আল কুদসসংখ্যা (৩/২)

আল কুদসসংখ্যা (বিশেষ).

ইনতিফাদার গৌরবকাহিনী

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

ইনতিফাদা অর্থ গণঅভ্যুত্থান বা সর্বাত্মক প্রতিরোধ। যখন ফিলিস্তীনকে কেন্দ্র করে কোন জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তখন ফিলিস্তীনের জিহাদ ও শাহাদাতের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত জনগণকে বিশেষভাবে কিশোর ও তরুণসমাজকে ইহুদী সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য রাস্তায় নেমে আসার ডাক দেয়া হয়।

প্রথম ইনতিফাদার ডাক দিয়েছিলো ফিলিস্তীনের ইসলামী প্রতিরোধ সংস্থা হামাসের ১৯৮৭ সালে। উদ্দেশ্য ছিলো সন্ত্রাসবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তীনমুক্তিসংস্থার শান্তিচুক্তি সাম্পাদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। ঐ ইনতিফাদার সময় সমগ্র ফিলিস্তীন ভূখ- শাব্দিক অর্থেই অগ্নিগর্ভরূপ ধারণ করেছিলো।

ফিলিস্তীনী শিশু-কিশোরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে টেঙ্ক ও গোলাবারুদের সামনে দঁড়িয়ে গিয়েছিলো, যা স্বভাবভীরু ইহুদীদের হতবাক করে দিয়েছিলো। তখন আপোশকামী ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদী শক্তিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে জিহাদ ও শাহাদতমুখী ইসলামী শক্তি ফিলিস্তীনী জনগণের মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রথম ইন্তিফাদার সময় ইহুদী কর্তৃপক্ষ এমনই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলো যে, একটি নিরস্ত্র প্রতিরোধ দমন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে তৎকালীন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন তা প্রকাশ করেছিলেন তিনটি শব্দ দ্বারাÑ নৃশংসতা, শক্তিপ্রয়োগ ও আঘাত।

২০০০ সালের  ২৮শে সেপ্টেম্বর রোয বৃহস্পতিবার  আইজ্যাক শ্যারোন কয়েক হাজার নিরাপত্তারক্ষীর ছত্রচ্ছায়ায় মসিজদুল আকছা পদির্শনে যান। এর প্রতিবাদে শুরু হয় দ্বিতীয় ইনতিফাদা। যা অব্যাহত ছিলো ২০০৬ পর্যন্ত। ইসরাইলের ধারণা ছিলো, ব্যাপক দমন-নিপীড়নের মাধমে ফিলিস্তীনীদের নিরস্ত্র প্রতিরোধ নির্র্মূল করা কঠিন হবে না। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শ্যারোন নিজেও স্বীকার করেছেন, তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, নিরস্ত্র শিশু-কিশোরদের বিক্ষোভ প্রতিরোধ এত দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর এতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কেননা তিনি ধরে নিয়েছিলেন ফিলিস্তীনের নতুন প্রজন্ম সম্পূর্ণরূপে

ধর্মনিরপেক্ষতা ও বিশ্বায়নের আবহে প্রতিপালিত হয়েছে, আপোশকামিতা, হীনমন্যতা ও ভোগপ্রিয়তাই হলো যাদের সংস্কৃতি। শ্যারোন হয়ত বুঝতে পারেননি, তিনি তার অপবিত্র পা আলআকছার পবিত্র ভূমিতে রাখার মাধ্যমে আসলে একদল সিংহশাবককে ‘লালকার’ দিয়েছেন। তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, এদের শক্তির উৎস কী? মৃত্যু এদের কাছে এত তুচ্ছ হয় কীভাবে??

অবাক হওয়ারই কথা, তবে তিনি যদি জানতেন এই নিরস্ত্র দুর্বল ফিলিস্তীনীদের শক্তির উৎস কোথায় তাহলে মোটেই অবাক হতেন না। বস্তুত এরা সেই ফিলিস্তীনী নয় যারা শান্তির নামে আরাম আয়েশের সমঝোতা বেছে নিয়ে ইহুদীসন্ত্রাসবাদের সামনে মাথা নত করেছে। এরা ফিলিস্তীনের সেই সব সাহসী সন্তান যারা আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করে না; যাদের ঈমান ও বিশ্বাস এই যে, জিহাদই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একমাত্র পথ এবং শাহাদাত হচ্ছে জান্নাত লাভের সবচে’ সহজ ও গৌরবময় পথ। এটাই হলো রহস্য, যার কারণে পাশ্চাত্যের জড়বাদী ও ভোগবাদী সভ্যতা-সংস্কৃতির ছায়ায় প্রতিপালিত কিশোর তরুন যখন খেলাধুলা, বিনোদন ও ভিডিও গেমস-এ আসক্ত হয়  তখন এই মুসলিম তরুণদল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য পরওয়ানার মত ছুটে যায়। এতে তারা কী পরিমাণ আত্মিক শান্তি ও প্রশান্তি লাভ করে তা বোঝার সাধ্য আসলেই জড়বাদের পূজারীদের নেই।

ফিলিস্তীনের কাফনপোশ কিশোর-তরুণ ও যুবকদল আমাদের সামনে তুলে ধরেছে মৃত্যুকে ভালোবাসার এবং স্বানন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার, আমাদের সেই গৌরবময় ইতিহাস যা আমরা ভুলে  গিয়েছিলাম আধুনিক সভ্যতার চাকচিক্যের মধ্যে বাস করে; আমরা ভুলে গিয়েছিলাম ‘নেকড়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সবক’ হাছিল করে।

***

ফিলিস্তীনমুক্তিসংস্থা (পি এল ও ) যারা আমেরিকা-ইসরাইলের ছত্রচ্ছায়ায় তথাকথিত স্বায়ত্ত শাসনের জগতে বাস করছেন। তারা এখন ‘শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করেছেন’। সেই সঙ্গে নীতি গ্রহণ করেছেন ঈমান ও বিশ্বাসে বলীয়ান, জিহাদ ও শাহাদাতের প্রত্যয়দৃপ্ত পথে আগুয়ান আপন জাতিরই সন্তানদের দমন-নির্মূল করার। সুতরাং প্রতিরোধ ও ইনতিফাদা থেকে তারা এখন যোজন যোজন দূরে। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে এবং প্রায় অস্তিত্বের ঝুঁকির মুখে পড়েও সময়ের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে হামাসই এখন এগিয়ে এসেছে এবং গত আটই ডিসেম্বর ফিলিস্তীনী জাতিকে তৃতীয় ইনতিফাদার ডাক দিয়েছে। এই ইনতিফাদার উদ্দেশ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তীনী জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীরূপে স্বীকৃতির যে হঠকারী ঘোষণা দিয়েছেন তার প্রতিবাদ জানানো।

এবারও মাহমূদ আব্বাস, বিন সালমান, সিসি ও নেতানিয়াহু- দের হতবাক হওয়ার পালা!  তাদের ধারণা ছিলো দীর্ঘস্থায়ী কঠোর অবরোধের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা-অনাহারে এবং নৃশংসতম দমনপীড়নের ফলে ফিলিস্তীনী জনগণের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। তাই হামাসের ইনতিফাদার ডাকে জনগণের মধ্যে হয়ত আগের মত সাড়া জাগবে না। কিন্তু না, এবার যেন আগের চেয়ে আরো বেশী সাড়া জেগেছে। মউতের নতুন দাওয়াত এবং মৃত্যুর নতুন আমন্ত্রণ পেয়ে ক্ষুধার্ত সিংহ-সাবকেরা আগের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সর্বাত্মক প্রতিরোধে। প্রতিরোধ ধীরে ধীরে এতটাই বেগবান হয়ে উঠছে যে, বিমান হামলা করেও দমন করা যাচ্ছে না। বস্তুত কোন আরবরাষ্ট্রের সামান্যতম সহযোগিতা ছাড়া, এমনকি তাদেরই ভাই মাহমূদ আব্বাসের ন্যূনতম সমর্থন ছাড়া একেবারে খালি হাতে, খালি পেটে, হামাস ও তার অনুসারীরা দখলদার ইহুদিদের বিরুদ্ধে যে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে তা সত্যি বিস্ময়কর। ফিলিস্তীনের মুজাহিদীন ঘোষণা করেছেন, ট্রাম্প তার হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহর না করা পর্যন্ত এবারের ‘কাফনপোশ ইনতিফাদা চলবেই। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা