রজব ১৪৩৯ হিঃ (৩/৩)

তোমাদের পাতা

ভুলে যাওয়া ইতিহাস জানতে হবে আবার

উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদ রহ.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

বহু হাজার বছরের ইতিহাসে পৃথিবী দেখেছে বহু জাতি ও সভ্যতার আবির্ভাব এবং বহু রাজ্য ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন। রোম, পারস্য, গ্রীক, মিসরীয় এবং আরো অনেক। নিজ নিজ যুগে তারা ছিলো প্রবল প্রতাপ ও শক্তির অধিকারী। জ্ঞান, বিজ্ঞান, শক্তি ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে নিজেদের সময়ে তারা রাজত্ব করেছে পৃথিবীর বুকে। তবে এদিক থেকে তারা সকলেই অভিন্ন ছিল যে, তাদের উত্থান অন্যান্য জাতি ও সভ্যতার জন্য বয়ে এনেছে অনেক দুর্ভোগ। তাদের অগ্রগতি অন্যান্য জনগোষ্ঠী ও জনপদের জন্য ডেকে এনেছে অনেক দুর্গতি।

অবশ্য এটা সত্য যে, কিছু ক্ষেত্রে কিছু সফলতা তারাও অর্জন করেছিল। মানবজাতির বৃহৎ পরিসরে তাদেরও ছিল কিছু না কিছু অবদান এবং মানবসভ্যতার চাকা তাদেরও দ্বারা অর্জন করেছে কিছু না কিছু গতি।

কিন্তু পৃথিবীর জাতি ও সভ্যতার ইতিহাসে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অভ্যুদয় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়। ইসলামের ছায়াতলে যে জাতি ও সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বে যেসকল রাজ্য ও সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটেছে তার বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্য এই যে, তা পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও জনগোষ্ঠী এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য কল্যাণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি ডেকে এনেছে; কারো জন্যই তা ক্ষতি ও দুর্গতির কারণ ঘটেনি।

এভাবেও বলা যায় যে, ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বহু প্রতাপশালী শাসক ও সম্রাটের আগমন মানবজাতি প্রত্যক্ষ করেছে। প্রত্যক্ষ করেছে তাদের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য এবং গর্ব ও অহঙ্কার। নিজেদের সময়ে তারা বিশাল ভূখ- শাসন করেছে দোর্দ- প্রতাপে। তারপর তারা হারিয়ে গেছে মহাকালের কৃষ্ণগহ্বরে। তাদের আগমনে পৃথিবী যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করেনি তেমনি তাদের নির্গমনেও কিছু হারায়নি। কিন্তু আদল ও ইনছাফ এবং সুশাসন ও ন্যায়বিচারের যে নমুনা ইসলাম কায়েম করেছে এবং মুসলিম উম্মাহ যুগে যুগে যত আদর্শ শাসক পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে অন্য কোন জাতি, সভ্যতা ও ধর্মের ইতিহাসে তা নেই। শান্তি ও সম্প্রীতি, দয়া ও উদারতা, মহত্ত্ব ও মহানুভবতা এবং শৌর্য ও সাহসের ক্ষেত্রে তারা ছিলেন সবার শীর্ষে। আখেরী নবী ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর এ মহান ইতিহাসের শুভসূচনা হয়েছিল হিজাযের ভূমিতে। জাত, পাত, রক্ত, বর্ণ, গোত্র, বংশ এবং আরো শত বিভেদে বিভক্ত, যুদ্ধ আর হানাহানিতে বিপর্যস্ত মানবতা আশ্রয় পেয়েছিল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। সকল ভিন্নতা ছিন্ন করে, ইসলামের অভিন্ন পরিচয়ে শান্তি ও মুক্তির পথের দিশা পেয়েছিল দিকভ্রান্ত মানবকাফেলা। ইসলামের সংস্পর্শে আওস-খাযরাজে যেমন তেমনি আরব ও আজমে সৃষ্টি হয়েছিলো অভূতপূর্ব এক প্রীতিবন্ধন। উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে ইসলামের ঝর্ণাধারা যেদিকেই প্রবাহিত হয়েছে, হিংসা বিদ্বেষ, হানাহানি ও খুনাখুনির আগুন নিভে গিয়েছে। শতাব্দির শত্রুতা ভুলে গিয়ে সবাই সবার ভাই হয়েছে।

***

আখেরি নবী ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর নতুন জাতি ও সভ্যতার এ কল্যাণধারা থেমে যায়নি, বরং  খেলাফতে রাশেদার ‘নূরানী ছায়ায়’ ইতহিাসের মহাসড়কে তার যাত্রা অব্যাহত ছিল। নবীর ওয়াফাতের পর খেলাফাতের মহাদায়িত্ব প্রথমে অর্পিত হয়েছিল এই উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হযরত আবু বাক্র ছিদ্দীক্ব (রা.) এর উপর। তারপর পর্যায়ক্রমে এ মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন হযরত উমর, হযরত উছমান এবং হযরত আলী রা.। তাঁরা হলেন ‘আল-খোলাফাউর রাশিদূন’।

মানবজাতির ইতিহাসে শাসক ও শাসনের এক নতুন ধারা সূচিত হল তাদের মাধ্যমে। নতুন নতুন দিগন্তে উদিত হল ইসলামের সূর্য এবং নতুন নতুন জনপদ আলোকিত হল ইসলামের আলোতে। হাজার বছরের সভ্যতা ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের গর্বে গর্বিত জাতিবর্গ মোহিত হল মরুভূমির বুকে ফোটা এই নতুন ফুলের সুবাসে।

অতীতে কোন জাতির পরাজয় তাদের জন্য ডেকে আনতো চরম ভাগ্যবিপর্যয় ও বিভীষিকাময় পরিণতি। পক্ষান্তরে বিজয়ী শক্তিকে পৌঁছে দিতো শোষণ, নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা ও নৃশংসতার চরমে। কিন্তু পৃথিবী এবার অবাক বিস্ময়ে দেখল পরাজয় কিভাবে পরাজিত শক্তির জন্য বয়ে আনে শান্তি ও মুক্তি এবং বিজয় বিজয়ী শক্তিকে কীভাবে মহিমান্বিত করে উদারতা, মহানুভবতা, ইনছাফ ও ন্যায়পরতা এবং বিনয় ও সংযমের মত মানবিক গুণাবলী দ্বারা। অবাক পৃথিবী কখনো দেখল বিশাল বিস্তৃত ভূখ-ের শাসক বাজারে চলেছেন হালাল উপার্জনের উদ্দেশ্যে, আবার কখনো দেখল অর্ধজাহান শাসনকারী খলীফা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন গাছের ছায়ায়, মাটির বিছানায়। কখনো দেখল, গনীমতের বিপুল সম্পদ সবার মধ্যে বণ্টন করে আমীরুল মুমিনীন বসেছেন ‘খেজুর পানি’র দস্তরখানে; কখনো দেখল রোম ও পারস্যের রাজদূত দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দরবারে খেলাফাতে। বোঝার চেষ্টা করছে ‘রাজা কে? প্রজা কে?’।

***

সমগ্র মানবজাতির জন্য ন্যায় ও ইনছাফের ভিত্তিতে রাজ্যশাসন ও  প্রজাতোষণের মহান আদর্শ স্থাপন করে তাঁরাও বিদায় নিলেন। খোলাফায়ে রাশিদীনের পর উম্মাহর নেতৃত্ব তথা খেলাফতের মহাদায়িত্ব ‘অর্পিত হল’ বানু উমাইয়ার হাতে। ‘অনাকাক্সিক্ষত সূচনার’ পরও তাদেরই হাতে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে তিন মহাদেশে। আফ্রিকার উপকূলে আটলান্টিকের উর্মিমালা ধন্য হয়েছে উকবা বিন নাফিয়ের পদচুম্বন করে। আফ্রিকার ‘জঙ্গলে’ তিনি জ্বেলেছেন কায়রাওয়ানের আলো। অসভ্য ইউরোপের ঘুম ভেঙ্গেছে তারিক্ব বিন যিয়াদের ঘোড়ার খুরের আওয়াযে। আন্দালুসিয়ার প্রদীপ দূর করেছে ইউরোপের অন্ধকার। মধ্য এশিয়ায় কুতাইবা বিন মুসলিমের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সইহুন-জাইহুন পাড়ি দিয়েছে ইসলাম। বুখারা ও সামারক্বান্দ ফুল হয়ে ফুটেছে বিশ্বমানচিত্রে। আমরা পেয়েছি  মুহাম্মাদ বিন কাসিমের মত মহোত্তম চরিত্রের অধিকারী বহু বিজয়ী সেনাপতি। যদিও ‘সিনিম্মারের প্রতিদানই’ পেয়েছেন তারা বানু উমাইয়ার কাছে এবং উম্মাহর ‘আনন্দ ও বেদনা’ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাদেরই ‘দান’। মহান ছাহাবী আবদুল্লাহ বিন যুবায়েরের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তাদের হাত। তবে আমীরুল মুমিনীন উমার বিন আব্দিল আযীযও তাদেরই  বাগানের সুবাস ছড়ানো ফুল! মাত্র দু’বছর কয়েক মাস সময় পেয়েছেন, কিন্তু এমনই ছিলেন তিনি এবং তাঁর শাসন যে, ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করে খোলাফায়ে রাশিদীনের পঞ্চম/ষষ্ঠরূপে। শাসন ক্ষমতাকে ক্রমেই লোভনীয় ভাবতে শুরু করা কাউমকে তিনি স্মরণ করিয়েছেন শাসনক্ষমতার গুরু দায়িত্ব কিভাবে সুখনিদ্রা কেড়ে নেয় এবং উম্মাহর ফিকির কিভাবে সুখশয্যা ছিনিয়ে নেয়। উম্মাহর নেতৃত্বের এ নববী আমানাত আরাম ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত বিখ্যাত ‘উমারিয়্যার ’ প্রবর্তক উমার বিন আব্দুল আযীযকে যেমন উমারে ছানীতে রূপান্তরিত করেছিল তেমনি সামান্য সময়ের শাসনে খায়রুল ক্বুরূনের শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি উম্মাহর জীবনে। কিন্তু কারবালার কান্না শেষ পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি বানু উমাইয়ার। এত শত গৌরবময় কীর্তি ও ‘কারনামা’র পরও মাত্র নব্বই বছরেই ‘বিলুপ্ত’ হল উমাইয়া খেলাফাত। তারপর খেলাফাতের ‘রক্তাক্ত স্থানান্তর’ হল বানু আব্বাসের কাছে। আব্বাসী খেলাফাতের প্রথম শতকটি ছিল তাদের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপ্লব সাধিত হয়েছে তাদের হাতে। মধ্যযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতির রাজধানী বাগদাদের উদ্বোধন হয়েছিল তাদেরই হাতে। কুফা, বসরা, দামেস্ক ও বাগদাদে ইলমচর্চা, জ্ঞানসাধনা ও গবেষণার অঙ্গনে তারা ছিল উদার পৃষ্ঠপোষক। তাদের মাঝে ছিলেন সুশাসন ও বীরত্বের প্রতীক খলীফাতুল মুসলিমীন হারুন রশীদ, যিনি ছদ্মবেশে বের হতেন বাগদাদের পথে প্রজাবর্গের অবস্থা স্বচক্ষে  দেখার জন্য, যিনি পিতা আল মাহদীর খেলাফাতকালে একলাখ মুজাহিদীনের বিশাল বহিনী নিয়ে রোমের উদ্দেশ্যে জিহাদযাত্রা করেছিলেন এবং পৌঁছে গিয়েছিলেন কুস্তুনতুনিয়ার ‘প্রাচীর’ পর্যন্ত।  তাঁর আগে এবং তাঁর পরে আর কোন আব্বাসী সেনাপতি সেখানে পৌঁছতে পারেননি। এটাই ছিল কুস্তুনতুনিয়া জয়ের সর্বশেষ ‘আরবপ্রচেষ্ট’া। তখন সেনাপতি হারুন রশিদের বয়স ছিল মাত্র সতেরো!!। তাকে ‘বিলাসী খলীফা’রূপে কলঙ্কিত করার বহু চেষ্টা করেছে শত্রুরা। ‘হাজার রজনী’র মত হাজারো অপবাদ আরোপ করে তাঁর চরিত্র হননের হাজারো চক্রান্ত করেছে তারা। শত্রুদের মর্মজ্বালার কারণ অবশ্য দুর্বোধ্য নয়, রণাঙ্গনে নাস্তানাবুদ করে পরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যকে বাধ্য করেছিলেন তিনি কর প্রদানে এবং অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ দ্বিতীয়বার আরোপ করেছিলেন দ্বিগুন কর। ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা আছে তার ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতা, বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং মহত্ত্ব ও উদারতার কথা। সত্যই তিনি ছিলেন ‘রুহবান-ফুরসান’ এর আদর্শ প্রতিনিধি। একবছর হজ্বের সফর, একবছর জিহাদের অভিযান, এই ছিলো তাঁর জীবন। তাঁর  খেলাফাতকালে সম্পদের ঢল নেমেছিল মুসলিম জাহানে এবং তাতে ছিল না জুলুমের কোন দাগ। ইমামে আযম আবু হানীফার সুযোগ্য শাগরেদ ইমাম আবু ইউসুফের তত্ত্বাবধানে অতি ন্যায়ানুগ কর- ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু আফসোস, পরবর্তী সময়ে ‘আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের আশঙ্কা করি না, বরং প্রাচুর্যের ভয় করি’ এই নববী ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়েছিল আব্বাসীদের জীবনে। ভোগ-বিলাস আর জলসা-মাইফিলে ডুবে ছিলো বাগদাদের শাসকেরা। পরিণতিতে উম্মাহর উপর নেমে এসেছিল তাতারী-অভিশাপ। এমনকি তাতারী-বাহিনী যখন ঘিরে ফেলেছে বাগদাদ তখনও ক্বাসরে খেলাফাতে চলছে...। খেলাফাতের রাজধানী বাগদাদ হারিয়ে খলীফা আশ্রয় নিলেন মিসরের মামালিক সুলতানদের কাছে। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী নতুন ভূমি ‘অর্জনের’ পরিবর্তে শত্রুদের আগ্রাসনের মুখে পুরোনো ভূমিই হারাতে হয়েছে বারবার। সৃষ্টি হয়েছে শতাব্দির জন্য আল আকসা হাতছাড়া হওয়ার মর্মান্তিক ইতিহাস। শরাবের পাত্রে ডুবে হারাতে হয়েছে রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে হাছিল করা আন্দলুস। হায় আন্দালুস! তারিক বিন যিয়াদের আন্দালুস! ইউসূফ বিন তাশফীনের আন্দালূস। ইতিহাস সাক্ষী, ইউরোপকে আমরা দিয়েছি সভ্যতার আলো,  ইউরোপ আমাদের সাথে করেছে অসভ্যতার চূড়ান্ত। সর্বযুগেই আমাদের শিআ’র ও বৈশিষ্ট্য ছিল উদারতা ও মানবিকতা, ওদের শিরায় ছিল পাশবিকতা। ফিলিস্তীনের আবাদ গীর্যাগুলো সাক্ষী আমাদের উদারতার, স্পেনের বিরান মাসজিদগুলো সাক্ষী ওদের নিষ্ঠুরতার।

***

সবকিছুর পরও খেলাফাত টিকে ছিল উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক হয়ে। খলীফা ও খেলাফাতকে উম্মাহ সবসময় সর্বোচ্চ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছে নবীর নিসবতে। আব্বাসীদের সূর্য যখন অস্তপ্রায়, এশিয়া মাইনরে কৃষ্ণসাগরের তীরে তখন উদিত হচ্ছিল একটি নতুন ভোর। লড়াকু যোদ্ধা, বীর মুজাহিদ, প্রজ্ঞাবান তুর্কিগোত্রপতি গাজী উছমান এবং তার ‘খালাফে সালেহ’ ও সুযোগ্য উত্তরসূীরদের নেতৃত্বে আনাতোলিয়ার প্রান্তরে উদিত হচ্ছিলো একটি নতুন সূর্য। ইতিহাসের পাতায় যাদের পরিচয় ‘বানু উছমান’। কুদরতের কী কারিশমা, ইতিহাসের মঞ্চে যখন তাতারী বর্বরতার হাতে খেলাফাতের রাজধানী বাগদাদের পতন হল ঠিক তখনই আনাতোলিয়ার বুকে গাজী উছমানের হাতে ভিত্তি স্থাপিত হল একটি ‘দাওলাতে ইসলামিয়া’র, দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর ‘স্থবিরতা’র পর  যারা নেতৃত্ব দেবে ইসলামের অগ্রাভিযানে, ‘ফোরাত থেকে দানিয়ুব, কাশগর থেকে কায়রো’ হবে যাদের বিচরণক্ষেত্র, শত সুলতান ও সালতানাতে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহকে যারা ঐক্যবদ্ধ করবে ‘চাঁদতারা’র পতাকাতলে, হাজার বছরের প্রতাপশালী রোমান সাম্রাজ্য একদিন যাদের পদানত হবে, যাদের তাকবীর ধ্বনিতে চূর্ণ হবে কুস্তুনতুনিয়ার ‘লৌহ প্রাচীর’, যাদের তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত হবে আয়া সুফিয়ার ক্রুশ এবং ইসলামকে যারা পৌঁছে দেবে ইউরোপের গভীরে।

***

অল্পসময়ের ব্যবধানে যোগ্য পূর্বসূরীর সুযোগ্য উত্তরসূরীদের জিহাদ-অভিযানের কল্যাণে তিন মহাদেশের গভীর ভূখ- পর্যন্ত বিস্তৃত হল দাওলাতে উছমানিয়া-এর সীমানা। তারা আরব ছিল না, কিন্তু ‘নবীয়ে আরাবী’ ছিলেন তাদের আদর্শ, তাদের রাহবার ও রাহনুমা। খেলাফাতের ‘পতাকা’ তাদের হাতে অর্পিত হওয়ার পূর্বেও দুই শতাব্দীরও অধিক কাল তারা ছিল ইসলামের  মোহাফেজ। দ্বীন ও দাওলাহ তাদের কাছে ছিল ‘প্রায়’ অভিন্ন। কোরআন ও সুন্নাহ ছিল তাদের সকল শক্তি ও আইনের উৎস। ইসলামের পতাকা হাতে ইউরোপের ভূখণ্ডে তাদের বিজয়াভিযান তাতারীঝড়ে ‘পক্ষাঘাতগ্রস্ত’ মুসলিমবিশ্বকে নবজীবন দান করেছিল। দাওলাতে উছমানীয়ার জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হওয়া ইউরোপ- অভিযানের ধারাবাহিকতায় ৭৯৭ হিজরী মোতাবেক ১৩৯৪ খৃস্টাব্দে উছমানী বংশের চতুর্থ সুলতান ‘ইসলামের বজ্র’ বায়েজিদ আওয়াল সমগ্র বুলগেরিয়া জয় করেন। বজ্র বা বিদ্যুৎ এ নামেই চিনত তাকে দুশমন। নামের প্রতি প্রকৃতই সুবিচার ছিল তার বিজয়াভিযানের গতিতে ও শক্তিতে। বিদ্যুৎগতিতে বজ্রের শক্তিতে তিনি ‘পতিত’ হতেন শত্রুর ওপর। দীর্ঘদিন থেকেই উছমানীদের উত্থানের শঙ্কায় দিন কাটছিল ইউরোপের। বুলগেরিয়া হারিয়ে তারা যেন সত্যিকার অর্থেই বজ্রাহত হল। পোপের আহ্বানে নতুন ক্রুসেডের স্বপ্ন নিয়ে সুলতান বায়েজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে বুলগেরিয়ার সীমান্তে একত্র হল হাঙ্গেরী, ফ্রান্স, ইতালী, জার্মানী এবং ইংল্যান্ডের সম্মিলিত বাহিনী। ৭৯৯ হিজরী মোতাবেক ১৩৯৬ খৃস্টাব্দে ইতিহাসবিখ্যাত নিকোপলিসযুদ্ধে মুখোমুখি হল ‘ক্রুস ও ক্রিসেন্ট’ এবং ‘ছালীব-হিলাল’। কিন্তু সুলতান বায়েজিদের বজ্রহামলায় অঙ্কুরেই বিনাশপ্রাপ্ত হল ইউরোপের নতুন ক্রুসেডের স্বপ্ন। প্রায় সমগ্র বলকান অঞ্চল উছমানী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হল। সুলতান বায়েজিদ আওয়াল, যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ার হাতে দুশমনের জন্য ছিলেন ‘শাদীদ’ ও কঠিন, আর শাসকের মসনদে ‘রাজদ-’ হাতে প্রজাদের জন্য ছিলেন ‘রাহীম’ ও দয়ালু। এক সাধারণ ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে একবার কাযীর আদেশে বজ্রসুলতান বিনয়াবনত হয়ে হাজির হয়েছিলেন কাযীর দরবারে। কিন্তু মহামান্য কাযী সুলতানকে সাক্ষ্য প্রদানের অনুপযুক্ত ঘোষণা করলেন। কারণ তিনি বা-জামাত ছালাতের প্রতি যতœবান নন। কাযীর ফায়ছালা মেনে নিয়ে ফিরে গেলেন সুলতান। তারপর প্রাসাদের পাশেই একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করলেন যেন শত ব্যস্ততার মধ্যেও জামাত ফাউত না হয়। বীরত্ব ও বিনয়ের এই সম্মিলনে আমাদের ইতিহাস তো সমৃদ্ধ, কিন্তু আছে কি এর কোন নমুনা ‘ওদের’ ইতিহাসে!

নিকোপলিস যুদ্ধে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মহাবিজয়ের অল্পকিছুদিন পরে, খৃস্টীয় চতুর্দশ শতকের শুরুতে যখন সুলতান বায়েজিদ কুস্তুনতুনিয়া অবরোধ করেছেন এবং কুস্তুনতুনিয়ার বিজয় যখন আসন্ন, তখন হঠাৎ এক ঝড়ে ল-ভ- হয়ে গিয়েছিল দাওলাতে উছমানীয়া। এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মধ্যএশিয়া থেকে শুরু করে দিল্লী, মুলতান, দামেস্ক, বাগদাদ সব পদানত করে আঙ্কারার উপকণ্ঠে হাজির হয়েছিল তাতারস¤্রাট চেঙ্গিজ খানের বংশধর তাইমূর, ইতিহাসে যার পরিচয় ‘তাইমূর লঙ্গ বা ল্যাংড়া তাইমূর’।

সুলতান বায়জীদকে তখন একান্ত অনন্যোপায় হয়ে কুসতুনতুনিয়ার অবরোধ তুলে ফিরে আসতে হলো আঙ্কারায়। যুদ্ধ হলো তাইমূরের তাজদম বাহিনী এবং সুলতানের দীর্ঘ জিহাদে ক্লান্ত শ্রান্ত বাহিনীর মধ্যে। স্বাভাবিক কারণেই সুলতান পরাজিত হলেন। দাওলাতে উছমানীয়ার প্রায় সমগ্র অঞ্চল তাতারদের দখলে চলে গেল। তাতারদের হাতে বন্দী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলেন সুলতান বায়েজিদ। ইউরোপের প্রাণে যেন পানি ফিরে এল। কুস্তুনতুনিয়ার পতন পিছিয়ে গেল কয়েক দশক। তবে ১৪০৫ খৃস্টাব্দে তাইমূরের মৃত্যুর পর যুলুমের উপর গড়ে ওঠা তার সা¤্রাজ্যের পতন শুরু হল, অন্যদিকে বজ্র বায়েজিদের পরবর্তী সুলতানদের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে আবার আগের অবস্থানে ফিরে এল বানু উছমান। আবার শুরু হল ইউরোপ-অভিযান। ৮৫৫ হিজরী মোতাবেক ১৪৫১ খৃস্টাব্দে শাসনদায়িত্ব গ্রহণ করলেন উছমানী বংশের সপ্তম সুলতান মুহাম্মাদ। ‘ক্রুশের ত্রাস’ ‘তাজে উছমানীর কোহিনূর’ এবং পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘সুসংবাদ’ সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ। মাটির উপর পানির জাহাজ চলেছিল যার সমরকুশলতায়! ‘জান্নাতের সুঘ্রাণে আত্মহারা’ এক বাহিনী নিয়ে ৮৫৭ হিজরী মোতাবেক ১৪৫৭ খৃস্টাব্দে তিনি জয় করেছিলেন বাইজেন্টাইনের রাজধানী ইউরোপের গর্ব, ‘অপরাজেয়’ কুস্তুনতুনিয়াহ! মহান ছাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রা.-এর কুস্তুনতুনিয়াহ!!

খলীফা হারুন রশীদসহ যুগ যুগের মুসলিম শাসকগণ যে বিজয়ের স্বপ্ন দেখতেন, আল্লাহ তা লিখে রেখেছিলেন মাত্র একুশ বছর বয়সী মহান সুলতান মুহাম্মাদের জন্য।  ফাতহে কুস্তুনতুনিয়ার সেই দিনে পরাজয়ের পূর্বমুহূর্তেও হঠকারী রোমান স¤্রাট উছমানী যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করেছিল চরম নিষ্ঠুরভাবে । তারপরও বিজয়ী সুলতান তাদের উপহার দিয়েছেন ইসলামের তাওয়াযু ও তাকওয়া। চরম রক্তক্ষয়ী বিজয়ের পরও তিনি শহরবাসী ও তাদের উপাসনালয় গীর্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এমনকি সকল অন্যায় অনাচারে সম্রাটকে পূর্ণ সহযোগিতা করার পরো গীর্যা প্রধানকে তার ‘উপযুক্ত’ সম্মানই তিনি প্রদর্শন করেছেন। ইহুদি ও আর্মেনীয়দের ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাইজেন্টাইন শাসনের সুদীর্ঘ কাল তারা যা থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে আমাদের শাসন ও শাসকের এ উদারতা তো আর নতুন নয়। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় এর সাক্ষী হয়েছে বারবার। কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পরই এসবের বড় নিকৃষ্ট প্রতিদান ইউরোপ আমাদের দিয়েছে আন্দালুসিয়ায় মুসলিম রক্তের সাগর তৈরি করে। আন্দালুসিয়ায় মুসলিম শাসনের অধীনে সুখে শান্তিতে বসবাসকারী ইহুদিরাও সেদিন খৃস্টানদের ধর্মীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল। সুলতানের নির্দেশে স্পেনের উপকূল থেকে মুসলিমদের উদ্ধারের পাশাপাশি প্রাণভয়ে পালানো হাজার হাজার ইহুদিকেও উদ্ধার করে এনেছিল উছমানী নৌবহর এবং খেলাফাতের ভূমিতে উদারভাবে তাদের জায়গা দিয়েছিলেন সুলতান। ফিলিস্তীনে এর উপযুক্ত প্রতিদানই দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে অভিশপ্ত ইহুদি সম্প্রদায়। ফাতহে কুস্তুনতুনিয়ার পর এই মহান বিজয়ে উদ্দিপ্ত বাহিনী নিয়ে ইউরোপের আরো ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন তরুণ তুর্কী সুলতান মুহাম্মাদ। মাত্র একুশ বছর বয়সী এই মর্দে মুমিন সুলতানের ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েছিল ইউরোপের পরাক্রমশালী রাজাধিরাজরা। দিশেহারা পোপ হন্যে হয়ে ছুটছিলেন আরেকটি ক্রসেডের জন্য। কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিয়ে উছমানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের মত হিম্মত ছিল না তখন ইউরোপয়ীদের বুকে। ৮৮৬ হিজরী মোতবেক ১৪৮১ খৃস্টাব্দের একদিন অসুস্থ অবস্থায় এক বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করলেন জিহাদের ফিদা সুলতান। ঐতিহাসিকদের ধারণা তাঁর লক্ষ্য ছিল ইতালির কোন ভূখণ্ড। তবে নিশ্চিতভাবে কখোনই তা আর জানা যায়নি। রণাঙ্গনের এই গোপনীয়তা ছিল সুলতানের সারা জীবনের রণকৌশলের একটি বড় অংশ। কিন্তু সফরের আগেই ‘মানযিলের’ ডাক এসে গেল সুলতানের। সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের ইন্তেকালের সংবাদ যখন পৌঁছল ইউরোপে, কম্পমান সিংহাসনগুলো যেন বহুদিন পর একটু স্থির হওয়ার সুযোগ পেল। গীর্যার ‘বোবা’ ঘন্টিগুলো যেন আওয়ায ফিরে পেল। গীর্যার পক্ষ থেকে তিনদিনের ধর্মীয় আনন্দ-উৎসব ঘোষণা করা হল সমগ্র ইউরোপে। ইউরোপের সেদিনের সেই উৎসবের সঙ্গে আলফাতিহের ‘সন্তান’ আজকের এরদোগানের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় ইউরোপের উল্লাসের কি আশ্চর্য সাদৃশ্য! ‘নিঃসন্দেহে তাতে রয়েছে শিক্ষা চক্ষুষ্মানদের জন্য’।

***

বানু উছমানের নেতৃত্বে ইউরোপের ভূখণ্ডে যখন চলছে ইসলামের বিজয়াভিযান মিসরে মামালিক সুলতানদের আশ্রয়ে তখনো টিকে ছিল আব্বাসীদের ‘খেলাফাত’। তাতারী হামলার মুখে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন মিসরে। মুসলিম উম্মাহ তখন ‘শত’ সালতানাতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। খেলাফাতের তাদের উপর ছিল না কোন নিয়ন্ত্রণ। মিসরে ছিল মামালিকদের শাসন। তবে খেলাফাতের ‘সম্মানে’ তারা আশ্রিত খলীফার অধিনতা ঘোষণা করেছিল। অবশ্য খলীফা উপাধিটুকু ছাড়া আর কিছুই তার অধীনে ছিল না। ১৫১৭ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৯২৩ হিজরীতে সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের পৌত্র সুলতান সালিম আওয়ালের যামানায় মিসর ও শামের সমগ্র এলাকা দাওলাতে উছমানীয়ার অন্তর্ভুক্ত হল। মিসরে অবস্থানকারী আব্বসী সিলসিলার সর্বশেষ খলীফা আল-মুতাওাক্কিল আলাল্লাহ খেলাফাতের ‘রায়াহ’ সুলতানের হাতে তুলে দিলেন। সুলতান সালিম আওয়াল হলেন অমিরুল মুমিনীন সালিম আওয়াল। দাওয়ালাতে উছমানীয়া রূপান্তরিত হল খেলাফাতে উছমানীয়ায়। শারীফে মাক্কাহ কাহেরায় উপস্থিত হয়ে হারামাইন শারীফাইনের চাবি আমিরুল মুমিনীনের হাতে তুলে দিলেন। কয়েক শতাব্দীর জন্য তিন হারামের সেবাসৌভাগ্য অর্জন করলেন বানু উছমান। পবিত্র জুমার দিন দামেস্কের জামে’উমাওয়ীতে খলীফার উপস্থিতিতে তার নামে খোতবা পঠিত হল। খতীব সাহেব খলীফাতুল মুসলিমীনকে সম্বোধন করলেন হারামাইনের ‘হাকিম’বলে।  বিনয়ী খলীফা বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যখ্যান করে বললেন, ‘আমি হাকিম নই খাদিম। আমি খাদিমুল হারামাইন আশ শারীফাইন। তারপর থেকে বানু উছমানের সকল খলীফার এটাই ছিল পরিচয়। খলীফা সালিমের পর খেলাফাতের এই মহান যিম্মাদারী অর্পিত হল তাঁর সন্তান সুলাইমানের কাঁধে। মহান পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া এই আমানাতের উপযুক্ত উত্তরাধিকারই ছিলেন তিনি। তাঁর শাসনকালটি ছিল প্রকৃতই খেলাফাতে উছমানীয়ার স্বর্ণযুগ, খলীফা সুলাইমানের যামানায় ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া তিন মহাদেশের আরো বিস্তীর্ণ এলাকা খেলাফাতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ৯২৭ হিজরী মোতাবেক ১৫২১ খৃস্টাব্দে ইউরোপ-অভিযানে তিনি জয় করেন সার্ব রাজধানী বেলগ্রেদ এবং হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্ট। উছমানী শাহসওয়ারদের অগ্রাভিযানে কেঁপে ওঠে ভিয়েনার প্রাচীর। যদি আর অল্প কিছুদিন অব্যাহত থাকতো ইউরোপের বুকে তাঁর অগ্রযাত্রা তাহলে হয়ত প্যারিস, বার্লিন আজ মুসলিম ভূখ-ের পরিচয় লাভ করত। কিন্তু ভিয়েনার প্রাচীর থেকেই ফিরে আসতে হল তাঁকে। কারণ খেলাফাতের পূর্বসীমান্তে তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে খেলাফাতের বিরুদ্ধে শিয়া বিদ্রোহ, যা তাঁকে ব্যস্ত করে রেখেছিল দীর্ঘ সময়। যুগে যুগে শিয়াসম্প্রদায় এভাবেই মুসলিম উম্মাহর ‘সেবা’ করেছে, আজো করছে! সুলতান সোলায়মানের স্বপ্ন ছিল স্থলপথে অভিযান পরিচালনা করে সদ্য হারানো আন্দালুসিয়া পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু যখনই উছমানী বাহিনী ইউরোপ-অভিযানে বের হত ক্রসেডারদের সাথে জোট বেঁধে ইরানের শিয়া সাফাভীরা খেলাফাতের পূর্বসীমান্তে হামলা করে তাদের ইউরোপ-অভিযান থামিয়ে দিত। খলীফা সুলাইমান আল কানূনীর যামানায় অদ্বিতীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নৌশক্তিতে পরিণত হয়েছিল উছমানী নৌবহর। এই নৌবহরের নেতৃত্বে ছিল একটি নাম, খায়রুদ্দিন বারবারোসা। তাঁর কিশতী যখন জলে ভাসতো শত্রুজাহাজ তখন স্থলে আশ্রয় খুঁজতো। সাগরের বিক্ষুব্ধ উর্মিমালা যেন শান্ত হয়ে যেত উছমানী নৌবহরকে পথ করে দিতে। খায়রুদ্দীন খলীফার নির্দেশে সাত সাতটি  দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করেছিলেন স্পেনের উপকূলে। উদ্ধার করেছিলেন স্পেনে আটকে পড়া হাজার হাজার অসহায় মুসলিম শিশু ও নরনারীকে। ৯৪৫ হিজরী মোতাবেক ১৫৩৮ খৃস্টাব্দে গ্রীসের উপকূলে পোপের আহ্বানে জড়ো হওয়া তৎকালীন নৌপরাশক্তি স্পেনীশ-পর্তুগীজ যৌথ নৌবহর শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল তাঁর হাতে। ৬০০ শত্রু জাহাজের মোকাবেলায় তাঁর ছিল মাত্র ১২২টি। ৬০ হাজার শত্রুসেনার মোকাবেলায় তাঁর ছিল মাত্র ১২ হাজার। লড়াইয়ের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র পাঁচ ঘন্টা, কিন্তু এমনই মহান ছিল এ বিজয় যে, পরবর্তী দীর্ঘকাল ভূমধ্যসাগর পরিণত হয়েছিল খেলাফাতে উছমানিয়ার ‘বাড়ীর পুকুরে’। কৃষ্ণসাগর বল, আর ভূমধ্য- সাগর, ইউরোপের সাহস ছিল না, ঐ পানিতে নৌকা ভাসায় দরবারে খেলাফাতের অনুমতি ছাড়া। এই সুবিশাল সুবিস্তৃত শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য খেলাফাতের আলেম ও ফকীহগণের তত্ত্বাবধানে, কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে খলীফা সুলাইমান প্রণয়ন করেছিলেন খুবই প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং ন্যায়ানুগ আইন কানূন যা পরিচিত ছিল ‘কানূননামাহ’ নামে। শত্রু ইউরোপ তাকে চেনে সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট বা সুলাইমান দ্য গ্রেট নামে। আর প্রাচ্য তাঁকে স্মরণ করে সুলাইমান আল ক্বানূনী নামে। তবে সুলইমান আল কানূনী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এই সকল কানূন শুধু প্রণয়নের জন্য নয়, বরং খেলাফাতের সুবিশাল ভূখ-ে বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ধর্মের এবং ভিন্ন পরিবেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এর সুষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমে। খলীফা হারুনুরশীদের মত তাঁরও চরিত্রে কালিমা লেপনের বহু চেষ্টা করেছে রণাঙ্গনে তাঁকে পরাজিত করতে ব্যর্থ শত্রুরা। কিন্তু ইতিহাস বলে, তিনি ছিলেন আমিরুল মুজাহিদীন। জীবনের শেষপ্রান্তে বিভিন্ন অসুস্থতায় তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে যখন খবর পৌঁছল যে হাঙ্গেরীতে খেলাফাতের পশ্চিম সীমান্ত শত্রুহামলার শিকার হয়েছে, ৭৫ বছরের বৃদ্ধ খলীফা আদেশ দিলেন, ‘ঘোড়া তৈয়াার ক্যরো’! হতবিহ্বল আমির ওমারাদের বাধার মুখে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন সেই একটি বাক্যই যথেষ্ট তাঁর সমগ্র জীবন তুলে ধরার জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতই তো আমার সারা জীবনের স্বপ্ন’। অর্ধবিশ্ব ছিল তাঁর শাসনাধীন। সেনাপতির হাতে দায়িত্ব দিয়ে ইচ্ছে করলেই তিনি গ্রহণ করতে পারতেন ‘প্রাসাদজীবন’, কিন্তু বাহিনীর নেতৃত্ব তিনি নিজের হাতে তুলে নিলেন। দীর্ঘ যাত্রায় তাঁর অসুস্থতা চূড়ান্ত সীমায় উপনীত হল। অনেকেই ফিরে যাওয়ার কথা বলল ,কিন্তু তাঁর এবারের যাত্রা তো সমাপ্ত হবে জান্নাতের দরজায়। ভয়ঙ্কর লড়াই হল, বৃদ্ধ খলীফা আসমানের দিকে দু’হাত তুলে জারজার হয়ে ফরিয়াদ করলেন এবং আল্লাহর সাহায্য নেমে এল। বিজয়ের সুসংবাদ যখন পৌঁছলো খলীফার কাছে তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। প্রশান্তির হাসি হেসে তিনি বললেন ‘মৃত্যু বড় মধুর হল’! যে আনন্দ উৎসব করেছিল ইউরোপ তার মৃত্যুতে সুলতান বায়েজীদ আওয়াল এবং সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের মৃত্যুতেই শুধু তা দেখা গিয়েছিল। সুলাইমান আল কানূনীর প্রায় অর্ধশতাব্দীর শাসনকালে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমরনীতিতে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খেলাফাতে উছমানিয়া। তাদের মোকাবেলা করার মত কোন শক্তি ছিল না পৃথিবীর বুকে, জলে কিংবা স্থলে। পৃথিবীর আকাশ তখন যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো না। নইলে সেখানেও দেখা যেতো খেলাফতে উছমানিয়ার ‘শাহীনদলের’ আধিপত্য। ইউরোপে গীর্যার ঘণ্টাধ্বনি থেমে যেত তাদের পদধ্বনি শুনে। ভূমধ্য সাগরে, কৃষ্ণ আর লোহিত সাগরে বিচরণকারী রণতরীতে তখন উড়তো শুধু একটি ঝাণ্ডা। চাঁদতারাখচিত খেলাফাতের লাল ঝাণ্ডা। খেলাফাতের ইচ্ছা পূর্ণ করে কৃতার্থ হত ইউরোপ। দরবারে খেলাফাতের ডাকে ছুটে এসে ধন্য হতো ইউরোপের শাসকবর্গ। খলীফার ‘বন্ধুতে’¡ ধন্য হত ইউরোপের রাজা ও সম্রাট। জাতিগত হিংসা ও হানাহানি এবং অকল্পনীয় শ্রেণীবৈষম্যে ইউরোপ যখন ক্ষতবিক্ষত, খেলাফাতের আশ্রয়ে, ইসলামের ছায়াতলে হাজারো জনগোষ্ঠি তখন বসবাস করেছে পূর্ন নিরাপত্তা ও প্রশান্তির সঙ্গে। এমনকি ‘অভিশপ্ত’ ইহুদি ও ‘পথভ্রষ্ট’ নাছারাও  নিরাপদে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করেছে খেলাফাতের যিম্মায়। 

***

১৪৫৩ খৃস্টাব্দে কুস্তুনতুনিয়াহ বিজয় থেকে শুরু করে খৃস্টীয় সতেরো শতকের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই শতাব্দীর এ সময়কালটি ছিল খেলাফাতে উছমানীয়ার শক্তি ও সমৃদ্ধির যুগ, যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল খলীফতুল মুসলিমীন সুলাইমান আল কানূনীর সময়কালে। কিন্তু...

প্রচ্যের কবি, কোথায় তুমি ইকবাল! তোমার কবিতা অবলম্বন করে দিলের যখম চাপা দিয়ে বলতে হয়

আা তুঝকো বাতাতাহুঁ তাক্বদীরে উমাম কিয়া হ্যয়/ শামশীরো সিনাঁ  আওয়াল তাঊসো রুবাব আখের।

সকল জাতির এই তো ইতিহাস, শুরুতে ঢাল তলোয়ার শেষে মদ ও মদীরা এবং সুর ও সুরা। সেই নঙ্গে নাচের জলসা ও গানের মাইফেল!

খলীফা সুলাইমান আল ক্বানূনীর মৃত্যুর পর গাযী উছমানের সন্তানদের মধ্যে ‘বাপ কা বেটা’র সিলসিলা যেন স্তিমিত হয়ে এল, কয়েক শতাব্দীর এ মহান বিজয়যাত্রায় যেটা ছিল তাদের বড় একটা শক্তি। পূর্বপুরুষের নাক্বশে ক্বদাম থেকে সরে এসে রণাঙ্গনের দায়িত্ব ও বাহিনীর নেতৃত্ব তারা ওযীরদের হাতে অর্পণ করা শুরু করলেন, আর নিজেরা ‘বন্দী’ হলেন ‘প্রাসাদজীবনে শরাব ও শাবাব’-এর মজলিসে। অথচ তাদের ‘সংলগ্নপূর্বে’ ছিল সুলাইমান আল কানূনীর উদাহরণ!

***

পড়ে পড়ে করেও পরবর্তী আরো একশ বছর উছমানী খলীফারাই ছিলেন বিশ্বসভায় নেতৃত্বের আসনে। যদিও কেন্দ্রের দূর্বলতার সুযোগে খেলাফাতের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন তখন ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো এবং তা দমনেই বহু শক্তি ক্ষয় হত, তারপরো ইউরোপে একক কোন শক্তি ছিল না তাদের মোকাবেলা করার মত। এমনকি ইউরোপের সম্মিলিত শক্তিও বারবার পরাজিত ও পর্যুদস্ত হয়েছে তাদের কাছে। তারপর এল ১৬৮৩ এর সেই বছর যখন শেষবারের মত ইউরোপের আকাশ ধূলোয় ঢাকা পড়ল মুসলিম বাহিনীর ক্ষুরাঘাতে। ভিয়েনার প্রাচীর থেকে খলীফা সুলাইমান আল ক্বানূনী ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার দেড়শ বছর পর খেলাফাতের ওযীরে আযম কারা মুস্তফা পাশার নেতৃত্বে শেষবারের মত অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা অবোরোধ করল উছমানী বাহিনী। কেমন হত আমাদের ইতিহাস যদি সেদিন ভিয়েনার পতন হত মুসলিম বাহিনীর হাতে? হয়ত...।

কিন্তু না হওয়ায় কি ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে আমরা তো আজ তার জীবন্ত সাক্ষী! মরণপণ করেও পেরে ওঠছিল না অবরুদ্ধ ভিয়েনাবাহিনী। দীর্ঘ দুই মাসের অবরোধে পরাজয়ের দারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তারা। ইউরোপ জানত ভিয়েনাপতনের কী অর্থ, তাই সব আত্মকলহ ভুলে পোপের আহ্বানে সত্তর হাজার যোদ্ধার এক সম্মিলিতবাহিনী এগিয়ে এল ভিয়েনার সাহায্যে। কিন্তু তাদের সামনে ছিল দানিয়ূব নদির বাধা। ইউরোপীয় বাহিনীর ভিয়েনাঅভিমুখে আসার এটাই ছিল একমাত্র পথ। বিচক্ষণ ওযীর মুস্তফা পাশা তাই তাতারবংশোদ্ভূত সেনাপতি মুরাদ গিরাইয়ের নেতৃত্বে বিশ হাজারের এক বিশাল বাহিনীকে দায়িত্ব দিলেন দানিয়ুবের উপর অবস্থিত পোলটি পাহারা দেয়ার। সেনাপতির প্রতি ওযীরের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল, প্রয়োজন হলে মুহূর্ত বিলম্ব না করে পোলটি যেন ধ্বংস করে দেয়া হয়। শত্রু যেন কিছুতেই পোল পার হতে না পারে। ইউরোপীয় বাহিনী ভালো করেই জানত দানিয়ূব অতিক্রম করা তাদের পক্ষে কতটা অসম্ভব! এবং এজন্য তাদের কী পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। নদীর অপর পারে ক্ষুদ্র একটি বাহিনীই যথেষ্ট ছিল এই পোলকে ‘পোলছেরাত’ বানানোর জন্য। তারপরও ইউরোপীয় বাহিনী এগিয়ে এল বিপুল প্রাণক্ষয়ের প্রস্তুতি নিয়ে। কারণ আর কোন পথ খোলা ছিল না তাদের সামনে। এটা ছিল তাদের জীবন মরণের এবং অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্ন।

এবার শুনুন আমাদের চরম ভাগ্যবিপর্যয়ের কাহিনী! ১৬৮৩ খৃস্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর দনিয়ুব নদির তীরে সঙ্ঘটিত হল খেলাফাতে উছমানীয়ার, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা; ইসলামের ইতিহাসের গতিধারা এবং মুসলিম জাহানের সবুজ মানচিত্রের রেখা পরিবর্তনকারী নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকতা!! ওযীরে খেলাফাত কারা মুস্তফা পাশার প্রতি ছিলো সেনাপতি মুরাদ গিরাইয়ের ব্যাক্তিগত বিদ্বেষ। তারই বশবর্তী  হয়ে খৃস্টানবাহিনীকে লক্ষ্য করে একটি তীরও না ছুঁড়ে নদীর তীর থেকে পিছিয় এল বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মুরাদ গিরাই। বরযাত্রীর মত নিরাপদে  দানিয়ূবের এপারে পৌঁছে গেল পুরো বাহিনী। প্রথমে তারাও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল এবং দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলো যে, এটা কোন ফাঁদ নয় তো!!  কী ঘটেছে তা যখন স্পষ্ট হল, উল্লাসে ফেটে পড়ল খৃস্টানশিবির!

‘হায় মুরাদ গিরাই, ইতনা হি গির গায়াথা তুম!!!’ হায়, তুমি যদি জানতে,ওযীর মুস্তফার প্রতি এই তুচ্ছ ব্যক্তিবিদ্বেষ কী বিপর্যয় ডেকে আনবে ‘উম্মাতে মুস্তফা’র জীবনে!

চূড়ান্ত হামলার অপেক্ষায় ভিয়েনা অবরোধে নিয়োজিত উছমানী বাহিনী হঠাৎ দেখল তাদের পিছনে আযদাহার মত মুখ হা করে এগিয়ে আসছে ইউরোপের সম্মিলিত তাজাদম  বিশাল বাহিনী! দীর্ঘ লড়াইয়ে উছমানীরা তখন ক্লান্ত শ্রান্ত, অবসন্ন।

১২ই সেপ্টেম্বর শুরু হল লড়াই; ভয়ঙ্কর অসম এক লড়াই। অনুগত বাহিনী নিয়ে শেষ লড়াই লড়লেন ওযীরে আযম কারা মুস্তফা পাশা। সেই চরম মুহূর্তেও তার সঙ্গ ত্যাগ করল আরও কতিপয় সেনাপতি, যারা হয়ত পরিস্থিতির কারণে হতাশ হয়ে পড়েছিলো, কিংবা হয়ত চাইতো না, সুলাইমান আল ক্বানূনী যে শহর জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন সে বিজয়-সৌভাগ্য অর্জন করবেন অখ্যাত ওযীর মুস্তফা!

হাজার হাজার মুজাহিদ নির্মমভাবে শহীদ হলেন। মুরাদ গিরাইয়ের ‘শরমনাক’ গাদ্দারিতে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা মুসলিমবাহিনী শেষপর্যন্ত রণাঙ্গন ছাড়তে বাধ্য হল পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। এটা ছিল বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং বিজয় ও মর্যাদার গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাসের সমাপ্তির সূচনা। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি খেলাফাতে উছমানীয়া। ইউরোপের বুকে ইসলামের ঝা-া হাতে উছমানীদের কয়েক শতাব্দীর বিজয়যাত্রার এক মর্মান্তিক সমাপ্তি ঘটল ভিয়েনার উপকণ্ঠে। উভয়পক্ষের জন্যই এটা ছিল ইতিহাসের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ইউরোপের জন্য ছিল জাগরণের শুরু, আর  খেলাফাতে উছমানীয়ার জন্য  ছিল পতনের সূচনা। উজ্জিবীত ইউরোপ একের পর এক হামলা চালিয়ে গেল খেলাফতের উপর। পরবর্তী মাত্র এক যুগেরও কম সময়ে সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনীর কাছে কয়েকবার পরাজিত হল উছমানী ফৌজ। পরিণতিতে ১৬৯৯ খৃস্টাব্দে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সঙ্গে ন্যাক্কারজনক কার্লোভিচ চুক্তিতে আসতে বাধ্য হল তারা। বিপুল ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে অর্জিত মধ্যইউরোপের বিশাল এলাকা খেলাফাতের হাতছাড়া হয়ে গেল। কয়েক শতাব্দীর অগ্রাভিযানের গৌরবময় এক অধ্যায়ের পর শুরু হল পশ্চাদপসরণ। পরবর্তী সময়ে উছমানীদের অল্প যা কিছু বিজয় তা শুধু পুরোনো কিছু ভূমি কিছু সময়ের জন্য পুনরুদ্ধারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রেই যেন সর্বগ্রাসী এক অধঃপতন শুরু হল, যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল স্বয়ং খেলাফাতেরই ‘বিলুপ্তি’। তবে এসবের বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগেই । ‘অমুসলিম’ স্ত্রী গ্রহণের যে ধারা শুরু হয়েছিল খলীফাদের মধ্যে তারই ফল ছিল ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, ভোগ-বিলাস, আত্মকলহ, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধসহ আরো অনেক কিছু। মহান বিজয়াভিযানের নেতৃত্বদানকারী ‘জানেছারান’ যোদ্ধারা যেন যুদ্ধ ভুলে গেল। মদ-শরাবের মৌজমস্তি এমনই চরম আকার ধারণ করল যে, এমনকি খলীফাও বাধা দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতেন। তাছাড়া তার নিজের সাদা কাপড়েও ...!! জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও শক্তি- প্রয্ুিক্ততে ইউরোপ যখন এগিয়ে যাচ্ছে দুর্দমনীয় গতিতে উছমানীদের তখন হিমশিম খেতে হচ্ছে অধঃপতনের গতি কিছুটা রোধ করতেই। এর মধ্যেও কোন কোন খলীফা  সংস্কার-সংশোধনের কিছু বিচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু গড়িয়ে পড়া প্রস্তরখ- আবার শীর্ষচূড়ায় ফিরিয়ে আনার জন্য যে সর্বমুখী শক্তির প্রয়োজন; প্রজ্ঞা ও বিশ্বাসের যে গভীরতার প্রয়োজন এবং প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয়ের যে দৃঢ়তার প্রয়োজন তার বড় অভাব ছিল। উছমানী বংশের আটাশতম খলীফা তৃতীয় সালীমকে বলা হয় প্রথম খলীফা, যিনি খেলাফাতের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষা, শিল্প ও সমর বিভাগের আধুনিকায়নে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রচেষ্টায় ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী জানেছারান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং শেষ পর্যন্ত হত্যাই করে ফেলে। তার পরবর্তী খলীফা দ্বিতীয় মাহমূদও সংস্কারধারা অব্যাহত রাখেন এবং কিছু পরিমাণে সফল হন। কিন্তু অগ্রগতির পথে ধাবমান ইউরোপের মোকাবেলায় তা কিছুতেই যথেষ্ট ছিল না।

তাছাড়া এসকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় সবচে’  বড় সীমাবদ্ধতা এই ছিল যে, আগাগোড়া তা ইউরোপ দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিল; দ্বীন ও শারীয়াত এবং উম্মাহর ‘উভজাগতিক’ কল্যাণ মুখ্য ছিল না। ফলে আধুনিকায়নের পথে এক ধাপ অগ্রগতির বিপরীতে দ্বীনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কয়েক ধাপ। বস্তুত এ মহাসত্যটি আমরা সবসময় ভুলে যাই যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ধর্মকে ত্যাগ করেও হয়ত কিছু উন্নতি, অগ্রগতি অর্জন করতে পারে, কিন্তু যে জাতিকে আল্লাহ মর্যদাবান করেছেন ইসলাম দ্বারা তারা যদি আগে বাড়তে চায় ইসলামকে ত্যাগ করে, যিল্লতি ছাড়া আর কিছুই জুটবে না তাদের ভাগ্যে।

উছমানীদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে শেষ পর্যন্ত। কয়েক শতাব্দী খেলাফাতে উছমানীয়া ছিল ইউরোপীয় শক্তিবর্গের জন্য এক মহাআতঙ্কের নাম। সম্মিলিত বাহিনী ছাড়া যার সামনে দাঁড়ানোর কথা চিন্তা করাও তাদের জন্য অসম্ভব ছিল। খেলাফাতের বিলুপ্তি ছিল তাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। কয়েক শতাব্দীর ‘অগ্নিপ্রতীক্ষা’র পর এবার যেন তারা বড় একটা সম্ভাবনা দেখতে পেল। খলীফাদের অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা, অসতর্কতা ও সর্বমুখী দুর্বলতার সুযোগে খেলাফাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল গুপ্তচরের বিশাল চক্র। বহু ‘স্বেচ্ছাসেবক সেবাদাস’ও তারা পেয়ে গেল। এর মধ্যে খেলাফাতের দুধ কলায় লালিত পালিত ইহুদিরা ছিল তাদের সবচেয়ে বিস্বস্ত সহযোগী। ইউরোপের তাড়া খেয়েই একদিন যারা আশ্রয় পেয়েছিল খেলাফাতের ভূমিতে তারাই হল খেলাফাতের বিরুদ্ধে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী। ইউরোপের প্রত্যক্ষ ইন্ধন আর উস্কানিতে খেলাফাতের বিভিন্ন অংশে বারবার জ্বলে উঠল ভয়াবহ বিদ্রোহের আগুন। কিন্তু মযবূত -ভাবে এর মোকাবেলা করার মত কেউ ছিল না খেলাফতের মসনদে। ১৮৩০ সালে মিসরের প্রশাসক আলী পাশা বিদ্রোহ করে বসল খেলাফাতের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে স্বয়ং খেলাফাতের রাজধানীতেও আক্রমণের প্রস্তুতি নিল। নিরুপায় খলীফাকে শেষপর্যন্ত রাশিয়ার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতে হল। এতেই বোঝা যায়, কতটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল খেলাফাতের বুনিয়াদ। সুযোগ বুঝে রাশিয়া সাহায্য তো করল, তবে মূল্যও উশুল করে নিল সুদে আসলে!

ফ্রান্স, রাশিয়া, অষ্ট্রিয়া ও অন্যান্য শক্তি খেলাফাতের ভূখণ্ডে বারবার ছোবল দিতে লাগল। কয়েকশ বছর ইসলামের ছায়াতলে থাকা এলাকাগুলো একের পর এক হাতছাড়া হতে থাকল। কখনো বসনিয়া, কখনো সার্বিয়া, কখনো আলজেরিয়া কখনো তিউনিসিয়া। যে সকল ভূখ- জয় করেছিলেন সুলতান বায়েজীদ, মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এবং সুলাইমান আল ক্বানূনীর মত মহান শাসকগণ দয়া ও উদারতার শ্রেষ্ঠ সব নমুনা কায়েম করে সেগুলো যখন আবার শত্রুর হাতে পড়ল, সেখানকার মুসলিম অধিবাসিদের উপর যেন আসমান ভেঙ্গে পড়ল। ভয়াবহ জুলুম নির্যাতনের মুখে লক্ষ লক্ষ মুসলিম হিজরত করতে বাধ্য হল। অথচ মুসলিম শাসনের অধীনে সব ধর্মের অনুসারীরা স্বাধীনভাবে সেখানে বসবাস করেছে সুদীর্ঘকাল।

একের পর এক দুর্যোগে অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল খেলাফাত।

প্রতিনিয়ত বেড়ে চলল ঋণের বোঝা, রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ শুরু করল ইউরোপীয় ঋণদাতারা। কিন্তু নীরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা খলীফার।

খেলাফাতের উদারতা আর ‘সরলতা’র সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদ দখল করে নিল খেলাফাতের আশ্রিত ইহুদিরা, ফিলিস্তিনে ইহুদিবসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারী করায় বহুদিন থেকেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ছিল খেলাফাতের উপর। এবার তারা মরণ কামড় দেয়ার প্রস্তুতি নিল। ইহুদিদের গোপন বিশ্বসংগঠন ফ্রি ম্যাসনের সদস্য রশীদ পাশা, ফুয়াদ পাশা, মিদহাত পাশা এবং আরো অনেকে যারা খেলাফাতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিল, ভিতর থেকেই খেলাফাতের পতন ঘটানোর জন্য তারা গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করলো। ১৮৩৯ সালে আধুনিকায়নের নামে ইউরোপের অনুকরণে তারা বিভিন্ন ‘সংস্কারপদক্ষেপ’ ঘোষণা করল, যার মূল উদ্দেশ্যে ছিল কোরআন ও সুন্নাহর বন্ধন থেকে খেলাফাতকে বিচ্ছিন্ন করে খেলাফাতের পতন তরান্বিত করা। কার্যত তাদেরই হাতে ছিল তখন সকল ক্ষমতা। খলীফা ছিলেন তাদের ক্রীড়নক মাত্র। এমনকি তাদের নির্দেশ অমান্য করায় ১৮৭৬ সালে  মিদহাত পাশার নেতৃত্বে তৎকালীন খলীফা আব্দুল আযীযকে তারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রথমে পদচ্যুত করে, তারপর হত্যাই করে ফেলে। খেলাফাতে উছমানিয়া আর টিকে থাকতে পারবে কি না, এটা তখন আলোচনার বিষয় ছিল না, বরং পতনের পর কোন অংশ কার ভাগে যাবে সেটাই ছিল ইউরোপের প্রধান আলোচনার বিষয়। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, এই সেই খেলাফাতে উছমানীয়া, মাত্র দেড়শ বছর আগেও যাদের স্বপ্ন ছিল সমগ্র ইউরোপে বিজয়ের ঝাণ্ডা উত্তলোনের, যাদের ভয়ে কম্পমান ছিল ইউরোপের সব সিংহাসন।

***

সবাই যখন বুঝে নিয়েছে যে, খেলাফাতের পতন এখন শুধু সময়ের বিষয়; শত্রু যখন উল্লসিত যে, তাদের বহুদিনের স্বপ্ন এবার সফল হতে চলেছে। ইহুদিরা প্রস্তুত ফিলিস্তীনের পাক যমীনে তাদের নাপাক দখল কায়েম করার জন্য। খেলাফাতের মানচিত্র ঘিরে ইউরোপও প্রস্তুত ‘ছুরি-কাঁটা চামচ’ নিয়ে। এমনই এক চরম দূর্যোগপূর্ণ সময়ে প্রলয়ঙ্করী এক তুফানের পূর্বমুহূর্তে খেলাফাতের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন আমীরুল মুমিনীন, খলীফাতুল মুসলিমীন, সুলতান গাযী আব্দুল হামীদ খান। অতল গহ্বরে পতনের পূর্ব -মুহূর্তে, পর্বতচূড়া থেকে ধেয়ে আসা ঢলের সামনে তিনি, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিঃসঙ্গ যোদ্ধা দাঁড়িয়ে গেলেন হিমালয়ের অবিচলতা নিয়ে। কামড় বসানোর ঠিক পূর্বমুহূর্তে, লালাঝরা মুখের সামনে থেকে লোভনীয় টুকরোটি সরে যেতে দেখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল ‘দুশমনের পাল’ পাগলা কুকুরের মত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলো ঘরে ও বাহিরে ওৎ পেতে থাকা...।

তাঁর নামে কালিমা লেপনের, তাঁকে কলঙ্কিত করার এবং তাঁকে উৎখাত করার কোন চেষ্টাই তারা বাকি রাখেনি। কিন্তু অসীম ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে পাহাড়ের দৃঢ়তা ও অবিচলতা নিয়ে খেলাফাতের পতন তিনি পিছিয়ে দিলেন সুদীর্ঘ তিনটি দশকের জন্য। তাঁরই অপরিসীম ধৈর্য ও প্রজ্ঞা এবং ত্যাগ ও আত্মত্যাগের কল্যাণে আরো ত্রিশটি বছর খেলাফাতের ছায়া লাভ করলো মুসলিম উম্মাহ।                       উম্মাহর জন্য নিজেকে কোরবানকারী, উম্মাহর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গকারী মহান ব্যক্তিদেরকে ভুলে যাওয়ার এবং তাদের দান ও অবদানের প্রতি অকৃতজ্ঞতার ইতিহাস তো আমাদের অনেক দীর্ঘ। তবে মুসলিম উম্মাহর নিকট অতীতে সুলতান আব্দুল হামীদ আছ- ছানীর মত আপনপর সবার পক্ষ হতে নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুর আঘাতে ক্ষত বিক্ষত, জঘন্য থেকে জঘন্য বোহতান-অপবাদে জর্জরিত, এমন মাযলূম ব্যাক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি নেই। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মাঝ দরিয়ায় ভাঙ্গা কিশতির মাঝির চেয়েও অসহায় ছিলেন তিনি। কয়েক পুরুষ ধরে চলতে থাকা এবং জমতে থাকা লাগামহীন অনাচার ও ভোগবিলাস, আর অযত্নে অবহেলায় ডুবু ডুবু এক কিশতির হাল ধরেছিলেন তিনি। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা হিংস্র হায়েনাদের লোলুপ দৃষ্টির মাঝে, জরাগ্রস্ত ও ঋণের বোঝায় পর্যুদস্ত, ছেঁড়াফাড়া এক মানচিত্র পেয়েছিলেন তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে। কিন্তু ক্রান্তিকালে তিনি ছিলেন স্বর্ণযুগের মহান পূর্বপুরুষদের প্রতিবিম্ব।                                                                           যদি শুধু একটি বক্তব্য যথেষ্ট হয় একটি জীবনকে তুলে ধরার জন্য, যদি কয়েকটি শব্দ যথেষ্ট হয় একটি ইতিহাস রচনার জন্য, যদি একটি দৃঢ়তা যথেষ্ট হয় সকল দুর্বলতা ঢেকে দেয়ার জন্য এবং যদি শুধু একটি ভালো যথেষ্ট হয় সকল ভুল ভুলে যাওয়ার জন্য, তাহলে অর্থের লোভ দেখিয়ে ফিলিস্তীনের ভূমি দখলের চক্রান্তকারী ইহুদি সর্দার হার্জেলের উদ্দেশ্যে ঋণভারে পর্যুদস্ত খেলাফাতে উছমানীয়ার মহান সুলতান আব্দুল হামীদ আছ-ছানীর সেই ইমানদীপ্ত বক্তব্যটি হল তার আদর্শ নমুনা ‘ড.হার্জেলকে তোমরা বলে দাও ফিলিস্তীনের পবিত্রভূমি নিয়ে সে যেন আর বাড়াবাড়ি না করে। ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমির এমনকি একমুঠ বালুও আমি ওদের হাতে তুলে দেব না। এ তো আমার মালিকানা নয়। এতো সমগ্র উম্মাতে মুসলিমার সম্পদ। এ ভূমি অর্জন করেছেন আমার মহান পূর্বপুরুষগণ জিহাদের পথে, এ ভূমিকে তারা সিঞ্চিত করেছেন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। ইহুদিরা তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন তাদের কাছেই আগলে রাখুক। (আমার পরে) যখন খিলাফত .... তখন বিনামূল্যেই তারা ফিলিস্তীন পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন খেলাফত- ভূমি থেকে ফিলিস্তীন বিচ্ছিন্ন করার চেয়ে আমার দেহ থেকে অঙ্গ কেটে নেয়া আমার জন্য সহজ। আর এটা তো অসম্ভব, দেহে প্রাণ থাকতে কিভাবে আমরা আমাদের অঙ্গচ্ছেদে রাজি হতে পারি!! (ইনশাআল্লাহ চলবে)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা