রজব ১৪৩৯ হিঃ (৩/৩)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

হযরত মাওলনাা সৈয়দ আবুল হাসান আলাী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্য সফরের রোযনামচা

ডাক দিয়ে যায় মুসফির!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ডাক দিয়ে যায় মুসফির!

হযরত মাওলনাা সৈয়দ আবুল হাসান আলাী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্য সফরের রোযনামচা
  (হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ. এর একটি মূল্যবান কিতাব হলো مذكرات سائح في الشرق الأوسط (মধ্যপ্রাচ্যের একজন পরিব্রাজকের রোযনামচা)। লেখক ও লেখার নাম থেকে বোঝা যায়, এটি একজন দাঈ, চিন্তাবিদ ও আলিমে দ্বীনের দীর্ঘ সফরের রোয়েদাদ। যদিও এ সফরের সময়কাল ছয় দশকেরও বেশী আগে। এরপর মুসলিম উম্মাহর দুনিয়া-জাহানই আমূল বদলে গেছে। তারপরো এ সফরনামা বা রোযনামচার উপকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা, প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। বিশেষ করে আমাদের তালেবানে ইলমের ভবিষ্যতের কর্ম ও কর্মপন্থা বোঝার জন্য এর উপযোগিতা অপরিসীম। তাই পুষ্পের পাতায় কিতাবটি নিয়মিত অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা অনেক চিন্তার পর কিতাবটির নাম নির্ধারণ করেছি, ‘ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!’। আমাদের মনে হয়েছে এতে পুরো কিতাবের প্রাণ ও প্রাণচিত্র উঠে এসেছে। কারণ তাঁর ও তাঁর কলমের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যই হলো ইসলামের প্রতি, মুসলিম উম্মাহর প্রতি দিলের দরদ-ব্যথা। এ দরদ-ব্যথা এবং ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা নিয়েই তিনি সফর করেছেন আরবের বিস্তৃত ভূমি! মুসলিম উম্মাহর বিশাল জনপদ! যেখানেই তিনি গিয়েছেন, গাফলতের ঘোরে অচেতন মানুষকে জাগরণের ডাক দিতেই গিয়েছেন! কিতাবের নামের মধ্যে সেই দরদী ডাকের আকুতি থাকা দরকার বলে আমাদের মনে হয়েছে। আর মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিভাষা। ঐ জাতীয় সফরের ক্ষেত্রেই শব্দটির ব্যবহার হতে পারে। দ্বীনী দাওয়াতের প্রেরণা থেকে যে সফর তাতে এ শব্দটির উপযোগিতা আছে বলে আমাদের মনে হয় না। আল্লাহ কবুল করুন, মাকবূল করুন- সম্পাদক) 

(১)আলবিদা আয় হেজায! আলবিদা আয় জাযীরাতুল আরব!!

শনিবার/১২ই রবিউল আউয়াল ১৩৭০ হি./২০শে জানুয়ারী ১৯৫১ খৃ

সূর্যাস্তের পর পশ্চিম দিগন্তে আলো-আঁধারির বিষণ্ণতা, যেন আমারই হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি! পানির জাহায আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলো জিদ্দা থেকে মিশরের সুয়েজের উদ্দেশ্যে! জাহায থেকে হিজাযের মাটি ও মানুষ তখনো দেখা যায়। শেষবারের মত জাযীরাতুল আরবের দিকে বুলিয়ে নিলাম বিদায়ের বিষণ্ণ করুণ দৃষ্টি!! আমার তখন বলতে ইচ্ছে করছে হিজাযের প্রিয় ভূমিকে, ‘এই যে তোমাকে ছেড়ে যাওয়া, তা কিন্তু তোমার প্রতি অনাগ্রহের কারণে নয় এবং নয় চিরকালের জন্য!আর এই যে সাময়িক বিচ্ছেদ, তাও তোমারই প্রতি আমার হৃদয় ও আত্মার দায়বদ্ধতার কারণে। এই যে তোমার সন্তানেরা ছড়িয়ে আছে লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূলে, তাদের প্রতি তোমার আকুলতা, তোমার মিনতি আমি বুঝতে পারি। তাদেরই কাছে আমি আজ চলেছি তোমার সালাম ও পায়গাম নিয়ে। আমি চলেছি নিজের চোখে তাদের অবস্থা দেখে আসতে। আমি দেখতে চাই, তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর যুগের দুর্যোগ ও যামানার গার্দিশ তাদের কী অবস্থা করেছে! আর তারাই বা তোমার সেই রিসালাহ ও পায়গামের সঙ্গে কী আচরণ করেছে, যা তারা বাইরের দুনিয়ার জন্য তোমার কাছ থেকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলো?! আমি জানতে চাই সেই মহান আমানতের কথা কি তাদের মনে আছে যা তুমি বিদায়ের সময় তাদের কাছে অর্পণ করেছিলে?! সব দেখে শুনে, সব হিসাব বুঝে নিয়ে ইনশাআল্লাহ আমি আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে। সেখানে যা কিছু দেখেছি, কল্যাণ-অকল্যাণ, জাগৃতি ও বিস্মৃতি, বিশ্বস্ততা ও বিচ্যুতি, আনুগত্য ও অবাধ্যতা, যা কিছু দেখেছি সব আমি তোমাকে জানাবো পূর্ণ বিশ্বস্ততার সঙ্গে! সবকিছু তোমাকে খুলে বলবো স্পষ্টভাষায়, কোন রাখ-ঢাক ও লোকোচুপি ছাড়া। কাফেলার অগ্রদূত, এটাই তো তার কাছে কাফেলার দাবী। এটাই তো তোমার সঙ্গে আমার হৃদয় ও আত্মার সম্পর্কের অধিকার! মিথ্যা পরিহার ও সত্যের প্রতি বিশ্বস্ততা! তোমার কাছে কিছু যদি লুকাই, তোমাকে যদি ভুল ধারণায় ভুলিয়ে রাখি লুকোছুপি বা অতিরঞ্জন দ্বারা, তাতে তো হতে পারে তাদেরই ক্ষতি, তাদেরই সর্বনাশ!!’

***

এমন নূরানিয়াতপূর্ণ সফরের সঙ্গীরূপে যে দু’জন উত্তম ব্যক্তিকে আল্লাহ আমার জন্য নির্বচান করেছিলেন তারা হলেন জনাব মুঈনুল্লাহ নাদাবী এবং আব্দুর-রাশীদ আ‘যামী নাদাবী। গতবছর থেকে তারা হিজাযের ভূমিতে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের দায়িত্ব ছিলো আরবের মানুষকে সেই দাওয়াত ও আমানতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া, যার জন্য বিশ্বের সকল জাতির মধ্য হতে আল্লাহ্ তাদের নির্বাচন করেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে আমার এ প্রিয়দু’জন হজ্বের মৌসুমে আরব ও মুসলিম জাহান থেকে আগত বিভিন্ন প্রতিনিধি-দলের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেখাসাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করেছেন। তাদের কথা শুনেছেন এবং নিজের কথা তাদের বলেছেন। শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে আরবী ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন দাওয়াতি পুস্তিকা বিতরণ করেছেন। উদ্দেশ্য ছিলো, মূল বিষয়ের দিকে তাদের চিন্তা ও মনোযোগ আকর্ষণ করা, তাদের মধ্যে দ্বীনী জাযবা ও চেতনা সৃষ্টি করা; সর্বোপরি বর্তমান পরিস্থিতির রূপ ও স্বরূপ এবং তার ক্ষতিকর দিকগুলো তাদের সামনে তুলে ধরা এবং ভবিষ্যতের দিক থেকে পরিণাম ও পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা। বলাবাহুল্য, শিক্ষিত মহলে চিন্তাসমৃদ্ধ দাওয়াতি পুস্তিকা একাজের জন্য খুবই উপযোগী। শোকরের বিষয়, আমার এ প্রিয় দু’জন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপেই আঞ্জাম দিয়েছেন। ফল  ও নতীজা তো আল্লাহর হাতে।আমার এ প্রিয় দু’জন আরো কিছু কাজ করেছেন। যেমন, দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে সম্পৃক্ত হিন্দুস্তানী-পাকিস্তানী ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, উৎসাহ ও উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য তাদের দাওয়াতি কাজ ও কর্মসূচীতে শরীক হওয়া, তাদের সঙ্গে নিয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্র-কবিলার বস্তি ও জনপদে গাশতের জন্য যাওয়া, বয়ান ও তাশকীলের মাধ্যমে আরবদের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া দাওয়াতি জাযবা ও চেতনা  এবং ত্যাগ ও কোরবানির উদ্দীপনা জাগ্রত করা এবং এই মেহনতে শরীক হওয়ার জন্য হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে তাদের উদ্বুদ্ধ করা।তো এই প্রিয় দু’জন হেজায-ভূমিতে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এখন আমার সঙ্গী হয়েছেন মিশরের এই দাওয়াতি সফরে। আমার সঙ্গেই তারা ফিরে যাবেন হিন্দুস্তানে। এদিক থেকে তাদের সফর ছিলো আমার চেয়ে দীর্ঘ ও ধৈর্যক্ষয়ী। আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।

***

শনিবার সকালেই আমরা মিশরীয় পার্লামেন্টের মাননীয় সদস্য জনাব জালাল হোসাইনকে তারবার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের মিশরে আসার খবর। কয়েকদিন আগে তাঁর কাছ থেকে আমার নামে যে পত্র এসেছে তাতে তিনি আমার মিশর-সফরের পরিকল্পনায়  সন্তোষ প্রকাশ করে ‘খোশ-আমদেদ’ জানিয়েছিলেন। ঐ পত্র থেকেই জেনেছি, এক সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি লন্ডন যাচ্ছেন এবং দ্রুতই ফিরে আসছেন। তবে তাঁর ব্যক্তিগত সচীব হোসনী ছক্রকে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন যাবতীয় বিষয়ে আমাদের ‘দেখভাল’ করার। 

***

এখানে বলে রাখা ভালো, জিদ্দাবন্দরে আমাদের বিদায় জানাতে এসেছিলেন সুপ্রিয় আব্দুল্লাহ আব্বাস নাদাবী, সৈয়দ রিযওয়ান আলী নাদাবী, সৈয়দ মুহাম্মাদ তাহির এবং আমার ভাগিনা মুহাম্মদ রাবে’ নাদাবী। মুহাম্মদ রাবে’ হিজাযে আরো দু’বছর অবস্থান করবেন। প্রধান উদ্দেশ্য হলো দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত করা, আরবী ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করা এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিচয়ের মাধ্যমে তাদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া; তাদের মধ্যে কিছু দ্বীনী দাওয়াতের কাজ করা।স্নেহাস্পদ মুহাম্মদ রাবে’-এর কথা এ সফরে আমার বরাবর মনে পড়বে; মনে পড়তে থাকবে। কারণ সে হলো সফরে হযরে আমার নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গী ও সেবক, সর্বোপরি আমার ইলমী কাজ ও গবেষণাকর্মে অত্যন্ত কার্যকর সাহায্যকারী।আল্লাহ করুন, প্রিয়জনদের সবার সঙ্গে আবার যেন মিলন ঘটে পবিত্রতম ভূমিতে, পবিত্রতম সময়ে, সৌভাগ্যের পরম লগ্নে।

***

রোববার/১৩-৪-৭০ হি./২১-১-৫১ খৃ.

কোথা সেই বেলালী আযানের ধ্বনি!!

রাত বড় শান্তিতে পার হলো এবং প্রশান্তির ঘুম হলো, যদিও সারা রাত প্রচ- ঝড়ো হাওয়া বয়েছে। ভোরে শরীরে ও অন্তরে নিজেকে বেশ সজীব, সতেজ ও প্রফুল্ল মনে হলো। জনৈক মিশরীয় দ্বীনী ভাই ফজরের আযান দিলেন। এটাই ছিলো আজকের ভোরে পানির জাহাযে এবং শান্ত নীরব সাগরের বুকে সত্যের একমাত্র কণ্ঠ, হকের একামাত্র আওয়ায!! জাহাযে ও সাগরে এ আওয়ায ধ্বনিত হলো, তবে তেমন করে প্রতিধ্বনিত হলো না! অথচ এটা ছিলো সেই আওয়ায যা একসময় সারা বিশ্বে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যা সারা বিশ্বকে খাবে গাফলত থেকে জাগ্রত করেছে, যা জলে স্থলে একসময় হালচাল পয়দা করেছে এবং জীবনের বার্তা-বহনকারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ‘কিন্তু আজ, কোথা রাখি লাজ’! সাগরের বুকে পানির জাহাযে সামান্য যে ক’জন মুসলিম যাত্রী, আযান তাদের সাবইকে জাগাতে এবং এক জামাতে একত্র করতে ব্যর্থ হলো!দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পানির জাহাযে আজকের এই ভোরের আযান প্রমাণ করে দিলো, হৃদয় ও আত্মার উপর আযানের অতীতের সেই প্রভাব ও প্রতাপ, সেই তাপ ও উত্তাপ কী মর্মান্তিকভাবে হারিয়ে গিয়েছে! শব্দগুলো তো রয়ে গেছে একই রকম, কিন্তু সেই প্রাণ ও প্রাণশক্তি!! মুআয্যিনের কণ্ঠ আছে এবং আছে কণ্ঠস্বর, কিন্তু সেই আবেদন ও নিবেদন! সেই আকর্ষণ ও চৌম্বকতা!! প্রাণহীন আযান সম্পর্কে মাশরিকের কবি আল্লামা ইকবালের সেই অশ্রুসজল কবিতাপংক্তি বারবার মনে পড়লো, আর মনের ভিতরে অব্যক্ত এক বেদনা সৃষ্টি করলো, ‘র‌্যহ গায়ী র‌্যসমে আযাঁ, রূহে বিলালী না র‌্যহী!- রসমে আযান তো রয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তার বিলালী রূহ ও প্রাণ!!মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে আযানের এই যে ‘প্রাণবিপর্যয়’, এর জন্য প্রধানত দায়ী পশ্চিমা বস্তুবাদের অব্যাহত প্রভাব। বস্তুবাদ বিশ্বাস করে, জীবনের সফলতা ও সার্থকতা নামাযের মধ্যে নয়, দ্বীন ও ইবাদাতের মধ্যে নয়, অন্যকোথাও! বস্তুবাদ তার অনুসারীকে এ বিশ্বাস গ্রহণে বাধ্য করে যে, ফজরের ছালাতের চেয়ে ভোরের ঘুম অনেক আরামের, অনেক স্বাদ ও শান্তির!! তাই তো মুআয্যিন কত মধুর কণ্ঠে উচ্চারণ করে-الصلاة خير من النوم ঘুম হইতে ছালাত উত্তম!অথচ পুরো মুসলিম জনপদে খুব কম মানুষেরই তাতে ঘুম ভাঙ্গে! ঘুম থেকে জেগে উঠে খুব কম মানুষেরই মনে আফসোস জাগে!!যাই হোক, জাহাযে কিছু মানুষের ঘুম ভাঙ্গলো, আল্লাহ যাদের জন্য কল্যাণের ইচ্ছা করেছেন এবং আল্লাহ যাদের তাওফীক দান করেছেন। আমরা সবাই জামাতের কাতারে দাঁড়ালাম এবং সাগরের বুকে ভোরের প্রশান্তিপূর্ণ পরিবেশে ফজরের ছালাত আদায় করলাম। মনের মধ্যে আনন্দ ও বিষাদের মিশ্র অনুভূতি অনেক্ষণ ধরেই বিরাজ করলো। ফজরের ছালাতে শরীক হতে পারার আনন্দ, আর চোখের সামনে  আযানের প্রাণহীনতার দৃশ্য দেখতে পাওয়ার বিষাদ, বেদনা!!নামাযের পর জাহাযের এমন স্থানে গিয়ে বসলাম যেখান থেকে ভোরের সাগর এবং সাগরের বুকে ভোরের সূর্যোদয়ের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। অবলোকন করলাম। ভিতরের সর্বসত্তা তখন যেন স্বতঃস্ফূর্ত-ভাবে বলে উঠলো, ‘সুবহানাল্লাহ্!’ ‘সুবাহন তেরা জামাল! সুবাহন তেরী কুদরত!!সাগর তখন বেশ শান্ত স্থির। জাহাযে তেমন কোন দোলা নেই, যা যাত্রীর অস্বস্তির কারণ হয়। অথচ আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, উস্তায আব্দুল গফূর আত্তার এবং মানহাল-সম্পাদক উস্তায আব্দুল কুদ্দূস-এর সাগরপথে মিশরভ্রমণের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার বিবরণ পড়ে। সাগরের প্রচণ্ড বিক্ষোভ এবং জাহাযের মারাত্মক দোলার কারণে তারা এত কষ্টে ছিলেন যে, কয়েকদিন নড়াচড়াই করতে পারেননি। কিছু মুখে দেয়াও ছিলো অসম্ভব, এমনই ছিলো মাথার চক্কর!!আমারও হজ্বের দুই সফরের অভিজ্ঞতা কম ভীতিকর ছিলো না, বরং বলা যায়, তাদের চেয়ে একটু বেশী মাত্রায়ই ছিলো। লাগাতার সাতদিন না কিছু খাওয়ার চাহিদা হয়েছে, না কিছু মুখে দেয়ার সাহস হয়েছে। খুব বেশী হলে কিছু টক ফল বা আচার এবং ঐ জাতীয় কিছু পানীয়।কিন্তু এই সফরে আল্লাহ আমাদের প্রতি অনেক দয়া ও অনুগ্রহ করছেন। এখন পর্যন্ত এধরনের কোন কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়নি। সামনের জন্য আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও স্বস্তি এবং সুস্থতা ও সালামাত আশা করি।আমাদের ইতালীয় জাহায ‘আওন্ডা’ মূলত যাত্রীবাহী নয়, পণ্যবাহী। জিদ্দা-সুয়েজে চলাচলকারী অধিকাংশ জাহাযই এরকম। আমাদের জাহাযে বেশীর ভাগ ছিলো কাঠজাতীয় নির্মাণসামগ্রী এবং নারিকেল, যা কলম্বো ও ভারতসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে বোঝাই করে আনা হয়েছে এবং পথে বিভিন্ন বন্দরে খালাস করা হচ্ছে। জাহাযটি জিদ্দা থেকে পঞ্চাশজন যাত্রী নিয়েছে, যাদের গন্তব্য সুয়েজ। অধিকাংশ যাত্রী মিশর ও হিজাযের। ছয়জন ভারত-পাকিস্তানের, জাহাযে যাদের পরিচয় হলো ‘হিন্দী’! সুদান ও তাকরানের আছে এক দু’জন! মাত্র পঞ্চাশজন যাত্রীর অল্প পরিসরের এই যে দু’দিনের ‘সাগরপরিবার’ এ সম্পর্কে আমার অনুভব অনুভূতি, সুযোগ হলে সামনে বলার ইচ্ছা আছে। কারণ এতেও আমাদের বৃহৎ পরিসরের যে জীবন, তার ছায়াপাত রয়েছে এবং রয়েছে শিক্ষার যথেষ্ট খোরাক।

শামী নওজোয়ান ও তার দ্বীনী চেতনা

একজন শামী যুবকের সঙ্গে দেখা ও পরিচয় হলো এবং কিছু কথা হলো। তার বাবা জিদ্দায় ব্যবসা করেন। যুবক ইতিমধ্যে ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছেন। বয়সের তুলনায় তাকে মনে হলো উম্মাহ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। দিলের মধ্যে দরদ ও অস্থিরতা রয়েছে। আচার-আচরণে অভিজাত ও ব্যবহারে ভদ্র। প্রথম দেখায় পছন্দ হয় এবং মনোযোগ আকৃষ্ট হয়, এমন। তাকে আমার দু’টি দাওয়াতি পুস্তিকা দিলাম। একটি হলো ‘ছুরত ও হাকীকতের পার্থক্য’ দ্বিতীয়টি হলো, ‘এ উম্মাহ হিদায়াতের জন্য, রাজস্ব উশূলের জন্য নয়’।যুবক বই দু’টি সাদরে গ্রহণ করলেন। মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করে পরবর্তী সাক্ষাতে জানালেন, ‘তার ভালো লেগেছে, আবেগে আন্দোলন হয়েছে এবং চেতনায় আঘাত লেগেছে। যুবকদের জন্য এরূপ বক্তব্যের প্রয়োজন রয়েছে।’আরববিশ্বে বস্তু ও বস্তুবাদের আগ্রাসনের বিষয়ে যুবক খুবই ক্ষুব্ধ! একসময়ের শান্তিপূর্ণ ও আদর্শিক শক্তিতে বলীয়ান এই জনপদগুলোর বর্তমান যে ব্যাপক নৈতিক অবক্ষয়, সেজন্য তার ভিতরে রয়েছে প্রবল অস্থিরতা। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না, এর প্রতিরোধের পথ ও পন্থা কী?শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুবকের সবকিছু আমার ভালো লাগলো। মনে হলো, উম্মতের আশার প্রদীপ এরাই এখনো ধরে রেখেছে। এই যুবকের সঙ্গে হয়ত আর কখনো দেখা হবে না! মুসলিম জাহানের যেখানে যত এরকম নওজোয়ান রয়েছে আল্লাহ তাদের হেফাযত করুন। আমীন।***প্রতিওয়াক্তের ছালাতই জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয়েছে। এ তাওফীকের জন্য আল্লাহর শোকর। জামাতে হাজিরান মুছল্লীর অধিকাংশই মিশরীয়। নামাযের প্রতি যত্ন ও ইহতিমাম এবং নিষ্ঠা ও নিয়মিতি, এ ক্ষেত্রে এই স্বল্প পরিসরেও দেখা গেলো, মিশরীয় ভাইয়েরাই অনেক এগিয়ে। অথচ তাদের অধিকাংশ সাধারণ শ্রমিক, যারা হিজাযে রিযিক ও জীবিকার বিনিময়ে শ্রম দেয়। এখন তারা হয়ত ছুটিতে নিজের দেশে, মিশরে যাচ্ছে। প্রাণবন্ততা, চরিত্রের কোমলতা, আচরণের স্নিগ্ধতা, ইলম ও আহলে ইলম এবং দ্বীন ও আহলে দ্বীনের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা অন্যদের চেয়ে তাদের মধ্যেই মনে হলো, বেশী পেয়েছি।বিকালে আবহাওয়ায় কিছুটা পরিবর্তন অনুভূত হলো। সম্ভবত শীত-অঞ্চলের নিকটবর্তী হচ্ছি। হয়ত আগামীকাল শীতের সম্মুখীন হতে হবে।

সোমবার/১৪-৪-৭০ হি./২২-১-৫১

খৃ.আজকের সকালটাও আল্লাহর রহমতে খুব সুন্দর যাপিত হলো। শরীরে মনে সতেজতা ও সজীবতার অনুভূতি ছিলো। জামাতের সঙ্গে ছালাতুল ফজর আদায় করলাম। তারপর জাহাযের ডেকে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। সাগর তখন এত শান্ত, এত নিরীহ ছিলো যে, পায়চারি করতে কোন রকম অস্বস্তিকর দোলা সামান্য পরিমাণেও অনুভব করিনি। যেন আমরা স্থলে স্বাভাবিকভাবে পায়চারি করছি।পায়চারির পর নাস্তা ও চাপর্ব সম্পন্ন হলো। সামান্য নাস্তা ও এককাপ ধূমায়িত চা, তখন মনে হলো অনেক বড় নেয়ামত!!

জাহাযের দু’দিনের জীবন! 

জাহাযের স্বল্প পরিসরে এই যে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একত্রসমাবেশ, যেখানে কোন আড়াল নেই, সবকিছু সবার চোখের সামনে খোলা, কী দেখলাম, কী অনুভব করলাম?!নারিদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত বেপরোয়াপনা; শরীয়তের পর্দা তো দূরে, সতর ও হায়া শরমেরও যেন অভাব! সববিষয়ে তাদের আলাপচারিতা কানে আসছে। কথায় অসংযম, অভিব্যক্তিতে অসংযম, হাসির শব্দে অসংযম। সবকিছুতেই একটা বেদনাদায়ক অসংযম! যেন তারা ঘরের পরিবেশে খোলামেলা কথা বলছে!! সতরহীনতা অনেক সময় নগ্নতার পর্যায়ে চলে যেতে দেখেছি, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যা কল্পনা করাও সম্ভব ছিলো না।আর পুরুষরা তো ছিলো পুরুষদের মতই। চারপাশের কারো প্রতি এবং কোনকিছুর প্রতি যেন তাদের আগ্রহ নেই। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ এবং এই দাবীতে পরস্পর পরিচিত হওয়ার আগ্রহ, কিংবা দু’দিনের প্রতিবেশিতার প্রতি ন্যূনতম সম্মান, অন্তত সামাজিক সৌজন্য রক্ষার ইচ্ছা, কিছুই তাদের মধ্যে নেই। পরিষ্কার বোঝা যায়, আরবদেশ বলি, বা মুসলিম দেশ, আমাদের ইসলামী জনপদে ইসলামী জীবন ও জীবনাচার বড়ই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। তার স্থান দখল করে নিয়েছে উদরচিন্তা, স্বার্থপরতা এবং ‘ইয়া নাফসী’ প্রবণতা। খুব বেশী হলে মানুষের ভাবনা এখন নিজের সন্তানসন্ততি ও পরিবার-পরিজন পর্যন্ত আর্বতিত হয়। এর বাইরে  যেন আর কেউ নেই, আর কিছু নেই! আমাদের দেশে অত্যন্ত নৈকট্য, জীবনের সুখ-দুঃখে একাত্মতা, এগুলো বোঝাতে গিয়ে বলা হয়,  ‘আমরা তো একই কিশতির যাত্রী!’ কিন্তু এখানে একই জাহাযের যাত্রী হয়েও মনে হচ্ছে আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন কিশতির মুসাফির!আমাদের এক সফরসঙ্গী কাছে বসে থাকা একযাত্রীকে আমার কিছু দাওয়াতি পুস্তিকা হাদিয়া দিলেন। তখন আলগ-থালগ বসে থাকা মানুষটি আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এলেন, বললেন, আমি তো মক্কায় আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আপনার একদু’টি মজলিসেও বসার সুযোগ হয়েছে।এভাবে তিনি আমাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হলেন এবং আজনবিয়াতের পর্দা উঠলো। কিন্তু শুধু ‘আমার মুসলিম ভাই’ এ পরিচয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো না। আমরা নিজেরা যদ্দুর এগিয়েছি তদ্দুরই।

***

সারাদিন আমাদের চোখের সামনে ছিলো আফ্রীকা মহাদেশের পর্বতমালা। তা দেখে দেখেই সাগরযাত্রার একঘেয়েমি দূর করলাম। দেখতেও বেশ আনন্দ হচ্ছিলো। জাহাযের অভিমুখ যখন সুয়েজের দিকে হতো তখন এদিকেও শেষহীন পবর্তশ্রেণী দেখা যেতো। তাতে একটু রোমাঞ্চও অনুভব করছিলাম একথা ভেবে যে, হয়ত এরই মধ্যে কোথাও আছে তূরপাহাড়! এলাকা সম্পর্কে জানে, এমন কেউ সেখানে ছিলো না যে, জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবো। এতে অবশ্য আনন্দের অনুভূতি আরো ব্যাপ্ত হলো। কারণ প্রতিটি পাহাড়ই তো হতে পারে সিনাই-এর তূর পাহাড়!! ধীরে ধীরে সুয়েজের দু’পাড়ের দূরত্ব কমে আসতে লাগলো। একসময় উভয় তীর একসঙ্গে আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো। নিকট দিয়ে ছোট ছোট কিশতি এমভাবে ছুটে যাচ্ছিলো যেন, স্থলে সড়কে গাড়ীগুলো দৌড়ে যায়! ভাবতে বড় কষ্ট হলো যে, সুয়েজ মিশরের হয়েও এখন মিশরের নয়!!

মিশরের প্রতি দিলের এত টান, কেন?!

আমাদের ধারণা ছিলো, ভোরে সুয়েজবন্দরে পৌঁছে যাবো। তাই সারা রাত মনের অবস্থা ছিলো এমন যে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ জীবনে সফর তো কম হলো না! তারপরো আজকের সফরের জন্য মনের ভিতরে এমন আনন্দ, এমন উচ্ছ্বাস!! শৈশবের আনন্দ এবং জীবনের প্রথম সফরগুলোর উত্তাপ যেন আজ এত বছর পর আবার অনুভূত হলো!আমার চিন্তায় চেতনায়, আমার অন্তরের আঙ্গিনায় মিশর ছিলো সেই প্রিয় ভূমি, যার সঙ্গে শৈশব থেকেই রয়েছে পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা।আসলে এটাই ছিলো স্বাভাবিক। কারণ সেই দূর শৈশবেই মিশর সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানা হয়েছিলো এবং অনেক কিছু পড়া হয়েছিলো। মিশরের মাটি ও মানুষ সম্পর্কে, নীল ও  তার জনপদ সম্পর্কে, মিশর-বিজেতা আমর ইবনুল আছ রা. সম্পর্কে, তারপর সমকালের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনেক নিকট থেকে আমার জানাশোনা ছিলো, যেন সবকিছু চোখের সামনে; চোখ বন্ধ করে সবই যেন দেখতে পাই। মিশর থেকে প্রকাশিত বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা যে বয়সে চিনেছি এবং পড়েছি, অন্যদের পক্ষে তা  কল্পনা করাও সম্ভব ছিলো না। অত্যুক্তি হবে না যদি বলি, আমার আরবীভাষা ও সাহিত্যের যা কিছু অর্জন তা মিশরেরই অনুগ্রহ ও সৌজন্যে। এখানে এমন সাহিত্যিক আছেন এবং আছেন এমন চিন্তাবিদ ও উন্নত গবেষণাসাময়িকীর সম্পাদক যাদের লেখা ও রচনাশৈলী আমার কলমের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। সাহিত্যচর্চায় দীর্ঘ দিন তাদের অনুকরণেরও চেষ্টা করেছি। মিশরের যাবতীয় আরবী প্রকাশনার সঙ্গে আমার তেমনি সম্পর্ক ছিলো যেমন হতে পারে মিশরের বাইরে থাকা কোন মিশরীয় গবেষকের। চিন্তার ভিন্নতা এবং বিশ্বাসের বৈপরীত্য সত্ত্বেও মিশরের উচ্চস্তরের সকল সাময়িকপত্র ও গবেষণাসমায়িকী আমার নিয়মিত অধ্যয়নে ছিলো। মিশরের প্রকাশনাজগতে দ্বীন, ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, যে কোন বিষয়ে যখন যা কিছু প্রকাশিত হয়, গ্রহণ করি বা প্রত্যাখ্যান, আমার দৃষ্টিপথে অবশ্যই তা আসে। মিশরের কলমসেবী, সাহিত্য-সমাজ ও গবেষক-সাংবাদিকদের স্তর ও শ্রেণীমর্যাদা সম্পর্কে আমি পূর্ণ অবগত ছিলাম, যেমন অবগত ছিলাম নিজ দেশের লেখক, গবেষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকসমাজের বিষয়ে। এত সবের পর মিশরের প্রতি যদি আমার কোন ‘দুর্বলতা’ থাকে এবং থাকে মনের টান; মিশরের এত কাছে আসার পর অন্তরে যদি সৃষ্টি হয় আবেগের উচ্ছ্বাস, অবাক হওয়ার কী আছে!

মঙ্গলবার/১৫-৪-৭০ হি./২৩-১-৫১ খৃ.

মিশরের উপকূলে

ভোরের আলো এবং সুয়েজের জনবসতি একসঙ্গে উদিত হলো। দু’টোর জন্যই আমাদের ইনতিযার ও ব্যাকুল প্রতীক্ষা ছিলো। আসলে আমার তখনকার রোমাঞ্চ-অনুভূতি সত্যি অন্যরকম ছিলো। যেন বিশ্বাস হতে চায় না যে, নিজের চোখে আমি মিশর-ভূমি দেখতে পাচ্ছি! আমার স্বপ্নের মিশরভূমি!!জাহায নোঙ্গর করলো। তীর থেকে বেশ কিছু মোটরলঞ্চ জাহাযের গায়ে এসে ভিড়লো। তাতে সরকারী পোশাকের কিছু মানুষ ছিলো। মাথায় সুন্দর লাল তুর্কী টুপি, যার সঙ্গে দেশেই আমাদের পরিচয় ছিলো। হিন্দুস্তানের শরীফ লোকেরা আভিজাত্যের প্রতীকরূপে এবং তুর্কীদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশরূপে তুর্কী টুপি ব্যবহার করে থাকেন। তাদের কেউ কেউ আমাদের সালাম করলো; খোশ আমদেদ জানালো। তখন একটি ইসলামী দেশ এবং অনৈসলামী দেশের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আমাদের অনুভবে এলো। যার জন্ম হয়েছে এবং চক্ষু উন্মিলিত হয়েছে কোন ইসলামী দেশে, যার প্রতিপালন ও বৃদ্ধি ঘটেছে কোন মুসলিম জনপদে, এমন মুসলিম এ পার্থক্য কিছুতেই অনুভব করতে পারবে না।জাহাযের আইনি কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা সামানপত্র নিয়ে ডাঙ্গায় উঠে এলাম। তখনো আমাদের কোন ধারণাই ছিলো না, সামনে তদন্ত, তল্লাশি ও আইনগত ভোগান্তির  কী কী স্তর পার হতে হয়। অবশ্য বাইরে থেকে আসা যে কোন মানুষের জন্যই এ অবস্থার মুখোমুখি হওয়া অনিবার্য বিষয়। তবু কষ্ট তো কষ্টই!!এর মধ্যে হঠাৎ গ্রহণযোগ্য চেহারার একজন ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন এবং অনুগ্রহবশত গাইডরূপে নিজের স্বেচ্ছাসেবা পেশ করলেন। আমরা তার সৌজন্য-পূর্ণ আচরণে অভিভূত হলাম এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তার সেবা গ্রহণ করলাম। তিনি আমাদের পুলিশদফতরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের সাক্ষাৎ এমন একজনের সঙ্গে হলো, যার চেহারা ছূরত, পোশাক ও অভিব্যক্তি বলছে, তিনি কোন দায়িত্বশীল পদস্থ অফিসার। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। নাম শুনে বললেন, ‘কায়রো থেকে মিস্টার জালাল তার পাঠিয়েছেন, যেন সুয়েজে আমি আপনাকে স্বাগত জানাই এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করি।’ এ সময় এরকম আচরণ সত্যি বড় শান্তিদায়ক হয়! আমাদেরও অত্যন্ত স্বস্তি ও শান্তি হলো।ভদ্রলোক পদস্থ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করলেন। ফলে খুব সহজেই আমরা ঝামেলার স্তরগুলো পার হয়ে গেলাম।যিনি গাইড হয়েছিলেন তিনি সামানপত্র ওঠানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহায্য করলেন এবং কায়রোয় মারূফ সড়কে অবস্থিত মিস্টার জালালের দফতরে পৌঁছার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। গাড়ী ঠিক করে চালককে সব বুঝিয়ে দিলেন। রওয়ানা হওয়ার সময় আমরা তাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম এবং উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ তার হাতে দিলাম। কিছুটা সৌজন্য প্রদর্শন করে তিনি তা গ্রহণ করলেন।

***

সুয়েজ থেকে কায়রোর পথে

গাড়ী তখন পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে। পথটি ছিলো ঊষর মরুভূমির মধ্য দিয়ে। পথে কোন আবাদি ও জনবসতি ছিলো না। ছিলো না সবুজেরও কোন চিহ্ন। কিছু দূর পথ অতিক্রম করার পর চালক নিজে থেকেই বললেন, আমরা এখানে যোহর আদায় করবো।বড় ভালো লাগলো চালকের সৌজন্যপূর্ণ ও ধার্মিক আচরণ! এখানে আমাকে বলতেই হবে, মিশরীয় এই চালক সারা পথে যে উত্তম চরিত্র, মিষ্টিভাষিতা ও ধর্মপরায়ণতার পরিচয় দিয়েছেন তা ভারতীয় চালকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো, যারা মন্দকথন ও মন্দ আচরণের ক্ষেত্রে প্রায় প্রবাদখ্যাতি অর্জন করে রেখেছে। হিন্দুস্তানী চালকদের মধ্যে এমনকি নামাযের প্রতি গুরুত্ব, নিজের বা যাত্রীর, খুব কমই দেখা যায়, বরং দেখাই যায় না।এই মিশরীয় চালকের মধ্যে যে- সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য আমার নযরে এসেছে  তা কী মিশরের গাড়িচালকসমাজের সাধারণ চিত্র, না শুধু এই চালকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তার সঠিক ধারণা তো হবে আরো অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে। সুতরাং এখনই সিদ্ধান্তমূলক কিছু বলা সম্ভব নয়। এখানে শুধু ‘যা দেখেছি’ বলে রাখা হলো।নামাযের পর আবার যাত্রা; গাড়ী আবার ছুটে চললো কায়রোর উদ্দেশ্যে আগের গতিতে।কিছুক্ষণ পর আমরা মিশরের একটি সেনাছাউনী অতিক্রম করলাম। এটা ছিলো আমার জীবনে প্রথম দেখা কোন মুসলিম দেশের সেনাছাউনী! বিশেষ কারণ ছাড়াই অতীতের সোনালী দিনগুলোর ছবি যেন আমার কল্পনায় ভেসে উঠলো। ফুছতাতের ফৌজি তাঁবু ও সেনাছাউনী, যা আমর ইবনুল আছ রা. স্থাপন করেছিলেন, কেমন ছিলো! হায়, কী দিন ছিলো, আর কী দিন এখন আমাদের সামনে!!সেনাছাউনী দেখে অন্তরে অন্যরকম এক খুশি ও আনন্দ অনুভূত হলো। নিজের অজান্তেই যেন ছাউনীর বাসিন্দাদের জন্য আমার মুখে দু‘আ জারি হয়ে গেলো, ‘এ যুগের ফৌজ যেন সে যুগের মুজাহিদীনের জিহাদী জাযবা ও শহীদী চেতনা নিয়ে দুশমনের সামনে দাঁড়াতে পারে।’***গাড়ী যখন নতুন মিশরে প্রবেশ করলো, মনে হলো ইউরোপের কোন বড় শহরে চলে এসেছি। এখানে ওখানে একটা দু’টো প্রাচ্যসভ্যতা ও সংস্কৃতির ছাপ চোখে পড়ে, তাতেও পাশ্চাত্যের প্রভাব। এছাড়া ছোট থেকে বড় সবকিছু যেন পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই প্রতিনিধি।আমরা কায়রোর আরো গভীরে যেতে থাকলাম, যা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, যার জনসংখ্যা বলা হয়, বিশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।আমরা মা‘রূফ সড়কে মিস্টার জালাল বেগ এর দফতরে পৌঁছলাম। ভিতরের সবকিছু বড়ই শানদার! জালাল বেগ-এর ব্যক্তিগত সচীব উস্তায হোসনী ছক্র আমাদের ইস্তিকবাল করে আহলান ওয়া সাহলান জানালেন। তার কাছ থেকে জানা গেলো, মুহতারাম জালাল হোসাইন সুয়েজের জেলা-প্রশাসক এবং সুয়েজ স্কুলের প্রিন্সিপালকে তার করেছিলেন, যেন আমাদের ইস্তিকবাল ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। কোন মুসাফির নতুন জনপদে প্রবেশ করার পর কেউ যদি যে কোন সূত্রে একটু যত্ন ও সমাদর প্রকাশ করে, ভালো লাগে। এই ভালো লাগা এবং অন্তরের এরূপ চাহিদা মন্দ কিছু নয়; মানুষের স্বভাবের মধ্যেই তা গচ্ছিত রয়েছে। উস্তায হোসনী ছক্র জালাল বেগকে ফোনে আমাদের আসার খবর দিলেন। তিনিও ফোনে আমাকে খোশামদেদ জানিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং কোন ঘনিষ্ঠজনের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে ইস্তিকবালের জন্য আসতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করলেন।আমি তাঁর বয়স ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁর শায়ানে শান উত্তর দিলাম। এই অনুপম সৌজন্য, আন্তরিকতা ও মহত্ত্বের জন্য আমি তাঁর শোকর আদায় করলাম।তিনি বললেন, ‘আমি এখনই আপনার সান্নিধ্যে আসছি।’জনাব হোসনী ছক্র জানালেন, মুহতারাম জালাল বেগ ‘জামঈয়্যাতে মাকারিমুল আখলাক (মহৎচরিত্রসংস্থা)-এর দফতরে আমাদের জন্য দু’টো কামরার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। উক্ত সংস্থার সেক্রেটারী শায়খ আহমদ উছমান আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছেন।তিনি এলেন এবং উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে সালাম, পরিচয় ও কুশল বিনিময় করলেন।এর মধ্যে জালাল বেগ তাঁর সেক্রেটারীকে ফোনে জানালেন, তাৎক্ষণিক কোন জরুরি ব্যস্ততার কারণে এখনই তিনি আসতে পারছেন না, এজন্য অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর সচীব মহোদয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন আপাতত মহল্লা হোসায়ন-এর কোন হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।হোটেলকর্তৃপক্ষ কোন বিদেশীকে কামরা দিতে এজন্য রাজী হলো  না যে, তাদের ভিসা-পাসপোর্টে সমস্যা থাকে, যার জন্য হোটেলম্যানেজমেন্টকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।সেখান থেকে আমাদের নেয়া হলো আলআতাবুল খাযরা অঞ্চলের হোটেল মিশর-এ। সেখানেও একই সমস্যার কথা একই আন্দাযে বলা হলো। দু’ দু’টি পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতার কারণে আমার অন্তরে পরদেশী হওয়ার অনুভূতি প্রবলভাবে জাগ্রত হলো। আসলে চলাচল ও  যোগাযোগের ব্যবস্থা যত উন্নত হয়েছে, প্রতিকূলতা ও জটিলতা ততই বেড়ে গিয়েছে। সফর প্রকৃতপক্ষে আগের চেয়ে অনেক কঠিন ও কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে।একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, হোটেলকর্তৃপক্ষের বক্র আচরণ এবং আইনি জটিলতার কথা উত্থাপনের আন্দায আমার বিলকুল ভালো লাগেনি, বরং অন্তরে খুব বেশী অপ্রীতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এবং লাঞ্ছনার অনুভূতি বড় বেশী বিঁধেছে, যদিও তখন তা প্রকাশ করা সঙ্গত মনে হয়নি। তবে শায়খ আহমদ উছমান ছাহেবকে ছাফ বললাম, এখন আমরা কোন মূল্যেই হোটেলে থাকা পছন্দ করবো না, যে কোন সাধারণ থেকে সাধারণ স্থানে থাকতেও আমাদের কোন অসুবিধা হবে না, আপত্তি তো হবেই না।শায়খ আহমদ উছমান কিছুতেই রাজী হলেন না, বরং আমাদের আলআতাবা অঞ্চলেরই একটি হোটেল ‘ফুন্দুকুল বারলামান’-এর নিয়ে গেলেন।এখানে সাধারণ কিছু কথাবার্তার পর হোটেলকর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত হয়ে আমাদের হোটেলে কামরা দিতে সহজেই রাজী হয়ে গেলো। এমনই তো হওয়ার কথা! অর্থহীন ও সৌজন্যহীন আচরণের কী প্রয়োজন?! আসলে আখলাক ও সৌজন্য সবার মধ্যে থাকে না। সেটা মেনে নিয়েই জীবনের গাড়ীতে সফর করতে হয়!আমরা প্রথম তলার একটি কামরায় উঠলাম এবং কিছুটা বিলম্বে মাগরিব আদায় করলাম।নামাযের পর শায়খ আহমদ উছমানের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো। তিনি আমার সামনে الجماعة الشرعية এর পরিচয় তুলে ধরতে চাইলেন।আমি বললাম, এ সংস্থার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। এমনকি সংস্থার কোন কোন কর্মকর্তার সঙ্গে হজ্বের সময় দেখাসাক্ষাৎও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি আমার বিশিষ্ট বন্ধু আলহাজ আলী শারীফ এর নাম উল্লেখ করলাম। শায়খ উছমান কিছুটা যেন অবাক হলেন। তারপর বললেন, তাহলে আলী শরীফকে আপনার আগমনের কথা বলি; হয়ত এখনই তিনি চলে আসবেন। খবর পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি এলেন এবং উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। দীর্ঘ তিনবছর পর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ, কিন্তু আচরণের উষ্ণতা ও আন্তরিকতায় সেটা বোঝার উপায় ছিলো না।মদীনায় তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় কীভাবে হয়েছিলো! কীভাবে মদীনার সুন্দর দিনগুলো আমরা একসঙ্গে যাপন করেছি! বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা করেছি, সব স্মৃতি যেন একসঙ্গে মনের মধ্যে ভিড় করলো। দু’জনেই আমরা স্মৃতি থেকে বহু কথা বললাম। দীর্ঘতার আশঙ্কায় সে আলোচনা এখানে উল্লেখ করছি না। ‘আগামীকাল বাদ যোহর দেখা হবে’, বলে তিনি চলে গেলেন।

বুধবার/১২-৪-৭০ হি./২৪-১-৫১ খৃ

নাশতা ও চাপর্বের পর আমরা মুহতারাম জালাল বেগ-এর দফতরে গিয়ে ব্যক্তিগত সচীবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর জালাল বেগ এলেন এবং উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গেই আমাদের গ্রহণ করলেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘আমি আসতে না পারলেও অব্যাহতভাবে আপনার খোঁজ-খবর রেখেছি। আপনার সঙ্গে হোটেলকর্তৃপক্ষের অপ্রীতিকর আচরণে আমি মর্মাহত হয়েছি এবং যথাযথ নোটিশ নিয়েছি।’তিনি আরো বললেন, যেহেতু আজ দুপুরের দস্তরখান আলহাজ আলী শারীফের গৃহে হওয়ার কথা সেহেতু ইনশাআল্লাহ আগামীকাল ঐ জায়গাটা আপনি দেখবেন যা আপনার জন্য নির্ধারণ করেছি। পছন্দ হলে ভালো। নচেৎ অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।আমি বললাম, ‘কোন প্রয়োজন নেই। আপনার ব্যবস্থা না দেখেই আমি পছন্দ করে নিচ্ছি।’আমি কিছু ভারতীয় মুদ্রা তাঁর হাতে দিলাম ‘পরিবর্তনের’ জন্য। তারপর তাঁর অনুমতি নিয়ে বের হলাম। আমাদের গন্তব্য ছিলো শিবরায় অবস্থিত আলহাজ আলী শারীফের বাসস্থান। সেখানে যোহর আদায় করে ঐ স্থানে গেলাম যেখানে তিনি ‘নতুন গৃহের নির্মাণতদারকি’তে ব্যস্ত ছিলেন। তার সঙ্গে দুপুরের দস্তরখানে শরীক হলাম এবং আছর পড়ে ফিরে এলাম। তার দস্তরখানের অনাড়ম্বরতা আমার খুব ভালো লাগলো, যা এখনকার তাকাল্লুফাতের যামানায় প্রায় দুর্লভ।

***

আমাদের অবস্থানস্থলে কিছু ‘ভিজিটিং কার্ড’ পেলাম। জানা গেলো, হিজাযে দাওয়াত ও তাবলীগের যিম্মাদার মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বালয়াবী দুই সপ্তাহ পূর্বে সঙ্গীদেরসহ সুদানের সফর থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তিনবার এসেছেন। তার সঙ্গে সিন্ধু-এর শিক্ষাব্যবস্থাপক (ডাইরেক্টর অব এডুকেশন) আমাদের বিশিষ্ট বন্ধু সৈয়দ আলী আকবারও ছিলেন। তিনি একটি চিরকুট রেখে গিয়েছেন যে, আলআযহারে হিন্দুস্তানী ছাত্রদের হোস্টেল ‘রোয়াকুল হুনূদ’-এ কিছু বন্ধুদের একত্র করা হচ্ছে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। সেখানে আমার থাকা খুব জরুরি। তিনি এশার সময় আমাকে নিতে আসবেন।যথাসময়ে তিনি সৈয়দ আলী আকবরকে সঙ্গে করে এলেন এবং আমাকে নিয়ে গেলেন।ভেবেছিলাম, হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের অল্পসংখ্যক তালিবানে ইলমের মজলিস হবে। কিন্তু এখানে এসে দেখি, পুরো হল লাল তুর্কী টুপি এবং সাদা পাগড়িতে পরিপূর্ণ! আমি এমন অভিজাত, ভাবগম্ভীর এবং চিন্তাশীল যুবকদের সামনে ছিলাম যাদের দেখলে এমনিতেই ভিতরে আবেগ ও জাযবার তরঙ্গ উঠতে থাকে এবং কিছু বলার উদ্যম, স্পৃহা ও অনুপ্রেরিকা নিজে নিজেই সৃষ্টি হতে থাকে। যখন জানলাম, হাযিরীনে মজলিসের মধ্যে প্রচুর তুর্কী যুবক রয়েছে এবং রয়েছে ফিলিস্তীন ও সিরিয়ার তরুণদল তখন আনন্দ-প্রসন্নতা অনেক বেড়ে গেলো। আমি বক্তব্য পেশ করার জন্য মানসিকভাবে পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলাম।সিরিয়ার যুবক মুহাম্মদ তাওফীক, যিনি আলআযহারের ইসলামিক স্টাডিজের সেক্রেটারী, মঞ্চে এসে অনুষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী প্রথমে আমার পরিচয় পেশ করলেন এবং আমাকে অভিনন্দন জানালেন। তারপর  শায়খ লোকমান নাদাবী, যিনি হিন্দুস্তানী ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক, উঠে এসে আমাকে বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানালেন। আমি উপস্থিত যা কিছু চিন্তায় এসেছে, অনাড়ম্বর-ভাবে পেশ করলাম। এমন একটি ভরপুর জলসা, যেখানে তুরস্ক, সিরিয়া, মিশর, ফিলিস্তীন ও অন্যান্য দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা উপস্থিত, এমন জলসায় বক্তব্য রাখার জন্য আমার কোন পূর্বপ্রস্তুতি ছিলো না। তবু আল্লাহর মেহেরবানী,  বক্তব্য সবার পছন্দ হলো।

বক্তব্যের সারসংক্ষেপ

আমার বক্তব্যের খোলাছা ও সারসংক্ষেপ ছিলো এই-ইসলাম একটি চিরন্তন জীবন-ব্যবস্থা, যা আধুনিক-প্রাচীন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। আধুনিক ও প্রাচীনের পার্থক্য তো মানুষের নিজের তৈরী ব্যবস্থা, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে ও মাধ্যমে হয়ে থাকে। যে কোন জাতি ও জনগোষ্ঠী এই আসমানি জীবনব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করবে তারাই স্থিতি ও স্থায়িত্ব অর্জন করবে এবং স্থান ও কালের প্রভাব-বন্ধন থেকে মুক্ত হয় যাবে। আর স্থান ও কালের বন্ধনই মূলত জীবনকে পরিবর্তন-শীলতার নিগড়ে আবদ্ধ করে রাখে। এ কারণেই শুধু, জীবন বিভিন্ন বিপ্লবের আঘাতে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত হতে থাকে। পক্ষান্তরে এই পরিবর্তন-ঊর্ধ্ব জীবনব্যস্থা যারা গ্রহণ করবে তারা বস্তুবাদ এবং যাবতীয় দ্বন্দ্ব -সঙ্ঘাতের উপর বিজয়ী হতে পারবে। এটাই ছিলো ছাহাবা কেরামের জীবনে সফলতা ও কামিয়াবি এবং বড়ত্ব ও মহত্ত্ব অর্জনের আসল রহস্য। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মধ্যে যে বিপুল শক্তি ও যোগ্যতা গচ্ছিত রেখেছেন তা তাঁরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রথমে তাঁরা নিজেদের শক্তিহীনতা ও দৈন্যদশা সম্পর্কে বিচার-পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, রোম ও পারস্যের মত সর্বোন্নত বস্তুসভ্যতা ও সামরিক শক্তির মোকাবেলা করা এং সমকক্ষতা অর্জন করা তাঁদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। তখন নিজেদের তাঁরা ইসলামের চিরন্তন পায়গাম ও শাশ্বত জীবনবিধানের সঙ্গে যুক্ত করে নিলেন, যা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁদের সামনে পেশ করেছিলেন; যে জীবন-বিধান সম্পর্কে আসমানের ফায়ছালা হয়ে গিয়েছিলো যে, তা দুনিয়ার সকল বিধান ও ব্যবস্থার উপর জয়ী হবে এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।  ছাহাবা কেরাম নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ব এবং নিজেদের জানমাল ও সহায়-সম্পদ এই আসমানি জীবনব্যবস্থা  ও নেযামে হায়াতের জন্য কোরবান করেছিলেন। নিজেদের জীবন ও যৌবন, নিজেদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যত ঐ দ্বীন ও জীবন-বিধানের মধ্যে তাঁরা এমনভাবে ফানা ও বিলীন করেছিলেন যে, তাঁদের আলাদা কোন অস্তিত্বই ছিলো না। তাঁরা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। অবস্থা এমন হলো যে, তাঁদের ভবিষ্যত এবং ইসলামের ভবিষ্যত যেন পরস্পর  নির্ভরশীল। না ইসলামকে বাদ দিয়ে তাঁদের জীবন ও অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব ছিলো, আর না তাঁদের ত্যাগ ও কোরবানি ছাড়া ইসলামের প্রচার-প্রসার ও বিস্তার সম্ভব ছিলো। এ রহস্যকেই বয়ান করেছেন ইসলামের কবি আল্লামা ইকবাল এভাবে ‘আমরা ইসলামের রক্ষক, আর ইসলাম আমাদের রক্ষক।’ ছাহাবা কেরাম যখন এই অটল-অবিচল হিম্মত ও সাহস এবং প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার পরিচয় দিলেন, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের দিল, কলব ও অন্তরকে তাকওয়া ও আল্লাহমুখিতার কষ্টিতে পরীক্ষা করে নিলেন এবং সে পরীক্ষায় তাঁরা পূর্ণরূপে উত্তীর্ণ হলেন তখন তাঁরা আসমানি মদদ ও খোদায়ী নুছরতের হকদার ও যোগ্য প্রমাণিত হলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে আসমানে ফায়ছালা হলো যে, পৃথিবীতে তাঁরাই হবেন একমাত্র বিজয়ী, একমাত্র শক্তি ও প্রভাব -প্রতিপত্তির অধিকারী।হে আমার প্রিয় আযহারী তালিবানে ইলম, আজকের জড়বাদ ও বস্তুবাদের এ অপ্রতিহত প্রভাবের যুগে আমাদের-আপনাদের ক্ষেত্রেও এটাই হচ্ছে আসমানের ফায়ছালা। যদি আমরা ইসলামের চিরন্তন পায়গাম ও শাশ্বত জীবনবিধানের প্রতি আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ হতে পারি; যদি নিজেদের আমরা এর মধ্যে বিলীন করতে পারি; যদি আমরা নিজেদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যত, নিজেদের সব উচ্চাশা ও উচ্চাভিলাষ এই দ্বীনের জন্য বিসর্জন দিতে পারি; যদি এই দ্বীন আমাদের পাশে দঁড়িয়ে যায়, আর আমরা তার পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে পৃথিবীর সকল শক্তি ও ক্ষমতার উপর আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। এমনকি যামানা তখন আমাদের কথা বলবে এবং আমাদের আনুগত্য মাথা পেতে মেনে নেবে।

***

আমার টুটাফাটা বক্তব্য সমাপ্ত হওয়ার পর উস্তায তাওফীক কুনজী দাঁড়িয়ে আমাকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন এবং আবেদন জানালেন যেন শুব্বানুল মুসলিমীন জামাতের সম্মেলনকক্ষে, বিভিন্ন দেশ থেকে আযহারে আগত গবেষক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করি। আমি শুকরিয়ার সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে বললাম, এরূপ অভিজাত ও নির্বাচিত মজলিসে কথা বলার সুযোগ পাওয়া তো আমার জন্য আনন্দ ও সৌভাগ্যের বিষয়।তারপর আমি তাকে অনুরোধ করলাম, শ্রোতাছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার। তখন প্রত্যেকে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় বললেন। এভাবে তুর্কী, মিছরী, শামী, ফিলিস্তীনী ছাত্রদের সঙ্গে আলাদা পরিচয় হলো। তখন আমি তুর্কী ছাত্রদের সঙ্গে আলাদা মিলিত হওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে বললাম, তারা আমার অবস্থানস্থলে জমায়েত হলেও খুশী হবো, আবার আমাকে তাদের নির্ধারিত স্থানে ডেকে নিলেও অখুশী হবো না। এভাবে খায়র ও কল্যাণের সঙ্গে মজলিস সমাপ্ত হলো এবং আমরা অবস্থানস্থলে ফিরে এলাম।

বৃহস্পতিবার/১৭-৪-৭০ হি./২৫-১-৫১ খৃ.

শায়খ ওবায়দুল্লাহ, জনাব আলী আকবার ও শায়খ আহমদ উছমান এলেন। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিলো, এর মধ্যে উস্তায হোসনী ছক্রও হাজির। তিনি ঐ স্থানটি আমাদের দেখাতে চান যা মুহতারাম জালাল বেগ আমাদের থাকার জন্য নির্বাচন করেছেন। প্রয়োজন ছিলো না, তবু গেলাম এবং যথারীতি পছন্দও করলাম। কথা হলো, আজ বা কাল ভোরে এখানে চলে আসবো।মুহতারাম জালাল বেগকে সব সময় মনে হয়েছে, নিজের সমুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রমাধুর্য দ্বারা তিনি তাঁর পদ ও পদবির অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। এক হিন্দুস্তানী মুসাফিরের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে এতটা মর্যাদা দেয়া তাঁর অবস্থান থেকে, এটা আসলেই অনেক বড় কথা!

***

পথিমধ্যে একটি টেলিফোন থেকে ড. আহমদ আমীনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মক্কা থেকেই তাঁকে জানিয়েছিলাম আমার মিশরসফরের পরিকল্পনার কথা। জানতে চাইলাম, কখন কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব? তিনি জানালেন, বারটা পর্যন্ত  জিযা অঞ্চলে অবস্থিত সংস্কতি-অধিদফতরে দেখা হতে পারে।আমরা রওয়ানা হলাম। এর আগে তাঁর সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখা হয়নি। তবে তাঁর লেখা বইপত্র আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গেই অধ্যয়ন করেছি। তাঁর চিন্তাধারার সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিলো। ইতিহাসের উপর তাঁর গভীর দৃষ্টি, অনবদ্য পর্যালোচনাশক্তি, তাঁর চিন্তার ভারসাম্য, তাঁর আশ্চর্য বিশ্লেষণক্ষমতা, সর্বোপরি তাঁর অপূর্ব রচনাশৈলী, এসবে আমি মুগ্ধ ছিলাম। আর এটাই ছিলো ‘মাযা খাসিরা’-এর ভূমিকা লেখার জন্য তাঁকে আমার অনুরোধ করার কারণ। আমার বিশ্বাস ছিলো, মিশরীয় লেখক-সাহিত্যিক সমাজে এই কিতাবের ভূমিকা লেখার জন্য তিনিই উপযুক্ততম ব্যক্তি। তাছাড়া কিতাবের বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা রয়েছে এবং এর মূল চেতনাটির সঙ্গে তাঁর রুচি ও বিশ্বাসের মিল রয়েছে। এসব কারণে আমার মনে হয়েছিলো,  তাঁর লেখা ‘ফরমায়েশি’ ধরনের হবে না। যা লিখবেন, ভিতরের অনুপ্রেরণা থেকে এবং অন্তরের বিশ্বাস ও উচ্ছ্বাস থেকেই লিখবেন, যে লেখা হৃদয়কে হৃদয়ের কথা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।দুঃখের বিষয়, তাঁর লিখিত ভূমিকায় তাঁর দেশেরই বহু চিন্তাবিদ ও গবেষক সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাদের মনে হয়েছে, ভূমিকার যা উদ্দেশ্য, পাঠকের সামনে লেখক ও লেখাকে জীবন্ত -রূপে উপস্থাপন, এ ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে। এ ভূমিকা বইটির যথাযোগ্য সেবা তো করেইনি, বরং এর আসল মর্যাদাই ক্ষুণœ করেছে।আসলে এতে তাঁর কোন দোষ ছিলো না। একজন লেখক,  সাহিত্যিক সবসময় সবকিছু লেখার জন্য প্রস্তুত থাকেন না; তাছাড়া সববিষয়ের প্রতি সবার উচ্ছ্বাস উদ্দীপনাও থাকে না। বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হওয়া, আর বিষয়ের প্রতি দরদী ও নিবেদিত হওয়া এক কথা তো নয়! সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, নির্বাচনের ভুলটাই ছিলো বড় ভুল। ভূমিকার এই অপ্রীতিকর ভূমিকা সত্ত্বেও উস্তায আহমদ আমীন সম্পর্কে আগে আমার যে ধারণা ছিলো, এখনো তা বহাল রয়েছে।যাই হোক, অনেক রকম ভাব ও ভাবনার আনাগোনার মধ্যেই আমি তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য পথ অতিক্রম করতে লাগলাম। আমার মন তখন এ চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলো যে, একটু পরে আমি এমন এক ব্যক্তির দেখা পাবো এবং তাঁর কথা শুনতে পাবো, যাকে এতদিন চিনেছি লেখা ও কলমের মাধ্যমে, চিন্তা, গবেষণা ও সাহিত্যের মাধ্যমে। অর্থাৎ এতদিনের পরিচয় ছিলো তাঁর জ্ঞানব্যক্তিত্বের সঙ্গে, আজ পরিচয় হবে তাঁর মানুষব্যক্তিত্বের সঙ্গে। উভয় পরিচয় কি এক হবে, না ভিন্ন, জানি না! অনেক সময় চিন্তার ছবি বাস্তবের চেয়ে সুন্দর হয় এবং লেখার মধ্যে লেখকের ব্যক্তিত্বের অবয়ব মজলিসের শরীরী ব্যক্তিত্বের তুলনায় বেশী মুগ্ধকর হয়। বিপরীতও হতে পারে এবং হয়। তো একটু পরে আমার সঙ্গে যাই ঘটুক, আমি অবাক হবো না। কারণ উভয় রকমের অভিজ্ঞতাই আমার জীবনে রয়েছে।শেষপর্যন্ত সংস্কৃতি-অধিদফতর এসে গেলো এবং আমরা প্রধান ফটক অতিক্রম করলাম। জিজ্ঞাসার জবাবে আমাদের দেখানো হলো, ঐ যে সবুজ বাগানে বসে আছেন তিনি! দেখি, হালকাগড়নের দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি। আমাদের দেখতে পেয়ে স্বাগত জানাতে উঠে এলেন। অবাক হয়ে তাকে দেখলাম। সম্ভবত রোগে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়েছে। সেই সঙ্গে রাত জেগে ‘লেখা-পড়ার’ কারণে শরীর কাতর হয়ে পড়েছে। দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতাও হয়ত এ কারণেই। ডাক্তারের পরামর্শে দাঁত তুলে ফেলেছেন, বাক ও বাকভঙ্গিতে যার প্রভাব স্পষ্ট। চেহারা ও দেহাবয়ব থেকে বোঝা যায়, এখনকার জীর্ণতা-শীর্ণতা বয়স ও অসুস্থতার ফল। যৌবনে অন্যরকম ছিলেন, সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান।মোটকথা, এতদিনের কল্পনার আহমদ আমীন এখন আমার সামনে বাস্তব। তিনি হাসিমুখে আমাদের খোশামদেদ জানালেন। সৌজন্যবিনিময় হলো। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা হলো এবং প্রসঙ্গের সূত্র ধরে আমার কিতাব ‘মাযা খাসিরা’-এর কথাও উঠলো। আমি বললাম, ‘কারো কারো ধারণা, বইটির ভূমিকা লেখার অনুরোধ করে আপনাকে আমি কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছি’। তিনি (নিহিত ইঙ্গিতের দিকে না গিয়ে) বললেন, না, না, আমি বরং বইটি থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি এবং কিছু ‘বাইরের রেফারেন্স’ সম্পর্কে অবহিত হয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছি। এরপর কথা উঠলো তাঁর প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘ইসলাম, অতীত ও বর্তমান’ সম্পর্কে। তিনি বললেন, এতে আমি এমন কিছু বিষয় ‘পয়েন্ট আউট’ করেছি যা অনেকের জন্য ‘ভারী’ হতে পারে। যেমন আমি বলেছি, রিসালাত ও নবুয়তের যুগ ছাড়া ইসলাম পরিপূর্ণরূপে আর কখনো কার্যকর হয়নি, হতে পারেনি। আরেকটি বিষয়, ওমর যে ছয়জনকে খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা উছমানকে নির্বাচন করেছিলেন। কারণ তাঁরা ওমরের কঠোরতা থেকে উছমানের নমনীয়তায় স্বস্তি লাভ করতে চেয়েছিলেন। ... ওমরের শাসনপদ্ধতি যতটা না ইসলামী ছিলো তার চেয়ে বেশী ছিলো আরবীয়।তিনি বলেন, আমি এটাও  লিখেছি যে, যুগের দাবীতে আমাদের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতা আসতেই থাকে। সুতরাং ইজতিহাদের দরজা খোলা থাকতে হবে। যেমন, জীবনে এখন নিরন্তর ব্যস্ততা। সুতরাং কঠিন ব্যস্ততায় জড়িত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও মুকিম অবস্থায় যোহর-আছর একত্রে পড়ার অনুমতি থাকা উচিত। কলে কারখানায়, মাঠে ঘাটে রোদে গরমে যারা কাজ করে, তাদের জন্য গ্রীষ্মকালে রোযার পরিবর্তে ফিদয়ার অনুমোদন দেয়া উচিত। আবার দেখুন, ফিকহের এমন কিছু মূলনীতি আছে যার কারণে অনেক সময় গরীবের উপর যাকাতের ভার পড়ে যায়, আবার সচ্ছল ব্যক্তি ছাড় পেয়ে যায়। সুতরাং বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে। একই ভাবে হজ্বের সময় কোরবানির পরিবর্তে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে খেজুর ছাদাকা করার অনুমতি হওয়া উচিত। কারণ কোরবানিতে অপচয় ঘটে, পরিবেশ দুষিত হয়, রোগ ছড়ায়, সর্বোপরি গরীবের কোন কাজে আসে না।এধরনের অদ্ভূত চিন্তা, যা শরীয়াতের স্বভাব ও নির্দেশনা এবং উছূল ও মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এসব বিষয়ে আমি মতভিন্নতা ও অস্বস্তি প্রকাশ করলাম। তবে প্রথম সাক্ষাতে তাঁর সঙ্গে ‘আলোচনায় নামা’ সঙ্গত মনে হলো না।এর পর তিনি আরবচিন্তাধারা ও পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য এভাবে তুলে ধরলেন যে, আরবচিন্তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সুসংহত ও সুসংক্ষিপ্ত গঠনকাঠামো। তাই নীতিকথা ও প্রবাদ তাতে বিশিষ্টতা লাভ করেছে। পক্ষান্তরে পর্যালোচনা ও  বিশ্লেষণধর্মিতা হলো পাশ্চাত্যের চিন্তাবৈশিষ্ট্য। তাই গল্প ও কাহিনী তাতে বেশ উৎকর্ষ লাভ করেছে।তারপর তিনি জার্মানচিন্তাধারা সম্পর্কে বললেন এবং তার গভীরতার প্রশংসা করলেন। তাঁর মতে জার্মানচিন্তা তাছাওউফের যথেষ্ট কাছে।‘নওমুসলিম’ মুহাম্মদ আসাদ-রচিত ‘সঙ্ঘাতের মুখে ইসলাম’ বইটির প্রতিটি নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন।তাঁর সঙ্গে পুরো মজলিসটাই ছিলো আগাগোড়া একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। দ্বীন ও ইলম তথা ধর্ম ও বুদ্ধিবৃত্তির বিভিন্ন দিক নিয়েই কথা হয়েছে।তিনি দুপুরের দস্তরখানের দাওয়াত দিলেন। আমি বললাম, এটা পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ের জন্য না হয় মুলতবী থাক!বিদায়ের সময় তিনি আমাকে (তাঁর প্রকাশনাসংস্থা থেকে প্রকাশিত) মাযা খাসিরা-এর পাঁচটি নোসখা হাদিয়া দিলেন। আমি শুকরিয়া জানিয়ে বললাম, আপনার আত্মজীবনী ‘হায়াতী’ পড়ার খুব ইচ্ছে ছিলো। ভারতে বা হিজাযে কোথাও পাইনি।তিনি খুশী হলেন এবং একটি নোসখা আনিয়ে আমাকে হাদিয়া দিলেন। বইটির কোণে লিখে দিলেন, ‘আহমদ আমীনের পক্ষ হতে তার ভাই উস্তায আবুল হাসানকে হাদিয়া, পরিচয়ের স্মারকরূপে’ ২৫-১-৫১ খৃ.আহমদ আমীন আমাকে ঐ সবচিঠিপত্রের বা-িল দিয়ে দিলেন যা আমার পক্ষ হতে তাঁর নামে হিন্দুস্তান থেকে এসেছিলো। হয়ত তিনি ভেবেছেন, তাঁর কোন কাজে আসবে না, অথচ আমার কাজে আসতে পারে।আহমদ আমীনের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সময় সঙ্গে ছিলেন শায়খ আহমদ উছমান এবং জনাব আব্দুর-রাশীদ নাদাবী আমার মুখলিছ দোস্ত মাহমূদ কিন্দীল এলেন। আলজামাআতুশ-শারঈয়্যার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে। আব্বাসিয়া অঞ্চলে তাঁর ওয়ার্কশপ (যা তাঁর হালাল রিযিকের মাধ্যম)। মক্কা শরীফে তার সঙ্গে দেখা ও সাক্ষাৎ হয়েছিলো। তখন থেকেই পরস্পরের প্রতি অন্তরঙ্গতার শুরু। তিনি আমার হোটেলে ওঠার বিষয়ে অনুযোগ করে বললেন, ‘কায়রোয় আমার থাকা অবস্থায় আপনি হোটেলে উঠেছেন, এটা কেন?!’ আমি সৌজন্যমূলক কিছু কথা বলে, দুঃখ প্রকাশ করে বিষয়টা সেখানেই থামিয়ে দিলাম। তিনি অনেক্ষণ ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা জামা‘আতে শার‘ঈয়্যার কেন্দ্রীয় মসজিদে জুমা আদায় করবো। সেখানে আবার সাক্ষাৎ হবে।

***

শুক্রবার/ ১৮-৪-৭০ হি. /২৬-১-৫১ খৃ. 

গতরাতে আলহাজ আলী শারীফ টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, তিনি ও আহমদ উছমান সকাল দশটায় এসে জুমার জন্য আমাদের নিয়ে যাবেন। আমরা প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। তাঁরা যথাসময়ে এলেন, আর আমরা জামআতে শার‘ঈয়্যার মসজিদে হাজির হলাম। মসজিদটির প্রশান্তিপূর্ণ অনাড়ম্বরতা, সাধারণ সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বিদ‘আত ও অপচয়মূলক সৌন্দর্যায়ন, এগুলো কিছুই ছিলো না। খোতবা ও ছালাতেও আপত্তি করা যায় এমন কিছু নযরে আসেনি। হাঁ, খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রতি ‘তারাহ্হুম’ ও আলোচনা আসেনি। তাছাড়া ছালাতের মধ্যে ছিলো পূর্ণ ইতমিনান ও আত্মসমাহিতি। কিয়াম-রূকু ও অন্যান্য আমলেও ছিলো ধীরস্থিরতা।সুন্নাতের পূর্ণ অনুসারী এ ছালাতে আমি অত্যন্ত প্রশান্তি লাভ করেছি। মসজিদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং মুছল্লীদের শান্তসমাহিত আচরণ খুবই ভলো লেগেছে। আকাক্সক্ষা হয়, আবার যেন এ মসজিদে আসা হয়। যাই হোক, শায়খ আহমদ উছমান জুমার খোতবা দিলেন। স্থান-কালের দিক থেকে তাঁর খোতবা ছিলো খুবই উপযোগী। নামাযও তিনিই পড়ালেন এবং ঘোষণা করলেন, হিন্দুস্তানের একজন মেহমান আলিম কিছু কথা বলবেন। আমি মিম্বরে বসলাম এবং আল্লাহ যা কিছু উদ্ভাসিত করলেন বললাম। আমি বর্তমান যুগে ইসলামের গোরবাত, এতীমি ও দুর্দশাপূর্ণ অবস্থার কথা আলোচনা করলাম। যারা দ্বীনকে ভালোবাসে এবং দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে চায় তারা এমনকি স্বদেশেও কতটা আজনাবিয়্যাত, দুর্যোগ ও প্রতিকূলতার শিকার তাও আলোচনা করলাম। প্রতিটি দেশে, প্রতিটি জনপদেই এ বেদনাদায়ক চিত্র দেখা যায়। আমি জামাআতে শার‘ঈয়্যাকে বিশেষভাবে মোবারকবাদ দিলাম এ কথা বলে যে, এই জামাতের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারা সময়ের স্রোতের সঙ্গে ভেসে না চলার বিষয়ে অবিচল রয়েছে। আমি সংক্ষেপে হিন্দুস্তান ও মিশরের ঐ সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের কথা বললাম, যারা সুন্নাতর পূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং সুন্নাতের মুহাফিয ও প্রহরী ছিলেন। আমি আরো বললাম, ইসলাম ও মুসলমানদের এই এতীমি ও দুর্দশার অবস্থা দূর করার জন্য এবং সময়ের ধারা ও স্রোতকে মন্দ থেকে কল্যাণের দিকে পরিবর্তন করার জন্য নিরন্তর মেহনত-মোজাহাদা, ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং হিকমত ও প্রজ্ঞা -পূর্ণ কর্মপন্থা গ্রহণের খুবই প্রয়োজন রয়েছে।এজন্য মাঠের দৌড়ঝাঁপ ও ময়দানী তৎপরতার যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বুদ্ধিবৃক্তিক প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালানোরও। ইসলামী দাওয়াতের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ছাড়া এ উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না।আমি আরো বললাম, ইসলাম কোন মৌরুসি সম্পত্তি নয় যে, পুত্র পিতার কাছ থেকে বা প্রজন্ম প্রজন্মের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করবে, যেমন অনেকে ভেবে থাকে। যারা এই ভুল ধারণার শিকার তারা দ্বীনের আসল কদর-কীমত এবং এর প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারেনি। কারণ দ্বীনের সম্পদ তারা পেয়ে গেছে কোন মেহনত ছাড়া একেবারে বিনামূল্যে। এ কারণেই ইসলামের উপর যখন কোন বিপদ বা দুর্যোগ নেমে আসে তখন দেখা যায়, এদের যেন ‘কানের পোকা’ পর্যন্ত নড়ে না। তাদের মধ্যে কোন ক্ষোভ, বিক্ষোভ, বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় না। প্রতিরোধের স্পৃহা জাগ্রত হওয়া, সে তো অনেক পরের কথা। পক্ষান্তরে ছাহাবা কেরামের জামাত?! তাদের কাছে তো ইসলাম ছিলো জানমালের চেয়ে মূল্যবান, এমনকি আপন সন্তান-সন্ততির চেয়ে প্রিয়। কারণ দ্বীনের জন্য তারা বহুত বড় কোরবানি দিয়েছেন। হাজারো বিপদ, মুছীবত, দুর্ভোগ ও দুর্যোগের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। খুন-আগুন ও ঝড়তুফানের দরিয়া পার হয়েছেন। তারপর ইসলামের দৌলত হাছিল করেছেন, মুফতে, বিনা মেহনতে নয়। দ্বীনের এই নেয়ামত হাছিল করার জন্য অনেক বেশী মূল্য দিতে হয়েছে তাঁদের।এখন আমাদের কর্তব্য হলো জীবনের সমগ্র অতীতের বিচার-পর্যালোচনা করা। পর্যালোচনা করে দেখা যে, আমাদের জীবনে দ্বীনের জন্য ত্যাগ ও আত্মত্যাগ, নিরন্তর জিহাদ ও মুজাহাদার নমুনা রয়েছে কি না। দ্বীনের পথে যত প্রতিকূলতা এসেছে, বিপদ দুর্যোগ এসেছে, নির্যাতন নিপীড়ন ও উচ্ছেদ, বিতাড়ন এসেছে, আমরা তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করেছি কি না। যদি করে থাকি তাহলে তো আল্লাহর শোকর। আর যদি আমাদের জীবনের চিত্র হয় অন্যরকম তাহলে লজ্জিত হতে হবে; অনুতাপ, অনুশোচনা ও তাওবা করতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহর দ্বীনের পথে যে কোন ত্যাগ ও কোরবানি, সর্বপ্রকার জিহাদ ও মুজাহাদা এবং যে কোন বিপদ-প্রতিকূলতার মুখে অবিচল থাকার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। কারণ এছাড়া দ্বীনের বিজয় এবং আহলে দ্বীনের কামিয়াবির অন্য কোন রাস্তা নেই। ইরশাদ হয়েছেÑ‘মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছাড় দেয়া হবে? পরীক্ষা দ্বারা তাদের ঝলসানো হবে না?! অথচ তাদের আগে যারা ছিলো তাদের তো আমি কঠিন পরীক্ষা নিয়েছি। তো যারা সত্য বলছে তাদের অবশ্যই  আল্লাহ জানবেন, আর অবশ্যই জানবেন মিথ্যাচারিদের।’বয়ান সমাপ্ত হওয়ার পর শায়খ আমীন খাত্তাব বক্তৃতার জন্য উষ্ণ অভিনন্দ জানালেন। এটাই হচ্ছে এ যুগের সভা/ সেমিনারের রেওয়াজ, রীতি বা রসম।শায়খ আমীন হলেন এই জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মহান সংস্কারক মাহমূদ খাত্তাবের সুযোগ্য পুত্র ও খলীফা। তিনিই জামাতের বর্তমান প্রধান।তিনি দীর্ঘ একঘণ্টা বয়ান করলেন। তাঁর বিষয়বস্তু ছিলো দাওয়াত ও তাবলীগ এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকার। অনেক ফিকহী মাসায়েলও আলোচনায় এলো। ছিফাতের হাকীকত এবং সৃদশ আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা, এসব জটিল বিষয়ও বাদ গেলো না। পুরো বয়ান অবশ্যই অধ্যয়নের গভীরতা ও ব্যাপকতা, স্মৃতিস্থ হাদীছের বিপুলতা প্রমাণ করে। সেই সঙ্গে জামাতের মধ্যে তাঁর বিস্ময়কর প্রভাবের কথাও প্রমাণ করে। কারণ এরকম একটি দীর্ঘ বয়ান শ্রোতাম-লী পূর্ণ শ্রদ্ধা ও একাগ্রতার সঙ্গে শুনেছে। মাঝখানে কেউ উঠে যায়নি, প্রয়োজনের খুব বেশী তাড়া ব্যতীত।বয়ানের শেষে শায়খ মিম্বর থেকে নামলেন, আর মানুষ মুছাফাহার জন্য যেন ভেঙ্গে পড়লো। হিন্দুস্তানের মেওয়াত ছাড়া আর কোথাও আমি এমন ইখলাছ ও মুহাব্বাতের মুছাফা, এমন আকুতির সঙ্গে দু‘আ চাওয়ার দৃশ্য দেখিনি। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

হযরত আলী মিয়াঁ- সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

জন্ম  ১৩৩৩ হি./১৯১৪ খৃ. জন্মস্থান লৌখনো থেকে ৭৭ কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত রায়বেরেলীর পূর্ব-উত্তরে ছোট্ট বস্তি দায়েরা। শিক্ষাজীবন কায়দা ও নাযেরা রায়বেরেলীতে। শৈশব তাঁর নিজের ভাষায়, এমন ছিলো না যাতে কোন রকম সুন্দর ভবিষ্যতের আশা করা যায়। এজন্য তাঁর মহীয়সী আম্মা খুব চিন্তিত ছিলেন। উর্দূ-ফারসী রায়বেরেলীতে এবং লৌখনোতে বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আরবীভাষার প্রথম শিক্ষক শায়খ খলীল ইবনে মুহাম্মদ, যিনি মূলত আরব-ইয়ামানী আনছারী বংশোদ্ভূত। তিনি ছিলেন সমকালে আরবীভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ শিক্ষক। উচ্চতর আরবীর শিক্ষক শায়খ তাকীউদ্দীন হিলালী। তিনিও ছিলেন আরব এবং আরবজাহানের স্বীকৃত আরবীভাষাবিদ।তাফসীর প্রাথমিক পাঠ মাওলানা আব্দুল হাই ফারূকী ছাহেবের নিকট। উচ্চতর পাঠ লাহোরে মাওলানা আহমদ আলী লাহোরীর নিকট; ১৯৩০-৩১ খৃ. হাদীছ অধ্যয়ন নিয়মিত ছাত্র হিসাবে দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা লৌখনো, শায়খুল হাদীছ আল্লামা হায়দার হাসান টোঙ্কী র. এর নিকট; হযরত মাদানী র. এর নিকট হাদীছের বিশেষ দরস ১৯৩২ খৃ. শিক্ষকতার শুরু দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা, লৌখনো, বিশবছর বয়সে। লেখালেখি তেরবছর বয়সে প্রথম উর্দূ লেখা প্রকাশিত হয় যমীনদার পত্রিকায়। আল্লামা ইকবালের কবিতা ‘চান্দ’-এর আরবী অনুবাদ। ১৬ বছর বয়সে মিশরের অভিজাততম পত্রিকায় দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ। তাতে সম্পাদকের এমনই মুগ্ধতা ছিলো যে, তিনি সেটি আলাদা পুস্তিকা আকারেও প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। প্রথম কিতাব মাযা খাসিরাল আলামু ... (মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো?) আরবীতে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে, যা তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও সম্মান এনে দিয়েছে। দ্বিতীয় কিতাব সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ (উর্দূতে) ৩২বছর বয়সে (১৯৩৬ খৃ.) প্রকাশিত কিতাবের সংখ্যা শতাধিক। আধ্যাত্মিক জীবন তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলয়াস রহ. এর সঙ্গে সম্পর্ক। মাদানী রহ. এর হাতে বাই‘আত। হযরত মাওলানা আব্দুল কাদির রায়পুরী এবং হযরত শায়খুল হাদীছ র. এর খেলাফত। সফর দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশ সফর করেছেন। মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম সফর, ১৯৫১, যার ভিত্তিতে ম্যধপ্রাচ্যের ডায়রী কিতাবের রচনা। দামেস্ক ইউনিভার্র্সিটির আমন্ত্রণে অতিথিঅধ্যাপক, ১৯৫৬ হজ্বের প্রথম সফর ১৩৬৬ হি. (১৯৪৭ খৃ.) এবং হিজাযে দাওয়াত ও তাবলীগের ভিত্তি স্থাপন। পদ ও পদবী জামেয়া ইসলামিয়া ও রাবেতা আলামে ইসলামী মজলিসে শূরার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। নদওয়াতুল উলামার মহাপরিচালক, সর্বভারতীয় মুসলিম পার্সনাল ল-এর সভাপতি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক সেন্টারের চেয়ারম্যান। এছাড়াও বহু ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক। ওয়াফাত ১৪২১ হি. ২২শে রামাযান (১৮/১২/২০০০ খৃ.) মুসলিম উম্মাহকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করে দয়াময় আল্লাহর রহমতের ছায়া লাভ করেন। চিন্তা ও অধ্যাত্মিকতা, উভয় ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এই উম্মাহর পথপ্রদর্শক। এটা হলো তাঁর জীবন-সমুদ্রকে সামান্য কুজোর মধ্যে ধারণ করার ব্যর্থ চেষ্টা। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ‘গারীকে রাহমাত’ করুন। তাঁর পবিত্র জীবন অনুসরণের তাওফীক আমাদের দান করুন, আমীন। 

আমাদের জন্য চিন্তার খোরাক

আমার বড় সৌভাগ্য যে, সেই অল্প বয়সে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই আমি উর্দূভাষা ও সাহিত্যের চর্চা শুরু করেছিলাম। উর্দূ সাহিত্যের মৌলিক গ্রন্থগুলোর সঙ্গে তখন থেকেই আমার পরিচয় গড়ে উঠেছিলো। আল্লামা শিবলী নোমানীর আলফারূক আমি একবার নয়, বারবার এবং বহুবার পড়েছি। (উর্দূসাহিত্যের স্তম্ভগ্রন্থ) আবেহায়াত-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে আমার শ্রদ্ধেয় ফুফা সৈয়দ তালহা ছাহেবের মজলিসে। বইটি তিনি নিজে আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন; আমি নিজেও পড়েছি বহুবার; এতবার যে, প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো!‘গুলে রা’না’ তো ছিলো আমার আব্বার লেখা ঘরের কিতাব! এতবার পড়েছি যে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে আশ্চর্য এক সখ্য গড়ে উঠেছিলো। উচ্চ পর্যায়ের সাহিত্যমজলিসে স্বচ্ছন্দে আলোচনা করার মত অবস্থান তখনই আমার তৈরী হয়ে গিয়েছিলো।উর্দূভাষা ও সাহিত্যের বড় বড় ব্যক্তিত্ব, কবি ও তাদের কবিতা আমার স্মৃতিভা-ারে ‘শৈশবীয় স্মৃতি’র মত সুসংরক্ষিত ছিলো।সত্যি আমার জন্য এটা ছিলো আল্লাহর পক্ষ হতে গায়বি তাওফীক। আমাদের আলেমসমাজে মাতৃভাষার প্রতি শুরু থেকে কেন যেন তেমন গুরুত্ব নেই। ফলে পরবর্তী জীবনে কর্মের ক্ষেত্রে এবং দাওয়াতের অঙ্গনে যথেষ্ট প্রতিকূল অবস্থা দেখা দেয়। বিশেষ করে আধুনিক সমাজের সঙ্গে তারা আর স্বচ্ছন্দ হতে পারেন না। না বুঝতে পারেন, না বোঝাতে পারেন। আর তাদের কলম ও লেখনী তো এতই পিছিয়ে থাকে যে, সময়ের দাবী রক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব হয় না। একজন দা‘ঈ ও আলিমে দ্বীনের জন্য এটা অবশ্যই দুঃখজনক।  - হযরত আলী মিয়াঁ রহ. 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা