত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো; বিশেষ করে মুসলিম স্বার্থরক্ষার বিষয়ে বৃটিশ সরকারের সঙ্গে দেনদরবারের ক্ষেত্রে। যেমন ১৯১৭ সালের শেষ ভাগে লর্ড চেমসফোর্ড ভারতশাসনআইন-সংস্কারের লক্ষ্যে বার্মা সফরে আসেন। তখন এ সংগঠনটি বার্মার মুসলিম কমিউনিটির একক প্রতিনিধিরূপে বিভিন্ন দাবীদাওয়াসম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করে। সংগঠনের পক্ষ হতে লর্ড চেমসফোর্ডকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয় যে, আইন পরিষদে মুসলিমদের যেন স্বতন্ত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হয়।

পরবর্তীকালে (১৯২০) ভারত- শাসনআইনের অধীনে যে বিখ্যাত সাইমন কমিশন গঠিত হয় সেখানেও এ সোসাইটি স্মারকলিপি প্রদান করে এবং মুসলিম স্বার্থের পক্ষে জোরালো দেনদরবার করে। এটা অবশ্য আলাদা বিষয় যে, বৃটিশসরকার শুরু থেকেই অলিখিতভাবে মুসলিম স্বার্থের প্রতি উপেক্ষার নীতিই অনুসরণ করে গিয়েছে। ভারত ভাগ করার বিষয় বলুন, আর বৃটিশভারত থেকে বৃটিশ বার্মাকে পৃথক করার বিষয় বলুন, বৃটিশদের আচরণ ছিলো অভিন্ন; ভারতে তারা আগাগোড়া হিন্দুস্বার্থ রক্ষা করেছে, আর বার্মা-আরাকানে রক্ষা করেছে বৌদ্ধস্বার্থ।

বৌদ্ধজাতীয়তাবাদীচক্র ততদিনে বার্মার মাটিতে এবং বর্মীজন-গোষ্ঠীর অন্তরে অনেকটা শিকড় বসতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, সাম্প্রদায়িক উম্মাদনার প্রাথমিক পর্ব মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে গেছে। তো এটাকে পুঁজি করেই ১৯৩০ সালে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের সক্রিয় অংশটি ঙঁৎ ইঁৎসধহ অংংড়পরধঃরড়হ নামে একটি চরমপন্থী সংগঠন গড়ে তোলে। এর পিছনে অবশ্য বৌদ্ধ বুদ্ধিজীবী এবং ভিক্ষুসমাজের সক্রিয় নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। কারণ প্রতিষ্ঠার অল্পকিছু দিন পরেই দেখা গেলো, সংস্থার নেতৃবৃন্দ বর্মী সমাজে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে বেশ উৎসাহ ও কুশলতার সঙ্গে নেমে পড়েছে!

এই সংগঠনের সদস্যরা শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নিজেদের আদর্শগত পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করার জন্য নামের সঙ্গে থাকিন শব্দটি ব্যবহার করতো, যার অর্থ হচ্ছে মালিক। এ কারণে সংগঠনটি বর্মীসমাজে থাকিন পার্টি নামে পরিচিতি লাভ করে। মূলত এটা ছিলো এই ইঙ্গিতবাহী যে, ভবিষ্যত বার্মার তারাই হতে চলেছে মালিকমুখতার!

পরবর্তী আলোচনার জন্য এখানেই আমাদের একটা প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে হবে। আরাকানের ভূখণ্ডে মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ মগসম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিলো?

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,

১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোধপায়ার যে আরাকান-আগ্রাসন তা শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিলো না, ছিলো একই সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী স্থানীয় মগজনগোষ্ঠীরও বিরুদ্ধে। তারপর দখলদার বাহিনীর যে লাগাতার শোষণ-নিপীড়ন তাও শুধু রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর উপর ছিলো না, মগসম্প্রদায়ের উপরও ছিলো। তাছাড়া ১৭ শতকের শেষ দিকে কোম্পানিশাসিত বাংলাদেশে যে বিপুলসংখ্যক আরাকানী শরণার্থীর আগমন ঘটেছিলো তার মধ্যে আনুপাতিক হারে কম হলেও মগসম্প্রদায়ের সংখ্যাও যে উল্লেখ-যোগ ছিলো তা তো ঐতিহাসিক সত্য।

তাছাড়া শুরু থেকেই মগ-রোহিঙ্গা সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত প্রীতিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যমূলক। তাই দেখা যায়, সিনপিয়ানের নেতৃত্বে আরাকানের যে স্বাধীনতাযুদ্ধ, তাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও মগ্রসম্প্রদায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। কঠিন থেকে কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের ‘সংগ্রামী ঐক্য’ অটুট ছিলো। আর এটা বোঝার জন্য গভীর কোন ঐতিহাসিক জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না যে, ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে এধরনের ঐক্য ও একাত্মতা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠে না, বরং এর পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে সুদীর্ঘ ও ধারাবাহিক ঐতিহ্য।

 

বৌদ্ধসম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মগসম্প্রদায়ের কাছে ইয়ামো পর্বতের অপর পারের হানাদার বৌদ্ধ বর্মীদের চেয়ে প্রতিবেশী রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী ছিলো অনেক বেশী আপন।

তথাকথিত বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী চক্রের মূল লক্ষ্য ছিলো (সমগ্র বার্মা ভূখণ্ডে এবং) আরাকানে মুসলিম-বৌদ্ধ সঙ্ঘাত, বিদ্বেষ-উন্মাদনা ও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় থাকিনপার্টির গোপন চক্রান্ত ও অশুভ তৎপরতা।

বৃটিশভারত এবং এর প্রদেশরূপে গণ্য বার্মায় প্রায় একই সঙ্গে স্বাধীনতা-আন্দোলন শুরু হয়। বার্মায় আন্দোলনের প্রথম পর্যায় ছিলো বৃটিশভারত থেকে বৃটিশ বার্মাকে পৃথক করা। তখন পরিস্থিতি এই ছিলো যে, রোহিঙ্গা-মগ উভয় সম্প্রদায়ের অভিন্ন দাবী ছিলো, বার্মা থেকে আরাকানের পৃথকীকরণ।

পক্ষান্তরে থাকিনপার্টির লক্ষ্য ছিলো রক্তের নদী প্রবাহিত করে হলেও স্বাধীনতা-উত্তর আরাকানকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত রাখা। এক্ষেত্রে হানাদার বর্মীরাজা বোধপায়ার সা¤্রাজ্যবাদী মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য ছিলো না। তবে আধুনিক রাজনীতি ও কূটনীতির কল্যাণে বৌদ্ধজাতীয়তাবাদীদের তৎপরতা ছিলো অধিকতর কুশলী।

গোপন পরিকল্পনার অধীনে প্রথমে তারা স্থানীয় মগনেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তাদের বোঝাতে শুরু করে যে, আরাকানসহ সমগ্র বার্মা আজ বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ দুই ভাগে বিভক্ত। আরাকানে যাদের রোহিঙ্গা বলা হচ্ছে, তারাও এর বাইরে নয়। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা প্রমাণ করে, এরা বাঙ্গালী বহিরাগত। ...

দুঃখজনক সত্য এই যে, ইতিহাসের নির্জলা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত জাতিগত বিদ্বেষমূলক এ প্রচারণা প্রথমে মগনেতৃবৃন্দ, তারপর বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে গ্রহণ করে নেয় এবং রোহিঙ্গা-মগ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ী বিদ্বেষ ভয়ঙ্করভাবে দানা বেঁধে ওঠে।

এর মধ্যে ১৯৩৭ সালে থাকিনপার্টির হাতে বড় একটা দাঙ্গাসুযোগ এসে যায়।

ৃবৃটিশসরকার বৃটিশভারত থেকে বৃটিশবার্মাকে আলাদা করার ঘোষণা দেয় এবং এ উদ্দেশ্যে বৃটিশপ্রশাসন ‘হোমরুল’ জারি করে, যার আলোকে বার্মায় স্থানীয় সরকার গঠনের বিষয় অনুমোদন দেয়া হয়। এতে বর্মী জাতীয়তাবাদিদের প্রায় ‘নিরঙ্কুশ’ প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জিত হয়। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেয়া এবং তাতে ঘৃতাহুতি দেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়।

এভাবেই ১৯৩৮ সালে রেঙ্গুনসহ নি¤œবার্মায় মুসলিমবিরোধী ভয়াবহ দাঙ্গা সঙ্ঘটিত হয়। তাতে ত্রিশহাজারের বেশী মুসলিম নিহত হয়। আহত হয় আরো কয়েকগুণ। দাঙ্গা-আক্রান্ত মুসলিমদের ঘরবাড়ী ও দোকান-পাটে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করা হয়।

১৯৪০ সাল থেকে দাবানলের আকারে একটা প্রচারণা ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, মুসলিমরা ইচ্ছাকৃত -ভাবে বৌদ্ধধর্ম ও এর প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের অবমাননা করছে। এজন্য অত্যন্ত কৌশলে তারা বিভ্রান্তিমূলক অথচ বিশ্বাসযোগ্য বিভিন্ন ‘তথ্য’ তৈরী করে নেয়। ফলে সঙ্ঘটিত হয় ১৯৪২ সালের নৃশংসতম মুসলিম গণহত্যা, যার নযির বার্মার ইতিহাসে নেই। আরাকানের হতভাগ্য রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনো ঐ গণহত্যাকে স্মরণ করে ৪২ এর নারকীয় গণহত্যা নামে, যেমন বাংলার মানুষ বেদনার্ত হৃদয়ে এখানো স্মরণ করে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে। এখানেও লাখ লাখ বনি আদম ‘নিহত’ হয়েছে। পার্থক্য এই যে, এখানে মানবতার কলঙ্ক বৃটিশ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি করেছিলো, আর ওখানে দাঙ্গা-উম্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছিলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারত ও বার্মা উভয় বৃটিশ উপনিবেশের চালচিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ভারতীয়রা যেমন যুদ্ধের গ্যাড়াকলে আটকে পড়া বৃটিশদের সঙ্গে দরকষাকষি করে এভাবে যে, যুদ্ধ শেষে আমাদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাও, আমরা যুদ্ধে তোমাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন দেবো, বার্মার থাকিন পার্টিও বেঁকে বসে যে, স্বাধীনতার নিশ্চিত অঙ্গীকার ছাড়া যুদ্ধে আমরা তোমাকে সমর্থন দেবো না। ভারতবর্ষে বৃটিশরা বেশ নমনীয় ছিলো, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বার্মায় তারা কঠোর নীতি অবলম্বন করে। অর্থাৎ জাতীয়তা -বাদী নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে।

তখন অং সান-এর নেতৃত্বে ত্রিশজনের একটি দল গোপনে জাপান চলে যায়।

জাপান সরকারের জন্য এটা ছিলো নেতাজী সুভাষ বসুর মতই লোভনীয় সুযোগ। তাই তারা ভালোভাবেই তা লুফে নেয়।

একজন জাপানী জেনারেলের নেতৃত্বে গঠিত হয় ইঁৎসধ ওহফবঢ়বহফবহঃ অৎসু (ইওঅ)

 জাপানী সেনাবাহিনী ‘বিআ’কে যেমন অল্প সময়ে উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলো, তেমনি পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র দ্বারাও সুসজ্জিত করেছিলো।

নেতাজী সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্ষেত্রে কিন্তু জাপান এতটা উদার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি, বরং যথেষ্ট ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করেছিলো। কারণ স্বাধীনচেতা নেতাজী ঐ নাযুক পরিস্থিতিতেও আজাদ হিন্দ ফৌজের উপর নিজের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন!

স্বাধীন বর্মী বাহিনীর প্রথম দলটি জাপানী বাহিনীর সঙ্গে ১৯৪১ সালে বার্মায় প্রবেশ করে। কিছুদিনের মধ্যেই রেঙ্গুনের পতন ঘটে। এরপর আরাকানসহ পুরো বার্মা চলে যায় জাপানী বাহিনীর দখলে। জাপানের বিমানবাহিনী যখন প্রচণ্ড বিমান আক্রমণ শুরু করে তখনই বৃটিশবাহিনী আরাকান ত্যাগ করে। বস্তুত এটা ছিলো বৃটিশবাহিনীর লজ্জাজনক কাপুরুষোচিত পলায়ন।

আরাকানে তখন একটা আশঙ্কা-জনক প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। আর এই সুযোগে আরাকানের স্থানীয় মগসম্প্রদায় ‘বিআ’র প্রত্যক্ষ মদদে সমগ্র আরাকানে নিরস্ত্র অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে দুই লাখ বনি আদমকে তারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। কিছু বিবেকবান অমুসলিম লেখকও স্বাধীনতাবাহিনী ও মগনরপশুদের পাশবিক উল্লাসের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন। বিশেষ করে নিহত ব্যক্তির ছিন্ন মস্তক বর্শার মাথায় গেঁথে উল্লাস করার ঘটনা প্রতিটি বিবেকবান মানুষকেই ব্যথিত করেছে। নির্বিচার ধর্ষণ, অগ্নি-সংযোগ ও লুণ্ঠন এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিলো, যেন ...!

আসলে যারাই এ বিষয়ে কলম ধরেন, এখানে এসে কলম যেন থমকে যেতে চায়। উপযুক্ত কোন শব্দই যেন খুঁজে পাওয়া যায় না প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য।

আমার কলম অবশ্য একটা উপমা খুঁজে পেয়েছে, ‘ভারতের সাতচল্লিশের মুসলিম গণহত্যা এবং সম্প্রতি গুজরাতের গণহত্যাকে যদি পঁচিশগুণ কল্পনা করা যায় তাহলে আরাকানের ৪২ ম্যাসাকারের কাছাকাছি হতে পারে!

এসময় বৃটিশরা করেছে এক নিমর্ম রসিকতা। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম দুর্গম গিরপথ পার হয়ে উত্তর আরাকানে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু পথিমধ্যেই হাজার হাজার নারী, শিশু, বৃদ্ধ অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে।

উত্তর আরাকানও তাদের জন্য নিরাপদ ছিলো না। তাই লক্ষাধিক মানুষ নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করে। একজন লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘নাফনদী ঐ সময় রোহিঙ্গা নারী-শিশু-বৃদ্ধের লাশে ভরে গিয়েছিলো।’

যারা খুব ভাগ্যবান ছিলো তাদের পক্ষেই শুধু নাফনদীর মৃত্যুছোবল থেকে আত্মরক্ষা করে এপারে বাংলাদেশে আসা সম্ভব হয়েছিলো।

কিন্তু এখানে এসে তারা শিকার হলো বৃটিশ সরকারের নির্মম এক রসিকতার! কক্সবাজারের পরিবর্তে সরকার উদ্বাস্তু শিবির তৈরী করলো সুদূর রংপুরের সুবীরনগরে। ক্লান্ত শ্রান্ত ও বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে বাধ্য করা হলো ‘নিজ নিজ ব্যবস্থায় রংপুর যেতে। পথে পথে মৃত্যুর হানাদারি উপেক্ষা করে খুব কম মানুষই পৌঁছতে পেরেছিলো ঐ উদ্বাস্তু শিবিরে। তারপরো সাদা চামড়াওয়ালাদের গর্ব মানবতা ও সভ্যতার!!

এখানে অবশ্য কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সীমিতসংখ্যক উদ্বাস্তুকে উপকূলীয় অঞ্চলে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলো, যা এখনো রিফিউজি ঘোনা নামে পরিচিত।   (চলবে ইনশাআল্লাহ)