শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

আল কুদসসংখ্যা (৩/২) | আল কুদসসংখ্যা (বিশেষ).

বেলফোর ঘোষণা ও তার উৎসব আমাদের ঘৃণা ও ধিক্কার এবং আমাদের অঙ্গিকার!

 

আজ থেকে একশ বছর আগে, ১৯১৭ সালের ২সরা নভেম্বর! আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে বিরাট লজ্জা ও কলঙ্কের দিন! বৃটিশজাতির ইতিহাসে ‘গণতন্ত্রের ভোটে যে কালি মাখা হয়’ সেই কালিমাখা দিন! মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে শুধু কান্না, আর অশ্রুপাতের দিন!! আর মুসলিম উম্মাহর যে অংশটি  প্রত্যক্ষ যুলুম-অত্যাচার এবং হিং¯্রতা ও নৃশংসতার শিকার হয়েছে তাদের জন্য কলঙ্কের কালিমাখা এবং চোখের পানিতে ভেজা এই দিনটি হলো লাল রক্তের হরফে লিখে রাখার দিন! শতকোটি উম্মারহ কান্না ও অশ্রুকে সম্বর করে আসমানের গায়বি সাহায্য প্রার্থনা করার দিন! ইস্পাতদৃঢ় অঙ্গিকারের দিন, ‘ইনশাআল্লাহ, ফিলিস্তীনের পিতৃভূমি আমরা উদ্ধার করবো! কুদসের যমীন, আল-আকছার কিবলা আউয়াল আমরা ফিরিয়ে আনবো!!

আমাদের মহানপূর্ববর্তী একবার ‘উদ্ধার করেছেন’; সেই গৌরবর-ইতিহাস যে কোন মূল্যে, সাগরপরিমাণ রক্তের বিনিময়ে হলেও আমরা ফিরিয়ে আনবো, আমরা ছিনিয়ে আনবো!

শর্ত শুধু এই যে, আমরা যেন জাগ্রত থাকি, আমরা যেন সাহস ও সাধ্যের শেষবিন্দুটুকু দিয়ে লড়াই করি, মরুভূমিতে ডাকুদের হামলায় লুণ্ঠনের শিকার কাফেলা যেমন জাগ্রত থাকে, যেমন লাড়াই করে মরণপণ।

আমরা যেন ঘুমিয়ে না পড়ি! আমরা যেন ভুলে না যাই!! আমরা শতকোটি মুসলিমের এ উম্মাহ যেন একতাবদ্ধ থাকি, যেন ছোট ছোট লোকমার মত বিভক্ত না হয়ে পড়ি!! 

إن الله لا يغير ما بقوم حتى يغيروا ما بأنفسهم

আল্লাহ তো কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।

আসমানের এ বিধান চিরন্তন বিধান! শাশ্বত বিধান!!

***

ইংরেজজাতির শঠতা, ধূর্ততা, হিংস্রতা ও নৃশংসতার কথা বহু স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন, যে যেভাবে এবং যত দূর চিনেছেন।

বাস্তবতার সবচে’ কাছের মন্তব্য যিনি করেছেন, তিনি আমাদের পাকভারত উপমহাদেশের চিরস্মরণীয়, চিরবরণীয়, চিরশ্রদ্ধার পাত্র শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসান রহ.। কারণ বৃটিশজাতি ও বৃটিশসাম্রাজ্যবাদকে তিনি যেমন চিনেছেন তেমন আর কেউ চিনতে পারেনি। তিনি বলেছেন, সাগরের তলদেশে মাছেদের মধ্যে যদি বিভেদ-লড়াই শুরু হয়, বুঝতে হবে, পিছনে ইংরেজের হাত রয়েছে, দেমাগ রয়েছে! রয়েছে ইংরেজের কূট চাল ও চক্রান্ত!!

তিনি মনে করতেন, জঙ্গলের হিংস্র জানোয়ারের ওয়াদা বিশ্বাস করা যায়, ইংরেজের ওয়াদা বিশ্বাস করা যায় না! কখনোই না।

এ ভুলটাই মুসলিম উম্মাহ করেছে বারবার! এবং উম্মাহর অসহায় কায়েদ ও রাহবার শায়খুল হিন্দ রহ.-এর চোখের সামনে!!

হিন্দুস্তানের মসুলমান! বিশেষ করে কাশ্মীরের মুসলমান! বৃটিশ, শৃগালের চেহারার ‘সরলতা’ নিয়ে বারবার ওয়াদা করেছে, আমরা বিশ্বাস করেছি; আর তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেছে শৃগালের ধূর্ত হাসি মুখে নিয়ে!

আরাকানে ঘটেছে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি; ওয়াদা, বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসের সর্বনাশ!! তারো আগে, সাদা জুব্বা ও আলখেল্লা ধারণকারী ইংরেজের বাচ্চা লরেন্স অব...! আরবদের সঙ্গে করা হয়েছিলো ওয়াদার পর ওয়াদা। মিঠা মিঠা ওয়াদা! তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো, আমরা তোমাদের জন্য সমগ্র আরবভূখ-ের স্বাধীনতার ব্যবস্থা করবো। মক্কার ‘শরীফ’ তার সমস্ত ‘শারাফাত’ ভুলে গিয়ে, আরবরক্তের আভিজাত্য বিস্মৃত হয়ে বিশ্বাসভঙ্গ করেছিলেন এবং বিদ্রোহ করেছিলেন তার ঈমান আকীদার পবিত্র বন্ধনের দ্বীনী ভাই তুর্কিদের বিরুদ্ধে! নির্মমভাবে তুর্কী ফৌজের গলা কেটেছেন, যারা দেশের ভূমি ত্যাগ করে হিজাযে অবস্থান করছিলো দুশমনের না-পাক থাবা থেকে মক্কা-মদীনার পবিত্র ভূমি রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

পরিণতি?! আমি আর কী বলবো! ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে মাত্র ৬৭টি হরফ দিয়ে ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে। আর বাকিটা নির্মম বাস্তবতা নিয়ে আমাদের চোখের সামনেই বিদ্যমান!!

***

মিশর থেকে শুরু করে সিরিয়া ও হিজায, ইরাক, পুরো আরববিশ্ব তুর্কী খেলাফতের অধীনে ছিলো ঐক্যবদ্ধ। মূলত তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহের ফলেই বিশ্বযুদ্ধে তুর্কী খেলাফত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এটা অবশ্য আলাদা বিষয় যে, যুদ্ধে তুরস্কের যোগদান করা কতটা ‘সঙ্গত’ ছিলো। সুলতান আব্দুল হমিদ অপসারিত না হলে নিশ্চিত যে, তুরস্ক এ ভুল করতো না। পরবর্তীকালে প্রকাশিত সুলতানের দিনলিপি থেকে অন্তত তাই প্রমাণিত হয়।

যুদ্ধ শেষে তুর্কী খেলাফত শাব্দিক অর্থেই হয়ে পড়ে বিশাল একটি ইমারতের ধ্বংসস্তূপ। পুরো আরববিশ্বকে ছোট ছোট টুকরোর বিশ-পঁচিশটা লোকমা করে বণ্টন করে দেয়া হয় বিজয়ী মিত্রশক্তির মধ্যে। আইনের ‘সুন্দর’ একটা আবরণ ছিলো এই মহাশঠতা ও ধূর্ততার উপর। অর্থাৎ সবকিছু করা হয় লীগ অব নেসন্স-এর ছত্রচ্ছায়ায় উদ্ভাবিত ম্যান্ডেটরি ব্যবস্থার মাধ্যমে। উদ্দেশ্য ছিলো, বিশেষ করে তুর্কী খেলাফতের অধীন অঞ্চলগুলো লীগ অব নেসন্সের মাধ্যমে বিজয়ী মিত্রজোটের শাসনাধীনে অর্পণ করা। বলাবাহুল্য, ভিতরের অকথিত উদ্দেশ্য ছিলো ফিলিস্তীন!

ম্যান্ডেটরি ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি ছিলো, এই দেশগুলো এখনই স্বাধীনতার উপযুক্ত নয়। স্বাধীনতা অর্জন করা, রক্ষা করা ও ভোগ করার জন্য যে ন্যূনতম যোগ্যতা দরকার তা এ জনগোষ্ঠীগুলোর তা অর্জন করা পর্যন্ত যুদ্ধ জয়ী বড় শক্তিগুলোর তত্ত্বাবধানে থাকা দরকার। সেই অনুসারে ফিলিস্তীনকে দেয়া হয় বৃটিশ এম্পায়ারের অধীনে। আমাদের মতে মূল বিষয়টা অবশ্যই সঠিক। কারণ আরবজনগোষ্ঠীর যদি আসলেই কোন ভূ-রাজনৈতিক ‘সমঝবুঝ’ ও কূটনৈতিক পরিপক্বতা থাকতো তাহলে কিছুতেই এত সহজে তারা বৃটিশ কূটচালের শিকার হতো না এবং তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মত আত্মঘাতী কাজ করতো না। আসলেই তারা ছিলো ‘না-বালিগ’। অর্থাৎ রাজনীতি ও কূটনীতির ময়দানে ‘অনূর্ধ্ব ১৫দলের খেলোয়াড়’।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একথাটা বড় শক্তিগুলোর আগে মনে পড়েনি কেন? আরবনেতাদের তা আগে বলা হয়নি কেন?

ম্যান্ডেটরি ব্যবস্থার যে দলীল এখনো লীগ অব নেসন্স-এর দস্তাবেজের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে, তাতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তাদের স্বার্থের পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের কর্তব্য শুধু ঐ ভূখ-ের অধিবাসীরা স্বয়ং-সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তাদের শুধু পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান।

এর অর্থ হলো, ম্যান্ডেটর বা তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে বৃটিশ এম্পায়ারের কোন ক্ষমতা বা অধিকার ছিলো না ফিলিস্তীনের ভূখ-ে ইহুদিদের ‘জাতীয় বাসভূমি’ তৈরীর প্রতিশ্রুতি দেয়ার।

***

১৯১৫-এর জুলাই থেকে ১৯১৬ এর মার্চ পর্যন্ত শরীফের সঙ্গে ম্যাকমোহনের দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হয়। তাতে স্থির করা হয়, শরীফ তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন, বিনিময়ে তার নেতৃত্বে ইরাক, সিরিয়া ও জাযীরাতুল আরবের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে।

মাত্র কয়েক মাস পর বিশাল সা¤্রাজ্যের অধিপতি হওয়ার দিবাস্বপ্নে বিভোর শরীফ ১৯১৬ এর ১০ই জুন তুর্কী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বৃটিশদের পক্ষ গ্রহণ করেন। বস্তুত এ আরববিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমেই তুর্কী খেলাফতের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে এবং বহু বছর পর বৃটিশের জন্য ফিলিস্তীনের ‘পাকা আপেলে’ কামড় দেয়ার সুযোগ তৈরী হয়ে যায়।

এর মধ্যে ‘দুর্ঘটনাক্রমে’ বেলফোর ঘোষাণা ফাঁস হয়ে যায়। প্রতারিত আরবনেতারা তখন এমনই দিকভ্রান্ত যে, মোহভঙ্গ হলেও কিছুই করার ছিলো না দুর্বল কণ্ঠের প্রতিবাদ ছাড়া। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় বৃটিশ আবারো আরব নেতৃবৃন্দের সামনে আশ্বাসের ‘ঝুড়ি’ নিয়ে হাজির হয়। ১৯১৮-এর শুরুতেই কায়রোয় অবস্থিত বৃটিশ-আরব সংস্থার প্রধান ডেভিড জর্জ হোগার্থ-এর মাধ্যমে তাদের আশ্বাস দেয়া হয় যে, ফিলিস্তীনে ইহুদীদের আগমন এ অঞ্চলের আরবজনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণœ করবে না। ১৫ই জানুয়ারী বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন যে, আরবভূখ-ের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আরবজনগোষ্ঠীর স্বরাজ প্রাপ্তির অধিকার বৃটেন স্বীকার করে। এবছরেরই ৮ই ফেব্রুয়ারী বেলফোর ঘোষণার ‘নায়ক’ বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর একই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে শরীফকে জরুরি তারবার্তা প্রেরণ করেন।

বলাবাহুল্য, তখন প্রতিশ্রুতি শুনে যাওয়া ও বিশ্বাস করে যাওয়া ছাড়া আরবনেতৃবৃন্দের আর কিছুই করার ছিলো না। প্রথম থেকেই তারা ভুলে বসেছিলেন আধুনিক কুটনীতির পয়লা সবক, ‘গ্যারান্টি ছাড়া প্রতিশ্রুতির কানাকড়ি মূল্য নেই।’ অন্তত ‘সহজ সরল’ আরবনেতৃবৃন্দ যদি বৃটিশ জেনারেলের গর্বিত ঘোষণাটা স্মরণ রাখতে পারতেন! ৯ই ডিসেম্বর জেরুসালেমের দখল সমাপ্ত হওয়ার পর সেখানে দাঁড়িয়ে জেনারেল এলেনবি বলেছিলেন, ‘আজ সমাপ্তি ঘটলো ক্রুশেডের।’

জেনারেল এলেনবি তো বেঁচে নেই। আমার কথা তার কানে যাবে না। তাই জেনারেলের উত্তরসূরীদের উদ্দেশ্যে বলছি। আগের ক্রুশেড সমাপ্ত হয়েছে মহান গাজী ছালাহুদ্দীনৈর দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের বহু শতাব্দী পর। কিন্তু জেনারেল এলেনবি যা বুঝতে পারেননি তা হলো, নতুন ক্রুশেড সেদিন থেকে শুরু হয়েছে এবং আগের মত এবারও তাদেরই হাতে শুরু হয়েছে, যার পরিসমাপ্তি ঘটবে নতুন গাজী ছালাহুদ্দীনের আগমনের মাধ্যমে। হয়ত মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হবে কয়েক শতাব্দী। অপেক্ষায় থাকুন জেনারেল এলেনবি!

***

১৯২২ সালে লীগ অব নেসন্সের পক্ষ হতে বৃটেন  ফিলিস্তীনের ম্যান্ডেট লাভ করে। ‘আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করে বৃটেন এ গুরুদায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেয়।’ এবং প্রথম বৃটিশ হাইকমিশনার-রূপে নিয়োগ দান করে জায়নবাদী ইহুদি স্যার হার্বাট স্যামুয়েলকে। বলাবাহুল্য, তিনি ও পরবর্তী প্রত্যেক হাইকমিশনার বেলফোর ঘোষণার পিছনের যে নীলনকশা, সেটাই বাস্তবায়ন করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। স্বজাতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা দোষের কিছু তো নয়! তদ্রুপ মুসলিম হয়ে মুসলিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা বিশ্বাসঘাতকতা প্রশংসার কিছু তো নয়!!

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আরবজনগণের কী দোষ? তারা কেন নেতৃবৃন্দের অপকর্মের খেসারত দেবে? আসল কথা, কোন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর পক্ষে রাজনৈতিক অসচেতনতার চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছুই হতে পারে না। মানুষ যখন ভাবে, তাদের একমাত্র চিন্তা হলো রুটি-গোশত। বাকি. শাসকরা যা খুশী তাই করুন। এমন জাতির ভাগ্যে দুর্ভোগ ও দুর্গতি ছাড়া আর কী হতে পারে?

ফিলিস্তীনের আরবজনগোষ্ঠীর অবশ্য বুঝতে দেরী হয়নি যে, তাদের অগোচরে কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে! তখন শুরু হয় অপরিকল্পিত বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রাম! অনেক জানের কোরবানী হলো তাতে, কিন্তু ...

১৯৩৬ থেকে ৩৯ পর্যন্ত বিদ্রোহ এমনই ব্যাপক আকার ধারণ করলো যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে ভাবতে বাধ্য হলো।  তবে এবারো তাদের অস্ত্র সেই পুরোনো ‘আশ্বাসের ঝুড়ি’

বৃটিশ সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, দশবছরের মধ্যে ফিলিস্তীনের স্বাধীনতা এবং পাঁচবছরের মধ্যে  ইহুদি অনুপ্রবেশ বন্ধের ব্যবস্থা করা হবে।

‘নেতার চেয়ে জনতা’ বেশী নির্বোধ, এটাই তো স্বাভাবিক! কারো মনে প্রশ্ন জাগলো না, দশ বছর কেন, পাঁবছর কেন. এখনই নয় কেন? এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

তখন প্রতারিত হয়েছে নেতা, এবার হলো আরবজনতা। সেই দশ বছর, আর পাঁচবছরের ‘সূর্যোদয়’ কখনো ‘ঘটেনি’ দুর্ভাগা ফিলিস্তীনের দিগন্তে। তখন থেকে এখন শুধুই রক্ত ঝরছে! নতুন ক্রুশেড শুধুই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। প্রতিরোধ সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন ১৯৪৮ সালে ইরসাইল -আরব যুদ্ধ হলো তখন দেখা গেলো ইতিমধ্যে ফিলিস্তীনের ৭৭ ভাগ জমি ইহুদিদের দখলে চলে গিয়েছে, বৃটিশদের ম্যান্ডেট লাভের শুরুতে যা ছিলো মাত্র  দুই ভাগ! ঐ বছরই বেলফোর ঘোষণার ৩১ বছর পর আমেরিকা ও বৃটেনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ফিলিস্তীনীদের উৎখাত করে তাদেরই কাজ থেকে ছিনিয়ে নেয়া ভূখ-ে আত্মপ্রকাশ করে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল।

আজ, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল একটি নির্মম বাস্তবতা! শুধু তাই নয় আমেরিকার প্রশ্রয়ে ইসরাইল আজ অলিখিতভাবে পারমাণবিক শক্তিরও অধিকারী। তবে আরববিশ্ব ইসলাইলের পারমাণবিক বোমার ভয়ে আজ ভীত নয়, ভীত হলো ইরানের পারমাণবিক বোমার ভয়ে যা অর্জন করা ইরানের জন্য এখনো সুদূরপরাহত। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, সউদী আরবের মত দেশ এখন ইসরাইলের মুখ চেয়ে কথা বলে! মিশর আজ ইসরাইলের ইশারায় চলে। আর  ইরাক ও সিরিয়া! এ বিষয়ে কথা যত কম বলা যায় তত ভালো।

***

একশ বছর পার হয়েছে। সেই ধিকৃত বৃটিশসাম্রাজ্যবাদ আর নেই, কিন্তু রয়ে গেছে বৃটেন, বৃটেনের মহারানী এবং বৃটিশ সরকার। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং ইসরাইলের বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু যৌথভাবে বেলফোর ঘোষণার শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করেছেন লন্ডনের মাটিতে। বলাবহুল্য, এটা ছিলো মুসলিম উম্মাহর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার শামিল, যে ঘা কখনো শুকোয়নি; যে ঘা থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। ইতিহাস নিশ্চয় প্রমাণ করবে, বৃটিশ সরকার কাজটা ভালো করেনি!

প্রধানমন্ত্রী থেরেসা উৎসব অনুষ্ঠানে গর্ব করে বলেছেন, বেলফোর ঘোষণা ও তার বাস্তবায়ন বৃটিশজাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। অবশ্য বিরোধী লেবারপার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, ঐ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিচ্ছি না। তাতে বৃটিশজাতির গর্ব করার কিছু নেই। কারণ এর মাধ্যমে ফিলিস্তীনের নিরপরাধ জনগোষ্ঠীকে শেষ করে দেয়া হয়েছে।

যদিও বিরোধী নেতা করবিনের এই বিরোধিতার বিশেষ কোন মূল্য নেই। কারণ তাতে ঘটনার প্রবাহ কোনভাবেই পরিবর্তিত হবে না। তবু আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই ‘একটি দলিল সৃষ্টি হয়ে থাকলো’ এজন্য; যেমন সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে ধন্যবাদ জানিয়েছি একই কারণে, ইরাকপ্রশ্নে তার ভুল স্বীকার করা উপলক্ষে।

বেলফোর ঘোষণার মধ্যে গর্ব করার কী আছে মিসেস থেরেসা! এটা আপনার জাতির জন্য কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়! স্বীকার করি, ইহুদিদের প্রতি অবিচারের দায় ছিলো ইউরোপের। কারণ তাদের স্বীকৃতি অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলো। হয়ত সত্য, কিন্তু তার দায় কেন ভোগ করবে ফিলিস্তীন, ফিলিস্তীনের দুর্ভাগা জনগন, আরব-বিশ্ব এবং মুসলিম উম্মাহ্!? তাছাড়া কী প্রয়োজন ছিলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ইহুদিদের ফিলিস্তীনে এনে জড়ো করার! করতেই যদি হয়, ইউরোপের কোন ভূখ-ে নয় কেন? বেলফোর ঘোষণায় বলা হয়েছিলো, ‘এমন কিছু করা হবে না যাতে ফিলিস্তীনের অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণœ হয়। সেই প্রতিশ্রুতির উপর বিশ্বাসের মূল্য আজ দিতে হচ্ছে ফিলিস্তীনের আরবজনগোষ্ঠীকে, আর আপনি আজ উদযাপন করছেন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উৎসব! ধিক আপানাকে মিসেস থেরেসা! ধিক্কার আপনার জাতিকে!! আর আমার উম্মাহর কাছে উদাত্ত আহ্বান, আর ঘুমিয়ো না, আর ভুল করো না। ঐক্যবদ্ধ হও জেনারেল এলেনবির শুরু করা নতুন ক্রুশেডের সুসমাপ্তি অর্জনের জন্য।