রজব ১৪৩৯ হিঃ (৩/৩)

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

আমরা যদি বিনয়ী হতাম!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

হিজরীবর্ষ শুরু হয়ে অর্ধেক পার হয়েছে। খৃস্টীয় বর্ষ শুরু হয়ে কিছু দূর এগিয়েছে। বাংলাবর্ষ বিদায়ের পথে, নতুন বর্ষ আসি আসি করছে। এই তিনটি বর্ষের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এগুলোর সঙ্গে আমাদের জীবনের সম্পর্ক রয়েছে। কোন সম্পর্কই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।এর মধ্যে বাংলাবর্ষের অবস্থা বড়ই নাযুক। এর সম্পর্ক ফসলের সঙ্গে। তাই পল্লীজীবনে এর প্রভাব রয়েছে। শহরের সাহেবরা শুধু একটু নড়ে চড়ে বসেন পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ এবং ‘পান্তা-ইলিশ’ -এর স্বাদ গ্রহণ করার জন্য। এ ছাড়া শহরের জীবনে বাংলাবর্ষের কোন আবেদন নেই।হিজরীবর্ষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হৃদয় ও আত্মার, দ্বীন ও ধর্মের। কিন্তু তিক্ত বাস্তব এই যে, হিজরীবর্ষ, এমনকি যারা ধর্মনিষ্ঠ, তাদেরও কাছে গুরুতর অবহেলা-অবজ্ঞার শিকার। তারাও বলেন, ‘এবার হজ্ব হবে ৯ই অক্টোবর’!!আমাদের জীবনে খৃস্টীয় বর্ষের অপ্রতিহত প্রভাব। রাজনীতি, কূটনীতি ও অর্থনীতি সবকিছু পরিচালিত হয় খৃস্টীয় বর্ষ অনুযায়ী। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও লেনদেনও সম্পূর্ণরূপে এর নিয়ন্ত্রণে।নিজেদের আমরা যারা ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত বলে মনে করি, আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমরা প্রতিজ্ঞা করলেই পারি হিজরীসনকে তার নিজস্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু সময়ের উজানে চলার না আমাদের নিয়ত আছে, না আছে সাহস ও হিম্মত।***আমাদের বর্ষগুলো, হয় সূর্যের গতির উপর নির্ভরশীল, না হয় চাঁদের গতিবিধির উপর। সৌরবর্ষ হোক বা চান্দ্র্যবর্ষ, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সময়ের হিসাব রাখা, যাতে জীবনকে সুন্দরভাবে, সুশৃঙ্খলভাবে এবং উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিতরূপে ব্যবহার করা যায়। কোরআন কত না সুন্দর বলেছে, ‘যাতে তোমরা জানতে পারো বর্ষের গণনা ও হিসাব’!এই যে সময়ের নিরন্তর প্রবাহে এক সময় বর্ষ শুরু হয় এবং শেষ হয়! নতুন বর্ষকে আমরা বরণ করি, আবার পুরোনো বর্ষকে বিদায় জানাই, একবারও কি চিন্তা করেছি, সময়ের আসল রহস্য কী? কাকে বলে সময় এবং সময়ের প্রকৃত মূল্য কোথায়? একবারও কী প্রবেশ করেছি, করতে চেয়েছি কাল, মহাকাল ও জীবনের গভীরে?!***একটি বছর পৃথিবীকে বহু জীবন উপহার দেয়, নিরন্তর জন্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে; আবার বহু জীবন প্রত্যাহার করে নিরন্তর মৃত্যুপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যুগ যুগ ধরে মানুষ আসছে মহাকালের গহ্বর থেকে, মানুষ যাচ্ছে মহাকালের গহ্বরে। জন্ম-মৃত্যুর এক অপরিবর্তনীয় ও অটুট বন্ধনেমানুষ এমনই আবদ্ধ, এমনই নিয়ন্ত্রিত যে, ধনী ও নির্ধন, দুর্বল ও সবল, শাসক ও শাসিত এবং শোষক ও শোষিত কারো পক্ষেই এ নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। সম্পদের চৌম্বক শক্তি যাদের হাতে; কোটি কোটি বনি আদমকে বঞ্চিত করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে; সম্পদের প্রাচুর্যের উপর যারা গড়াগড়ি খায় এবং জীবনের যে কোন সাধ-আহ্লাদ চাইলেই যারা পুরা করতে পারে, যথাসময়ে মৃত্যু তাদেরও ‘ছোবল’ দেয়। জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন ও চাহিদা  থেকে চিরকাল যারা বঞ্চিত, জন্মের প্রথম দিন থেকে যাদের পরিচয় শুধু ক্ষুধা, অনাহার, লাঞ্ছনা ও ‘ধুতকার’-এর সঙ্গে, জীবন থেকে, সমাজ থেকে, প্রতিবেশ ও প্রতিবেশী থেকে কখনো যারা পায়নি একটুকরো হাসি, একখ- সহানুভূতি, মৃত্যু তাদেরও ‘আলিঙ্গন’ করে গায়বের হুকুমে।গর্ব, দর্প, অহঙ্কার ও প্রতাপ প্রকাশ করার জন্য যারা কোটি কোটি মানুষের ‘ভাগ্যবিধাতা’ সাজে; যাদের আঙুলের ইশারায় খুন-আগুনের দরিয়া বয়ে যায়, জনপদের পর জনপদ জ্বলেপুড়ে সারখার হয়ে যায়, মালাকুল মাউত তাদেরও সামনে হাজির হয়, আর বলে, ‘খেল খতম’!যুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন-উৎপীড়ন ও শোষণের বিভীষিকায় যারা দিশেহারা; যাদের শেষ আর্তনাদ হলো, ‘কোথায় তুমি হে মৃত্যু!’ তাদেরও সামনে মৃত্যু আসে, আর বলে, এই যে আমি!***জন্ম-মৃত্যুর এই যে অমোঘ বিধান, এই যে অলঙ্ঘনীয় নিয়ন্ত্রণ, কী এর উদ্দেশ্য? কী এর রহস্য?? মানুষের যিনি স্রষ্টা, মানুষের সামনে তিনি তা অজ্ঞাত বা অস্পষ্ট রাখেননি। মানুষকে তিনি তা জানিয়ে দিয়েছেন সুস্পষ্ট ভাষায়। দেখুন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পাক কালামে কত সুন্দর করে বলেছেন ‘তিনিই ঐ সত্তা যিনি মৃত্যু এবং জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, আমলে ও কর্মে তোমাদের কে অধিক উত্তম?! কাল, মহাকাল, জীবন ও মৃত্যু এগুলোর উদ্দেশ্য শুধু মানুষকে সৎ কর্ম ও পুণ্যের পথে পরিচালিত ও অনুপ্রাণিত করা। তারপর যথাসময়ে মানুষকে ‘অনন্ত জীবনের দোরগোড়ায়’ পৌঁছে দেয়া, যেখানে তার অপেক্ষায় আছে, হয় ফুলের বাগিচা, না হয় আগুনের লেলিহান শিখা!!***মৃত্যু আমাদের আলিঙ্গন করবে। নির্ধারিত সময় জানি না, তবে নির্ধারিত সময়েই ঘটবে, নিশ্চিভাবে জানি। তারপরো কেন মুসলিম-অমুসলিম, বিশিষ্ট-সাধারণ, ধনী-নির্ধন, শাসক ও শাসিত, শোষক ও শোষিত সবার জীবনে কেন মৃত্যুর প্রতি, সৎ কর্মের প্রতি এবং অনন্ত জীবনের প্রতি এ অমার্জনীয় অবহেলা ও অবজ্ঞা? কেন এ গাফলত ও উদাসীনতা? কেন??জীবনের তারুণ্যকে কী নির্দয়ভাবে অপচয় করে আমরা যৌবনের হাতছানি গ্রহণ করি! যৌবনকে লাগামহীন ভোগবিলাস ও অনাচার-পাপাচারে বোঝাই করে একসময় বার্ধক্যের হাতে বন্দিত্ব বরণ করি। তারপরো ভাবি না, মৃত্যু আসছে, এখন অন্তত কিছুটা প্রস্ততি গ্রহণ করি! এক সময় অবধারিত মৃত্যু এসে যায় এবং থাবা দিয়ে  নিয়ে যায়। তখন মৃত্যুর হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কোন উপায় থাকে না।***জীবনের প্রতি আমরা যদি সচেতন ও দায়িত্বশীল হতাম এবং সঠিক ও সরল পথে চিন্তা করায় অভ্যস্ত হতাম তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারতাম, মহাকালের স্রোতে ঠিক কোন্ স্থানটিতে আমরা ভাসমান! মহাবিশ্বের সুবিশাল প্রাঙ্গণে আমাদের অস্তিত্ব কতটুকু অংশ জুড়ে! আমরা যদি ভাবতে শিখতাম, কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি, কে আমাদের পাঠিয়েছেন, কে আমাদের জন্য এ জগত-সংসার সাজিয়েছেন? এবং কেন??আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনটি যাপন করার কোন বিধিপত্র তিনি পাঠিয়েছেন কি না, পাঠালে সেটা কোথায়?? এ সম্পর্কে যদি আমরা চিন্তা করতাম গভীর নিমগ্নতার সঙ্গে, চিন্তার সরল রেখা অনুসরণ করে তাহলে খুব সহজেই আমরা এ সত্যে উপনীত হতে পারতাম যে, জীবনের চলার পথে আমাদের অনুসরণ করতে হবে স্রষ্টার প্রেরিত জীবনবিধান এবং স্রষ্টার প্রেরিত নবীর পথ ও পন্থা। আমরা অবশ্যই অনুধাবন করতে পারতাম যে, সবকিছুতে আমাদের হতে হবে বিনয়ী, হতে হবে পরম সত্তার সমীপে পূর্ণ সমর্পিত। বিনয় ও আত্মসমর্পণই আমদের নিয়ে যাবে সফলতার পথে, মুক্তির গন্তব্যে। আমাদের এই ক্ষুদ্র, সংক্ষিপ্ত জীবনে অনাচার ও স্বেচ্ছাচার, গর্ব ও অহঙ্কার এবং ঔদ্ধত্য ও আস্পর্ধার কোন সুযোগ নেই। কারণ অনাচার ও স্বেচ্ছাচার এবং ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার জীবনকে নিয়ে যায় নিশ্চিত ধ্বংসের পথে।***জীবনের অনেকগুলো সালতামামি সম্পন্ন করেছি। জানি না, আর ক’টি সালতামামির সুযোগ আমাদের সামনে রয়েছে। জীবন থেকে অতীতকে আমরা হারিয়েছি কোন কিছু অর্জন না করেই! আমাদের এখন শূন্যহাত, বরং আমাদের হাতে এখন কৃতকর্মের দীর্ঘ তালিকা, যার হিসাব আমাদের দিতেই হবে। আসুন আমরা শপথ করি, জীবনের ভবিষ্যতকে আমরা নষ্ট করবো না। অনন্ত জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্জন ছাড়া জীবনের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে আমরা হাতছাড়া করবো না। আসুন শপথ করি, জীবনের বাকি সময়টুকু আমরা বিনয়ের পথে, আত্মনিবেদনের পথে চলবো; অহঙ্কার ও অনাচারের পাথে আর চলবো না। সবার জন্য আমরা শান্তি নিশ্চিত করবো; কোনভাবেই কারো অশান্তির কারণ হবো না। কাউকে আমরা কষ্ট দেবো না, কোনভাবেই না। আমাদের সঙ্গে যার যতটুকু সম্পর্ক রয়েছে, সে সম্পর্কের দাবী অবশ্যই আমরা রক্ষা করবো।জীবনের যবনিকা নেমে আসবে মৃত্যুর মাধ্যমে। দীর্ঘ রাত পার হবে কবরের অন্ধকারে। তারপর শুরু হবে প্রভাত নতুন জীবনের, অনন্তকালের। আসুন আমরা যথাযথরূপে উপলব্ধি করি, আমাদের আজকের এ ক্ষুদ্র সংক্ষিপ্ত জীবন আসলে সেই অনন্ত জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্র।আসুন আমরা সত্যের পথে চলি, আলোর পথ অনুসরণ করি। আসুন আমরা মিথ্যার পথ পরিত্যাগ করি, অন্ধকারের পথ পরিহার করি। আসুন, আমরা জীবনের সেই মহান উদ্দেশ্যের প্রতি পূর্ণ নিবেদিত হই, যা আমাদের স্রষ্টা আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং মহান বার্তাবাহকের মাধ্যমে মহান বার্তাপত্রে তা ঘোষণা করেছেন।আমাদের পূর্বে যারা এসেছিলেন পৃথিবীকে তারা আমাদের জন্য  যেমনই হোক একটি অবস্থার উপর রেখে গেছেন; আমরাও জীবনের নির্ধারিত পথ অতিক্রম করে চলে যাবো মহাগন্তব্যে। যাওয়ার আগে আসুন পৃথিবীকে যদ্দুর পারি, যদ্দুর সাধ্যে কুলায়, আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর, শান্তিময় ও  নিরাপদ করে রেখে যাই। এটা জীবনের প্রতি আমাদের দায় ও দায়িত্ব। এটা স্রষ্টার পক্ষ হতে আমাদের প্রতি একটি সার্বজনীন আদেশ।চেয়ে দেখুন, প্রতিটি ‘শামা’ গলে গলে নিঃশেষ হতে চলেছে। কোন কোনটি তো প্রায় নিভু নিভু! সাবধান হওয়ার এখনই তো সময়। পরে তো শুধু আফসোস ও অনুতাপ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা