আল কুদসসংখ্যা (৩/২)

তোমাদের পাতা

আরাকানের ইতিহাস

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

লিখেছেন ইবনে মিছবাহ

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

বার্মার ইতিহাসে ওয়ালী খাঁ-কে উলু খেঙ নামে উল্লেখ করা হয়। ওয়ালী খাঁর বিষয়ে ইতিহাসের মীমাংসিত সত্য এই যে, বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ তাকে বিশ হাজার সৈন্য দিয়ে রাজ্যপুনরুদ্ধারে নরমিখলাকে সাহায্য করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। আর তিনি চেঙ্কা নামক এক আরাকানী সামন্ত-এর সঙ্গে যোগসাজস করে নরমিখলাকে বন্দী করেন এবং নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন।

উপরের বর্ণনাটুকু ইতিহাসের মীমাংসিত সত্য। অর্থাৎ সমস্ত ঐতিহাসিক এ বর্ণনার সঙ্গে একমত। তবে ওয়ালী খাঁ কোন্ এলাকায় নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেছিলেন, এটা এখনো ইতিহাসের অমীমাংসিত বিষয় বলেই গণ্য হয়ে আসছে। কারো কারো মতে তিনি আরাকানী সামন্ত চেঙ্কা-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরাকান ভূখণ্ডেই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ভাষায় মিন বিন এবং ফারসি ভাষায় জৌবুক শাহ বা মুবারিজ শাহ নাম ধারণ করে সিংহাসনে অভিষেক গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই মতটির পক্ষে, উদ্ধারকৃত কয়েকটি মুদ্রার ভুল পাঠোদ্ধার ছাড়া শক্তিশালী কোন প্রমাণ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বরং এর বিপক্ষের প্রমাণগুলো খুবই শক্তিশালী। প্রথমত মাত্র বিশহজার সৈন্য নিয়ে, রাজ্য উদ্ধারে আসা একজন রাজাকে বন্দী করা, তারপর শুধু একজন সামন্ত-এর সাহায্যে সুদূর আরাকান-ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত প্রতাপশালী বার্মারাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় ও রাজ্যপ্রতিষ্ঠা কষ্টকল্পনা বলেই মনে হয়। তাছাড়া মিন বিন নামের একই রাজা মুবারিজ শাহ ও জৌবুক শাহ এ দুই উপাধি ধারণ করবেন, এটা খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়।

পক্ষান্তরে বিভিন্ন সহায়ক যুক্তির আলোকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, ওয়ালী খাঁ আরাকান ভূখণ্ড নয়, বরং বাংলার সালতানাতের অধীন চট্টগ্রামের ভূখণ্ডেই নিজের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্টা করেছিলেন।

ইতিহাসের উপরোক্ত মতভিন্নতার ভিত্তি হলো উদ্ধারকৃত কতিপয় মুদ্রা, যা ওয়ালী খাঁ-কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিলো। এই মুদ্রাগুলোর পাঠোদ্ধার ছিলো খুবই জটিল। উদ্ধারকৃত মুদ্রাগুলোর প্রথম পিঠে আরাকানী ভাষায় লেখা রয়েছে মিন বি(ন); দ্বিতীয় পিঠে ফারসি ভাষায় রয়েছে ‘সুলতান চিত্তাকানু মুবারিজ শাহ। উল্লেখ্য, যারা মিন বিন পাঠোদ্ধার করেছেন তাতে ‘বি’ পর্যন্ত লেখা স্পষ্ট রয়েছে। পক্ষান্তরে ‘ন’ হরফটি স্পষ্ট নয়। মিন অর্থ রাজা। সুতরাং বলা যায়, মুদ্রার প্রথম পিঠে রাজা শব্দটির উল্লেখ থাকলেও রাজার নামের উল্লেখ নেই।

ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, রাজা মিন বিন-এর মুসলিম নাম ছিলো জৌবুক শাহ। আর তার রাজত্বকাল ছিলো ১৫৩১ থেকে ১৫৫৩ পর্যন্ত। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়; মোট নয়টি মুদ্রার মধ্যে পাঁচটি উদ্ধার করেন এম রবিনশন এবং এল এ শৌ। তিনটি মুদ্রা উদ্ধার করেন সান খা আউঙ্গ। পক্ষান্তরে একটি মুদ্রা উদ্ধার করেন এ পি ফেয়ার।

এ পি ফেয়ারের একমাত্র মুদ্রাটিতে সালের পাঠোদ্ধার করা হয়েছে  ৭৬২ বা ৭৯২।

বলাবাহুল্য যে, এটি যদি মঘী সন হয় তাহলে ১৪০০ (৭৬২+৬৩৮) বা ১৪৩০ (৭৯২ + ৬৩৮) খৃস্টাব্দ হয়। পক্ষান্তরে হিজরী সন হলে ১৩৬১ বা ১৩৯০ খৃস্টাব্দ হয়। সুতরাং কোনভাবেই এটি মিন বিন ওরফে জৌবুক শাহর প্রবর্তিত মুদ্রা হতে পারে না, যিনি আরাকানের শাসক ছিলেন। এভাবে প্রমাণিত হলো যে, মিন বিন ওরফে জৌবুক শাহ আমাদের আলোচিত ওয়ালী খাঁ কিছুতেই নন।

আরেকটি বিষয়, মিন বিন এর মুসলিম নাম ছিলো জৌবুক শাহ। পক্ষান্তরে মুদ্রাগুলোতে পাঠোদ্ধারকৃত নাম হলো মুবারিজ শাহ। সুতারং মুদ্রাগুলো যদি রাজা মিনবিনকর্তৃক প্রবর্তিত হয় তাহলে রাজা মিন বিন-এর যুগপৎ দু’টি মুসলিম নাম ধারণ অপরিহার্য হয়ে যায়, যা তৎকালীন প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

পক্ষান্তরে মুদ্রার দ্বিতীয় পিঠে পাঠ, ‘সুলতান চিত্তাকানু (চতকঁও) মুবারিজ শাহ যদি রাজা মিন বিন না হন, যা উভয়ের সময়কালের দিক থেকে কোনভাবেই সম্ভব বলে মনে হয় না, তাহলে তিনি অবশ্যই চট্টগ্রামে রাজ্যপ্রতিষ্ঠাকারী (সুলতানে চতকঁও) ওয়ালী খাঁ ছাড়া আর কেউ নন, যার সময়কালের সঙ্গে মুদ্রায় উল্লেখিত সন মিলে যায়।

ইতিহাসের এই দ্বিতীয় মতটির সমর্থনে আমরা প্রফেসর আব্দুল করীমের গবেষণার কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনি বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত নয়টি মুদ্রার নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পাঠোদ্ধার সম্পন্ন করেছেন, যা সুলতানে চতকঁও মুবারিজ শাহকৃর্তক প্রবর্তিত। বিভিন্ন তথ্যউপাত্তযোগে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি ওয়ালী খাঁ এবং মোবারিজ শাহ সুলতানে চতকঁও একই ব্যক্তি।

মোট কথা এই বরেণ্য ঐতিহাসিক এবং অন্য আরো বহু ঐতিহাসিকের মতে, সেনাপতি ওয়ালী খাঁ বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহকর্তৃক নরমিখলার সাহায্যার্থে প্রেরিত হয়ে চট্টগ্রাম উপনীত হন। এখানে এসে সেনাপতি ওয়ালী খাঁর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। তিনি আরাকানের সামন্ত চেঙ্কার প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে বিদ্রোহ করেন এবং চট্টগ্রামের ভূখণ্ডে নিজেকে সুলতানে চতকঁও বলে ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে আরাকানী সামন্ত চেঙ্কা এভাবে সেনাপতিকে সাহস যুগিয়েছেন যে, নরমিখলাকে বন্দী করার বিনিময়ে বার্মারাজ তাকে বাংলার সুলতানের বিরুদ্ধে সাহায্য করতে প্রস্তুত হবেন। এই সকল কর্মকাণ্ডের পিছনে আরাকানী সামন্ত চেঙ্কা-এর উদ্দেশ্য ছিলো বাংলার সুলতানের আক্রমণ থেকে আরাকানরাজ্যকে সুরক্ষা দান করা।

বলাবাহুল্য, বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে চেঙ্কা-ওয়ালীখার চক্রান্ত অঙ্কুরেই নির্মূল হয়ে যায়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজা নরমিখলা বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে চলে আসেন এবং সুলতানকে পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন।

সুলতান তাঁর নিজস্ব গোয়েন্দা সূত্রে আগেই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন এবং কালবিলম্ব না করে সামরিক অভিযানের আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। বাংলার সুলতান এবার নরমিখলার সাহায্যার্থে তাঁর অতি বিশ্বস্ত সেনাপতি সিন্ধি খানের নেতৃত্বে ত্রিশহাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন।

সেনাপতি সিন্ধি খান বিশেষ কোন প্রতিরোধ ছাড়াই বিশ্বাসঘাতক ওয়ালী খাঁকে পরাজিত করেন এবং বন্দী অবস্থায় তাকে হত্যা করেন। তাকে জীবিত রাখা সেনাপতি সিন্ধি খান নিরাপদ মনে করেননি। বিশেষ করে তার আশঙ্কা ছিলো, নরমিখলা যেমন পালিয়ে গৌড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তেমনি ওয়ালী খাঁ পালিয়ে আরাকানে আশ্রয় নিতে পারেন। সুতরাং তার দৃষ্টিতে দুষ্ট ক্ষত মূল থেকে কেটে ফেলাই ছিলো বিচক্ষণতার দাবী।

সিন্ধিখানের আরাকানবিজয়ের স্মৃতিরূপে রাজধানী শহর ¤্রােহং-এ সিন্ধিখানের মসজিদের ধ্বংসা -শেষ এই সেদিন পর্যন্ত বিদ্যমান ছিলো, যার উল্লেখ বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়।

***

এখানে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করা যায় যে, ওয়ালী খাঁ, চট্টগ্রামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করুন বা আরাকানের ভূখন্ডে তাতে ইতিহাসের গতিধারায় তেমন কী পার্থক্য সৃষ্টি হয়, যার কারণে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এত জটিল পুরাতাত্ত্বিক জটিল আলোচনার অবতারণা করতে হয়?

উত্তর এই যে, বিষয়টি আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে ছিলো অত্যন্ত সংবেদনশীল। কারণ ওয়ালী খাঁর আরাকানের ভূমিতে অবৈধ রাজ্যদখল প্রমাণিত হলে আরাকানের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সামনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য তা হয়ে পড়ে কলঙ্কজনক বিষয়। তাই ইতিহাসের ভ্রান্তি নিরসন করা ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

বিশ্বাসঘাতক ওয়ালী খাঁ-এর তথাকথিত সালতানাত এক বছরের বেশী স্থায়ী হতে পারেনি। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের পর সেনাপতি সিন্ধি খান আরাকান অভিযানে অগ্রসর হন। বার্মীরাজের বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর সিন্ধি খান  রাজা নরমিখলার অনুকূলে আরাকান জয় সম্পন্ন করেন।

বাংলার সুলতানের সাহায্যে রাজা নরমিখলা আরাকানের রাজ্য ও সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার পর চারবছর বেঁচে ছিলেন। সুতরাং তার রাজত্বকাল ছিলো ১৪৩০ থেকে ১৪৩৪ খৃ.

রাজা নরমিখলা যে চব্বিশ বছর

বাংলার সুলতানের আশ্রয়ে রাজধানী গৌড়ে অবস্থান করেছেন ঐ দীর্ঘ সময়কাল তার জীবন ও জীবনধারা এবং তার আকীদা ও চিন্তা-বিশ্বাসের উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করবে, এটাই ছিলো স্বাভাবিক। ইতিহাসের বিবরণ থেকে জানা যায়, তিনি যখন আরাকানে ফিরে যান এবং সিংহাসন গ্রহণ করেন তখন তিনি চিন্তাচেতনায় এবং আচরণ ও চরিত্রে হয়ে উঠেছিলেন অন্য এক নরমিখলা, যা আগের জীবন থেকে ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোন কোন সূত্রমতে তিনি ইসলামধর্মও গ্রহণ করেছিলেন, যদিও এর পক্ষে খুব জোরালো কোন তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সমাজ-ব্যবস্থার সৌন্দর্য দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, এটা ইতিহাসের প্রমাণিত সত্য।

এটা আগেই বলা হয়েছে যে, নরমিখলা ছিলেন লেঙ্গিয়েত কেন্দ্রিক রাজাদের মধ্যে শেষ রাজা। সিংহাসন পুনরুদ্ধারের পর তিনি লেঙ্গিয়েত থেকে রাজধানী ¤্রােহং-এ স্থানান্তরিত করেন। তার এ সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। কেননা দীর্ঘ দিন রাজধানী থাকার সুবাদে লেঙ্গিয়েত তখন ক্ষমতালোভী, রাজনৈতিক সুবিধাকামী কুচক্রীদের আখড়ায় পরিণত হয়ে পড়েছিলো। তিনি নিজেও তো একসময় রাজধানীর ক্ষমতালোভী চক্রের একজন ছিলেন। সুতরাং অবস্থা অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা তার পক্ষে কঠিন ছিলো না।

বস্তুত তার মাধ্যমেই ম্রোহংকেন্দ্রিক ¤্রাউক উ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি এবং তার পরবর্তী কয়েকজন রাজা বাংলার সুলতানের করদরাজা হিসাবে আরাকান শাসন করেছেন। পরবর্তী রাজাগণ বাংলার অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন-ভাবে রাজ্যশাসন করে গিয়েছেন। অবশ্য বাংলার সুলতানদের পক্ষ হতেও আরাকানকে করদরাজ্য হিসাবে বহাল রাখার চেষ্টা করা হয়নি। মিত্ররাজ্য হওয়াকেই তারা যথেষ্ট মনে করেছেন।

আরাকানরাজ নরমিখলা বাংলার সুলতানদের অনুকরণে যে মুদ্রা প্রবর্তন করেন তাতে মুদ্রার একপিঠে ফারসি অক্ষরে কালেমা এবং নিজের জন্য বৌদ্ধনামের পাশাপাশি মুসলিম নাম লেখার রীতি প্রবর্তন করেন। পরবর্তী রাজাগণ বাংলার অধীনতা থেকে মুক্ত হলেও কালিমা ও মুসলিম নাম অঙ্কিত করার এ ধারা অব্যাহত রাখেন।

রাজা নরমিখলা যে চারবছর জীবিত ছিলেন, বাংলার সুলতানের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রেখেছিলেন এবং পরবর্তী শাসকদের প্রতিও তার উপদেশ ছিলো কৃতজ্ঞতা রক্ষা করার। ¤্রাউন উ রাজবংশের প্রত্যেক রাজা তাদের প্রতিষ্ঠাতাপুরুষের উপদেশ রক্ষাও করেছেন। তাই বলা হয়, এ রাজবংশের সুদীর্ঘ শাসনকাল আরাকানের মুসলমানদের জন্য ছিলো খুবই অনুকূল ও শান্তিপূর্ণ।

আগেও বলা হয়েছে, রাজা নরমিখলা রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ ছিলেন, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিলো না। তো সিংহাসন পুনরুদ্ধারকারী রাজা নরমিখলা একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ পদক্ষেপ এই গ্রহণ করেন যে, বাংলার সুলতানের পক্ষ হতে তার সাহায্যের জন্য প্রেরিত ত্রিশহাজার সৈন্যের বিরাট বাহিনীকে নিজের কাছে রাজধানী ¤্রােহং-এ রেখে দেন। এজন্য তিনি বাংলার সুলতানের সদয় অনুমতি প্রার্থনা করেন। সুলতানও একসময়ের আশ্রিত রাজার অনুরোধ রক্ষা করেন। কারণ বাংলার সুলতানের অজানা ছিলো না যে, নরমিখলার রাজত্ব নির্বিঘ্ন ও সুরক্ষিত করার জন্য ঐ বাহিনীর রাজধানী ¤্রােহং-এ অবস্থান করা কতটা জরুরি ছিলো, আর কতটা জরুরি ছিলো বাংলার সালতানাতের দক্ষিণ সীমান্ত নিরাপদ রাখার জন্য আরাকানরাজ্যের মিত্রতা।

ত্রিশহাজার সৈন্য রাজধানীতে যেমন অবস্থান করেছে তেমনি বিয়েশাদি ও সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে স্থানীয় মুসলিম জন-গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা একীভূত হয়ে গিয়েছিলো। ¤্রাউক উ বংশের রাজত্বকালে অনুকূল পরিবেশের কারণে বাংলা থেকে, বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেও বহু মানুষ আরাকানে বসতি স্থাপন করেছেন। বস্তুত এটা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ছিলো না। ইতিহাসের শুরু থেকেই সমগ্র মানবজাতির মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিলো এ অভিবাসন-প্রবণতা।

¤্রাউক উ রাজবংশ ১৪৩০ থেকে ১৬৮৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ দু’শ চুয়ান্ন বছর আরাকান শাসন করেছে। এককথায় যদি বলতে হয় তাহলে আমরা বলবো, ‘মুসলিমনির্ভরতা ছিলো ¤্রাউক উ রাজবংশের শাসননীতি। আরাকানে বাঙ্গালী, আরব, ইরানী ও স্থানীয় মুসলিমদের মিশ্রণে আলাদা পরিচয়সত্তা নিয়ে যে মুসলিম জনগোষ্ঠী তখন গড়ে উঠেছিলো তাদের মধ্য হতে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শুরু করে সৈন্যমন্ত্রী, রাজকোষমন্ত্রী, সেনাপতি, কাজী ও বিচারক এবং উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরূপে নিযুক্ত করা হতো। এমনকি বাংলা থেকে সদ্য আগত যোগ্য ব্যক্তিদেরও পূর্ণসমাদরের সঙ্গে রাজকার্যে নিযুক্ত করা হতো, আর তারাও যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেন।

উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারিদের পাশাপাশি সাধারণ স্তরেও বিপুল সংখ্যক মুসলিম কমচারী নিযুক্ত করা হতো।

উপরোক্ত শাসননীতির রাজনৈতিক প্রভাব যেমন সুদূরপ্রসারী ছিলো তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও ছিলো সুগভীর।

আরাকান রাজসভার মুসলিম রাজকর্মচারিগণ রাজ্যপরিচালনার পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা রাখেন। অর্থাৎ মুসলিম (এবং কিছু সংখ্যক অমুসলিম) লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এটা ছিলো আরাকান রাজসভার এমনই এক অনন্য অবদান যা বাংলা-সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এ ইতিহাস তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, মধ্যযুগে বাংলাসাহিত্যের যা কিছু চর্চা ও বিকাশ তা সম্পন্ন হয়েছে মূলত বাংলার ইলিয়াস শাহী সুলতানী আমলের শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার কল্যাণে। এটাও ইতিহাসের স্বীকৃত সত্য যে, গৌড়ের পতনের পর আরাকানের রাজসভা ও মুসলিম আমত্যগণই ছিলেন বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র, যা সপ্তদশ শতকে চরমোৎকর্ষ লাভ করে। ঐ শতকের আরাকান-রাজসভার উল্লেখযোগ্য কবিব্যক্তিত্ব হলেন দৌলত কাজী, আলাওল, মরদন নাসরুল্লাহ খান প্রমুখ।

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে এখানে আমরা ¤্রাউক উ রাজবংশের  রাজত্বকালের পর্ববিভক্তি সম্পর্কে আলোচনা সেরে নিতে চাই। ১৪৩০ খৃ. হতে ১৫৩০ হচ্ছে এ বংশের রাজত্বের প্রথমপর্ব। এপর্বের এগারজন রাজা গৌড়ের সুলতানদেন কর প্রদান করে রাজ্যশাসন করেছেন। অর্থাৎ এই একশ বছর আরাকান ছিলো গৌড়ের করদরাজ্য।

১৫৩০ খৃ. ¤্রাউক উ বংশের দ্বাদশ পুরুষ মিন বিন জৌবুক শাহ এই মুসলিম নাম ধারণ করে ¤্রােহং-এর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনিই প্রথম আরাকানের ‘করদরাজ্য-পরিচিতি’র বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিজেকে স্বাধীন নৃপতি বলে ঘোষণা করেন।

এসময় মোঘলশক্তির ভয়ে ভীত জৌবুক শাহ একটি কাজ করেন, ঐ দিক থেকে সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করার প্রস্তুতিরূপে পুর্তগীজ প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আরাকানের মগ বৌদ্ধদের দ্বারা একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। এক্ষেত্রে তিনি সুপরিকল্পিতভাবেই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে যান। উল্লেখ্য, পুর্তগীজরা তখন উচ্চ-স্তরের নৌশক্তিরূপে গণ্য হতো।

মগেরা নৌযুদ্ধে পারদর্শী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলদস্যুবৃত্তিতেও হাতপাকাতে শুরু করে। বস্তুত এটা ছিলো পূর্ণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জলদস্যুবৃত্তি. যার নযির পৃথিবীর ইতিহাসে কমই পাওয়া যায়।

মোটকথা জৌবুকশাহের আমলে পুর্তগীজ ও মগ মিলে বঙ্গোপ-সাগরের জলসীমায় জলদস্যু-বৃত্তিতে পুরোদমে মেতে ওঠে।

ঐ সময়কালে বাংলার দক্ষিণ সীমান্তে এবং মেঘনার মোহনা থেকে উজান বেয়ে বহুদূর পর্যন্ত দুই তীরের সুবিস্তীর্ণ জনপদে যে লোমহর্ষক ও মর্মবিদারক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো জলদস্যুদের হিং¯্রতা, নৃশংসতা ও পাশবিক তা-বের কারণে তা শুধু ইতিহাসের পাতায় পাঠ করলেই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। হত্যা, লুণ্ঠন ও ব্যাপক জ্বালাও পোড়াও এর মাধ্যমে তারা জনপদের পর জনপদ উজাড়-বিরান করে ফেলতো। অসংখ্য নারী-পুরুষ  বন্দী করে তারা পাচার করতো আরাকানে। সেখানে এই হতভাগ্য বনী আদম দাস-দাসীরূপে বিক্রি হতো এবং বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো। বিশেষ করে তাদেরকে গভীর ও দুর্গম বনজঙ্গল পরিষ্কার করা এবং কৃষি-উপযোগী করে তোলার কঠিন কাজে লাগানো হতো। এভাবে আরাকানের গভীর বনে জঙ্গলে বাংলার কত দুর্ভাগা নর-নারীর কঙ্কাল যে মাটির সঙ্গে মিশেছে তার খবর এখন আর ইতিহাসের কাছেও নেই।

যদিও ঘটনাগুলো হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষক তবু এটা সত্য যে, এভাবে মগদস্যুদের দ্বারাও বাংলার নি¤œাঞ্চল থেকে বহু বাঙ্গালী মুসলমান আরাকানে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এক বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে আবাদ হয়েছে।

এ পর্যন্ত উপরে যতগুলো ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে তার থেকে গড়ে ওঠা মুসলিম জনশ্রেণীই হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তবে মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন সময় জনশক্তির স্থানান্তরকালে সংখ্যানুপাতে অমুসলিমরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে অমুসলিমদের সংখ্যা শুরুতেও কিছু পমিাণে ছিলো, এখনো আছে।

উপরের আলোচনার পরিশিষ্টরূপে আরাকানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উদ্ভবের বিভিন্ন সময়কালকে আমরা মোটামুটি চারটি ভাগে বিভক্ত করে পেশ করতে চাই। তারপর আমরা রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কেও সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

প্রাচীনকালে আরাকানের উপকূলে আরবদের বাণিজ্যজাহায ডুবে যাওয়ার যে ঘটনা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই ছিলো মূলত আরাকানের জনপদে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রথম উদ্ভব। তাই বলা যায়, রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর মূল বাংলা ও বাঙ্গালী নয়, বরং আরব ও আরবীয় রক্তধারাই হলো তাদের মূল ধারা। পরবর্তীকালে অবশ্য তাতে বাঙ্গালী রক্তধারাও মিশ্রিত হয়েছে। আরাকানের চন্দ্ররাজ-বংশের সংরক্ষিত ইতিহাস হচ্ছে ‘রদ্জাতুয়ে’। তাতে রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০) উক্ত জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছিলো বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

কোন কোন ঐতিহাসিক অবশ্য মনে করেন, এঘটনারও বহু পূর্বে আরাকানের জনপদে মুসলমানদের আগমন ও বসবাস সম্পন্ন হয়েছিলো। যুক্তি হিসাবে তারা বলেন, খৃস্টীয় অষ্টম-নবম শতকেরও আগে থেকে আরাকানের জনপদে আরবীয়  মসুলমানদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্পন্ন হয়েছিলো। আর যে কোন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনার অনিবার্য অংশ হলো বাণিজ্যিকবসতি বা উপনিবেশ। ভারতবর্ষে, বিশেষ করে এর উপকূলীয় অঞ্চলে এধরনের বাণিজ্যিক বসতির বহু নযির রয়েছে। এদের অনেকেই স্থানীয় নারীদের বিবাহ করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন।

ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে বহু স্থানীয় মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তো এভাবে পূর্ব থেকে বিদ্যমান মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে উপরোক্ত জাহাজডুবির মাধ্যমে আগত আরব মুসলিম বণিকেরাও যুক্ত হয়েছে।

যাই হোক অন্তত এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজা মহত ইং চন্দ্রের সময়কাল থেকেই আরাকানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রথম উপাদান তৈরী হয়েছিলো। পরবর্তীকালে পারস্যের মুসলিমরাও নৌবাণিজ্যে নিজেদের নিয়োজিত করে। মূলত তাদের দ্বারাই বাণিজ্যিক বসতিরূপে বর্তমান আরাকানের কেন্দ্রীয় জনপদ আকিয়াব গড়ে ওঠে। ফারসি শব্দ ‘এক-আব’ থেকেই আকিয়াব নামের উৎপত্তি। যেমন ভারতে গঙ্গা -যমুনাবিধৌত অঞ্চলকে বলা হয় দু’আব।

আকিয়াব শহরটি কালাদান নদীর  মোহনায় অবস্থিত বলে সম্ভবত কালাদানের পানিকেই বোঝানো হয়েছে ‘এক-আব’ দ্বারা।

এভাবে দ্বিতীয় রক্তধারারূপে পারস্য থেকে আসা লোকেরা আরব থেকে আসা লোকদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে। এ উভয়ধারাকে আমরা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর প্রথম উদ্ভবকাল বলতে পারি।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রক্তধারায় তৃতীয় রক্তধারার মিশ্রণ ঘটেছে ১৪৩০ খৃস্টাব্দে রাজা নরমিখলার সঙ্গে বাংলার গৌড় থেকে আসা (বিশহাজার+ ত্রিশহাজার) মোটামুটি পঞ্চাশ হাজার সৈনিকের বাহিনীটির আরাকানে স্থায়ী বসতি গ্রহণের মাধ্যমে। এটাকে আমরা বলতে পারি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশের দ্বিতীয় পর্ব।

তৃতীয় পর্ব হিসাবে আমরা ধরতে পারি ঐ সময়কালটিকে যখন মগজলদস্যুরা নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলার নি¤œাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যায় বাঙ্গালীদের আরাকানে দাসদাসীরূপে নিয়েছিলো। বস্তুত এদের দ্বারাই তৈরী হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ‘সাধারণ’ স্তরটি।

এসকল দাস-দাসীর এক বিরাট অংশকে নিযুক্ত করা হয়েছিলো কালদাননদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলে ধানউৎপাদনের জন্য ভূমিদাসরূপে। তা থেকে নদীটির নাম হয়েছে কালাদান, যার অর্থ ‘বিদেশীদের স্থান’। কালা মানে বিদেশী, দান মানে স্থান।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রক্তধারায় চতুর্থ ও সর্বশেষ যে মিশ্রণটি ঘটে তা হচ্ছে মোঘল শাহজাদা শাহ শুজার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দুস্তান থেকে আসা ‘মোঘল রক্তধারা’। এ ঘটনা একটু পরেই আমরা উল্লেখ করছি।

১৬৬০ খৃস্টাব্দ ছিলো আরাকানের ইতিহাসের মোড়পরিবর্তনকারী সময়কাল। ভারতবর্ষে স¤্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর সময় তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দাবীতে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। শাহজাহানের পুত্র শাহ শুজা ছিলেন বাংলার সুবেদার। তিনি ১৬৫৭ সালে নিজেকে স¤্রাট ঘোষণা করে সিংহাসনের দখল গ্রহণের উদ্দেশ্যে চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনী নিয়ে দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ১৬৫৯ খৃস্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি খাযওয়ার যুদ্ধে শাহ শুজার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। তখন প্রাণরক্ষার জন্য তিনি রণাঙ্গণ ত্যাগ করে ঢাকায় এসে উপনীত হন। তারপর আরাকানরাজ সান্দা থু ধম্মা-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে আশ্রয় ও নিরাপত্তার আশ্বাস লাভ করেন। এরপর ৬০ সালের ২৬ শে আগস্ট আরাকানের রাজধানী ¤্রােহং উপনীত হন। সঙ্গে ছিলো পরিবার পরিজন, দেহরক্ষী সেনাপতি ও সেনানায়কদলসহ পাঁচশর বেশী লোকলস্কর।

ইতিহাসের বিবরণ থেকে জানা যায়, শাহ শুজার আরাকানে থাকার বা অবস্থান করার কোন পরিকল্পনা ছিলো না। তিনি আরাকানরাজের সাহায্যে তুরস্ক

 

আমাদের জানা দরকার  আরবের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্কের সূচনা কবে হয়েছে এবং তার শেকড় মাটি ও মানুষের কত গভীরে প্রোথিত ছিলো। কারণ

আরবরাই ছিলো ইসলামের প্রথম ধারক ও বাহক। পাকভরত উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও উপরে বর্ণিত নীতি সমানভাবে প্রযোজ্য।

ইতিহাসের পাতায় এ সত্য সমুজ্জ্বল যে, আরবের হিজাযে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকে, অর্থাৎ পঞ্চম শতকের বহু পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলের সঙ্গে  নৌপথে আরবদের বাণিজ্যিক ও মানবিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবভূমি হিজাযের, মক্কার কোরাইশের সঙ্গেও ছিলো একই সূত্রে একই সম্পর্ক।

ইতিহাস আমাদের বলে, খৃস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকে ইয়ামেন ও হাদরামাউতের আরবগোত্রগুলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও  চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত, যা আরবদের কাছে ‘খানফু’ নামে পরিচিত ছিলো, আসা যাওয়া শুরু করে দিয়েছিলো। হিজাযের ও মক্কার কোরাইশের বাণিজ্য ছিলো স্থলপথে প্রধানত রোম ও পারস্যশাসিত অঞ্চলে। কিন্তু ঐ সময়কালে রোম ও পারস্যের মধ্যে লাগাতার প্রবল যুদ্ধবিগ্রহের কারণে স্থলবাণিজ্যের পথ বিপদসঙ্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তখন কোরাইশ আরবদের নৌবাণিজ্যের পূর্বঅভিজ্ঞতার সাহায্য নিয়ে নিজেরা একই পথে বাণিজ্যিক সফর শুরু করে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে তারা দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট এবং আরো পূর্বদিকে চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের উপকূলীয় কেন্দ্রগুলো পর্যন্ত নিয়মিত সম্পর্ক স্থাপন করে। এমনকি ঐ সকল স্থানে তাদের বাণিজ্যিক উপনিবেশও গড়ে ওঠে।

একটা বিষয় মনে রাখলে ইসলাম-পূর্ব আরবের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্ক ইসলামের জন্য কতটা ইতিবাচক ও কল্যাণকর ছিলো তা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে। বিষয়টি এই যে, ইসলামের সংস্পর্শে বা ছায়াতলে আসার পূর্বেও আরবদের মধ্যে এমন কিছু জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিলো যা অন্যান্য জাতির মধ্যে তখনো কমই ছিলো। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস ও বীরত্ব, বদান্যতা ও অতিথিসেবা, সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা ও ওয়াদারক্ষা প্রভৃতি। এসকল গুণের কারণে আরবজাতির প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের অন্তরে একটি কোমল অনুভূতি বিদ্যমান ছিলো। অন্তত থাকাটাই স্বাভাবিক ছিলো।

যখন আরবের ভূমিতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলো, এই মুশরিক ও মূর্তিপূজক আরব বণিকদের মাধ্যমেই ইসলামের আগেই ইসলামের আলোচনা এ অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিলো বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কয়েক বছর পরে স্বয়ং আরবমুসলিমগণ ইসলামের পাকীযা আখলাক ও চরিত্র নিয়ে এ অঞ্চলে পৌঁছে যায়। বাহ্যত তাদের উদ্দেশ্য বাণিজ্য হলেও মূল লক্ষ্য হতো ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগ। কারণ এটা ছিলো তাদের প্রতি তাদের দ্বীন ও শরীয়তের অপরিহার্য পালনীয় বিধান।

সপ্তম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম বণিকগণ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে মালাবার ও চট্টগ্রাম থেকে কাঠ, মশলা, সুগন্ধিদ্রব্য ও ঔষধি গাছগাছড়া সংগ্রহ করে চীন পর্যন্ত নিয়ে যেতো, আবার ফেরার পথে নিজেদের দেশেও নিয়ে যেতো।

মূলত এই আরব মুসলিম বণিকদের জীবন ও চরিত্রে ইসলামের সৌন্দর্য অবলোকন করে এবং তাদের মুখে ইসলামের তাওহীদ ও ঈমানের বাণী শুনে ইসলামের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকে।

আরাকানের চন্দ্রবংশের প্রথম রাজা মহতইঙ্গ চন্দ্র ৭৮৮ খৃস্টাব্দে বৈশালীতে রাজধানী স্থাপনপূর্বক রাজত্ব শুরু করেন, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। ধর্মের বিষয়ে তিনি ছিলেন  বেশ উদার। ফলে মুসলিম বণিকদের পক্ষে বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামপ্রচারের জন্যও সহজ  ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

উদার নীতির এ রাজার আমলেই আরাকানের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েকটি জাহাজের একটি আরব বাণিজ্যবহর ডুবে যাওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়।

ঐতিহাসিক এ কারণে যে, এঘটনাই মূলত উপলক্ষরূপে দেখা দেয় আরব মুসলিম বণিকদের রাজ- দরবারে প্রবেশের এবং স্থায়ীভাবে তাদের এ অঞ্চলে বসবাসের, যা ইসলামপ্রচারের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো।

স্থানীয় লোকেরা জাহাযের লোকদের উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং যেহেতু এটি ছিলো বিদেশী বণিকদের জাহাযডুবির মত মানবিক দুর্যোগের ঘটনা, যা স্থানীয়ভাবে ছিলো আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেহেতু রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে তারা উদ্ধারপ্রাপ্ত লোকদের রাজদরবারে নিয়ে যায়। রাজা তাদের আখলাক ও আচার আচরণে এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন এবং তাদেরকে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দান করেন, বরং ‘রাজঅনুরোধ’ দ্বারা তাদের সম্মানিত করেন।

মুসলিমগণ স্থানীয় নারীদের বিবাহ করে স্থায়ীভাবে আরাকানে বসবাস শুরু করেন। এভাবে অত্র অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দশম শতাব্দী পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, মুসলমানদের সংখ্যা যথেষ্ট লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাছাড়া বাণিজ্যিক তৎপরতা ও দাওয়াতি মেহনতের কল্যাণে আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে মেঘনার পূর্বতীরবর্তী বিস্তীর্ণ বন্দর-জনপদে ইসলামের প্রতি সন্তোষ-জনক কোমল অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এমনকি রাজা ও রাজমহলও তার বাইরে ছিলো না। এসময় আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়। অর্থাৎ শুধু এ অঞ্চলে ইসলামপ্রচারের উদ্দেশ্যে ছূফী-দরবেশদের আগমণ শুরু হয়, যা স্থানীয় লোকদের ব্যাপকভাবে ইসলামগ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

এটা সম্ভব হয়েছিলো মূলত এ কারণে যে, চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘ কাল আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিলো এবং উভয় অঞ্চলের লোকদের পরস্পর যাতায়াত ছিলো। ফলে চট্টগ্রামে আগমনকারী ইসলামপ্রচারকারী ছূফী-দরবেশগণও আরাকান অঞ্চলে যাওয়া শুরু করেন।

রাজা নরমিখলা থেকে আধুনিক পূর্ব আরাকান

রাজা নরমিখলা হলেন লেংগিয়েত রাজাদের মধ্যে দশম ও শেষ রাজা। তার রাজত্ব মাত্র দু’বছর স্থায়ী হয়েছিলো। সিংহাসনে তার অভিষেকই হয়েছিলো অন্যায় পথে। অর্থাৎ তিনি আপন চাচা থিংগাথুকে হত্যা করে সিংহাসনের উপর জবরদখল কায়েম করেন। তার এই অন্যায় রাজত্ব মাত্র দু’বছর স্থায়ী হয়। এরই মধ্যে এই যুবক ‘রাজা’ একটি কলঙ্গজনক কাজ  করে বসেন। অর্থাৎ সেখানকার জনৈক সামন্তরাজার রূপসী বোনকে জোরপূর্বক বিবাহ দ্বারা ‘রাজকৃপা’ প্রকাশ করেন।

সামন্তরাজ এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বর্মীরাজ  মেঙ শো ওয়াই-এর সাহায্য প্রার্থনা করেন। প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক ইতিহাস পর্যন্ত পৃথিবীর সকল অঞ্চলের রাজ্য ও রাজনীতিতে যা ঘটেছে এখানেও তাই ঘটলো। বর্মীরাজ যখন দেখলেন, রাজ্যদখল ও রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের সুবর্ণ সুযোগ, তখন তিনি কাল বিলম্ব না করে সামন্তরাজের ‘মানবিক আবেদনে’ সাড়া দিলেন এবং ১৪০৬ খৃস্টাব্দে ত্রিশহাজার সৈন্য নিয়ে পথের বিপদ-ঝুঁকি উপেক্ষা করে আরকান আক্রমণ করেন। রাজা নরমিখলা যুদ্ধে পরাজিত হলেন, তবে পরাস্ত হলেন না। অর্থাৎ ধরা না পড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন এবং বাংলার রাজধানী গৌড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বস্তুত বিভিন্ন ঘটনাচক্রের মাধ্যমে রাজা নরমিখলা ইসলাম ও মুসলিম শক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যা পরবর্তীকালে আরাকানের জনপদে ইসলামের জনভিত্তিকে খুব প্রভাবিত করে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিষয়টিকে ইতিবাচকরূপে বর্ণনা করলেও দু’একজন প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিক এর নেতিবাচক দিকটিকেই বরং গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন।

বাংলা আরাকানের প্রতিবেশী রাজ্য হওয়ার কারণে নরমিখলার পক্ষে রাজধানী গৌড়ে পালিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছিলো। কিন্তু তিনি ছিলেন তার চাচার ঘাতক এবং সিংহাসনের জবরদখলকারী। তদুপরি যৌবনের উন্মাদনায় তিনি এক সামন্তরাজার আত্মমর্যাদায় আঘাত করেছেন। তিনি আশ্রয়লাভের যোগ্য যদিও বা হন, সাহায্য লাভের যোগ্য মোটেই ছিলেন না।

গৌড়ের সিংহাসনে তখন ছিলেন ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয়

 

অসমাপ্ত 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা