আল কুদসসংখ্যা (৩/২)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ-এর একটি ঐতিহাসিক ভাষণ

ফিলিস্তীনবিপর্যয়ের তিন কারণ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

(১৯৬৭-এর আরব-ইসরাইল যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর যখন আগের হাতছাড়া হওয়া পশ্চিম অংশের সঙ্গে বাইতুল মাকদিসের পূর্ব অংশ এবং  স্বয়ং মসজিদুল আকছা মুসলিম উম্মাহর হাতছাড়া হলো তখন বেশ কিছুদিন কারোই যেন হুঁশ ঠিকানায় ছিলো না। বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিলো না যে, ঘটনাটা সত্যি ঘটেছে! সবাই যেন একটা হতাশার ঘোরের মধ্যে ছিলো। সাধারণ মুসলিম জনতার জন্য এটা ছিলো অনেক বড় একটা দ্বীনী আঘাত, ঈমানী গায়রতের যেন জানাযা তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। হাজার বছরের বাইতুল মাকদিস আমাদের হাতে নেই! অভিশপ্ত ইহুদিদের না-পাক দখলে চলে গেছে কোন ফাঁকে আমাদের হাতফসকে!! ভাবলেই যেন বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। দু’কান যেন সর্বক্ষণ শুনতে পায় নিপীড়িত ফিলিস্তীনী জনতার আর্তনাদ, আর হানাদার, দখলদার ইহুদিদের উল্লাস-অট্টহাসি।

আফসোসের বিষয়, তখনো অধিকাংশ আরবরাষ্ট্র এবং ফিলিস্তীনমুক্তিসংস্থার নেতাদের মধ্যে শোকের বড় কারণ ছিলো, বরং সম্ভবত একমাত্র কারণ ছিলো যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে আরবদের পরাজয় এবং কিছু ভূখ- হারানো। মূলত এই ইসলামবিমুখ চিন্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষ এ বস্তুবাদী চেতনা, এটাই ছিলো আসল ভয়ের কারণ এবং পরাজয়েরও কারণ। হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ. তাঁর ভাষণে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই সবার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আমাদের মনে হয়েছে প্রায় পাঁচদশক আগে মদীনা মুনাওয়ারার পবিত্র পরিবেশে প্রদত্ত এ ভাষণে ফিলিস্তীন-মাসআলার প্রাণ ও প্রাণচিত্র উঠে এসেছে। তাঁর মুখের প্রতিটি শব্দে যেন ইসলামের প্রতি, মুসলিম উম্মাহর প্রতি দিলের দরদ-ব্যথা দোলায়িত হয়েছে। এখনো ভাষণটি পড়ার সময় একই রকম অনুভূতি পাঠকচিত্তকে দোলা দেয়। আজ দীর্ঘ পাঁচ দশক পরও ভাষণটির একই রকম আবেদন, প্রয়োজন ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তাই আলকুদসসংখ্যার মূল বক্তব্যরূপে ভাষণটির অনুবাদ পাঠকবর্গের সামনে পেশ করা হচ্ছে। আল্লাহ করুন, ভাষণের প্রতিটি শব্দের দরদ-ব্যথা এবং ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা আমাদেরও হৃদয়কে যেন স্পর্শ করে, আমীন। লেখাটি তরজমা করেছেন আমাদের অতিথি সম্পাদিকা আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফ্ফানা। সম্পাদক)

الحمد لله وكفى, وسلام على عباده الذين اصطفى

আম্মাবাদ, মজলিসে উপস্থিত প্রিয় সুধিবৃন্দ! রাবেতা আলমে ইসলামীর কর্মকর্তা, জামেয়া ইসলামিয়ার সম্মানিত শায়খ ও আসাতিযা! আপনাদের সবাইকে জাযাকুমুল্লাহ যে, নিজেদের ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু মূল্যবান সময় বের করে আপনারা আমার বক্তব্য শোনার জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আমি চাইবো, এ মজলিসে আপনাদের সামনে কিছু স্পষ্ট কথা বলি। যা বলবো তা  পূর্ণ বিশ্বাস ও প্রত্যয় এবং পূর্ণ আস্থা ও স্থিরতার সঙ্গে যেন বলতে পারি। আপনারা আমার প্রতি যে সুধারণা, যে আস্থা ও বিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছেন, এই আস্থা ও বিশ্বাসের দাবীও এটাই; আস্থার প্রতিদানে সততা ও সত্যবাদিতা রক্ষা করা। তাছাড়া আমার বিপন্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা আপনাদের শোকার্ত দৃষ্টি; আমার বেদনাদীর্ণ কণ্ঠের প্রতি নিবদ্ধ আপনাদের উৎকণ্ঠিত ‘শ্রবণ’, আমার এবং আপনাদের হৃদয়ের অভিন্ন স্পন্দন, এগুলোরও তো কিছু আবেদন ও মিনতি রয়েছে! আর তা এই যে, আমি যেন বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ত থাকি। কোন রাখঢাক ছাড়া, কোন তোয়াজ ও মনোরঞ্জন ছাড়া রুক্ষ ও তিক্ত সত্যই যেন আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি। লৌকিকতা, সৌজন্যচিন্তা যেন আমাকে আমার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। দ্বীনের বন্ধনে আমি তো আপনাদের বৃহৎ পরিবারেরই এক সদস্য। ঘরের, পরিবারের, আপনজনদের সঙ্গে লৌকিকতা ও কৃত্রিমতার আশ্রয় নেয়ই বা কে? প্রত্যেক মানুষ তার ভাই-বেরাদার ও খান্দানের  প্রতি মুহাব্বাতের অটুট বন্ধন অনুভব করে। আর মুহাব্বাতের দাবীতে মজবূর হয়ে হলেও তাকে সত্য বলতে হয়। বিপদ ও দুর্যোগ সম্পর্কে সতর্ক করতে হয়, কখনো কোমল-কণ্ঠে, কখনো কঠোর স্বরে। তো আমাকে অনুমতি দিন, কিছু স্পষ্ট কথা বলার এবং দিলের দরদ-ব্যথা আপনাদের সামনে তুলে ধরার।

ঘটনা ও দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ

মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা যে ক’টি গুণ, যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ’। জীবনের পথে পথে, পথের বাঁকে বাঁকে মানুষ যে সমস্ত ঘটনা ও দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, চারপাশের যে সকল চিত্র ও চরিত্র তার দিন-রাত ও সকাল-সন্ধ্যাকে স্পর্শ করে যায়, কখনো হালকাভাবে, কখনো গভীরভাবে ; এককথায়  জীবনসংগ্রামের উন্মুক্ত প্রান্তরে কোমল-কঠিন, অনুকূল-প্রতিকূল যে সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা মানুষকে করতে হয় এবং তার মাধ্যমে যে সকল অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, তা থেকে মানুষ, সচেতন মানুষ, সংবেদনশীল মানুষ অব্যশ্যই শিক্ষাগ্রহণ করে। এ যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তা‘আলার দেয়া অনেক বড় ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নেয়ামত, যার যথাযোগ্য কদর করা এবং যাকে কাজে লাগিয়ে জীবনের চলার পথকে, সামনে অপেক্ষমাণ ভবিষ্যতকে সুন্দর বানানো মানুষের কর্তব্য।

বস্তুত মানুষের মধ্যে গচ্ছিত এ যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যই সভ্যতা-সংস্কৃতি, তাহযীব-তামাদ্দুন, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্প ও বাণিজ্য, এককথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে সামনে বাড়ার রাস্তা খুলে দিয়েছে। এ যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যই মানুষকে তার জানমাল ও ইজ্জত-আবরুর হেফাজতের কাজে সাহায্য করেছে।

মানুষ তো দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ সাধারণ ঘটনা থেকেও বড় বড় শিক্ষা গ্রহণ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আহরণ করে। নিজের মর্যাদা ও আভিজাত্য এবং নিজের দ্বীন ও ঈমানের হেফাজত তার পক্ষেই উত্তমরূপে করা সম্ভব যে, জীবনের ঘটনা ও দুর্ঘটনা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।

এ যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য তো আল্লাহ তা‘আলা মানুষের স্বভাব ও ফিতরতের মধ্যেই রেখেছেন। একটি শিশু, যে জীবনের প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করেছে, যার বোধ ও বুদ্ধির উন্মেষ শুরু হয়ে গেছে, সেও তার মত করে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়। অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী আচরণ করে। একটি উদাহরণ বলি, ঐ শিশুটিও যদি আগুনে হাত দিয়ে দেখে, হাত পুড়ে গেছে তাহলে আর কখনো সে আগুনে হাত দেবে না। একবার আগুনে হাত পুড়ে যাওয়া থেকে ঐ ছোট্ট শিশুটিও সারা জীবনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তার দিল-দেমাগ এবং হৃদয় ও মস্তিষ্কে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, আগুনে হাত দিলে হাত জ্বলে যায়। এটাকেই বলে ‘ইসতিকরা’; অর্থাৎ ছোট ছোট অভিন্ন ঘটনা অনুসন্ধান করা এবং তা থেকে একটি মূল সত্য আহরণ করা। বস্তুত মানব-সভ্যতার উপর এই ইলমে ইসতিক্রা-এর বিপুল অবদান রয়েছে। আবিষ্কার-উদ্ভাবনের বিশাল বিস্তৃত জগতে এই যে বিপুল বিস্ময়কর উন্নতি-অগ্রগতি, এ ক্ষেত্রে ‘ইসতিক্রা’ মানুষের খুব উপকার করেছে।

আপনারা জ্ঞান-গবেষণা এবং অধ্যয়ন-অনুসন্ধানের জগতের মানুষ। আপনারা ভালো করেই জানেন, ইউরোপের জাতিবর্গ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি এবং শিল্প, সাহিত্য ও চিকিৎসার অঙ্গনে যে বিপুল অগ্রগতি অর্জন করেছে তা কিন্তু আন্দায অনুমান ও ধারণার সাহায্যে নয়, বরং ঘটনাপ্রবাহ থেকে কোন মূল সত্যের দিকে যাত্রা, পরিভাষায় যাকে বলে ‘ইস্তিক্রা’, এরই সাহায্যে তা করেছে।

মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য

একজন মুমিন হচ্ছে মানবতার সর্বোচ্চ আদর্শ, মানুষের জন্য সবচে’ পরিপূর্ণ নমুনা ও দৃষ্টান্ত। সুতরাং মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো ‘আকলে সালীম’ ও সুস্থ বুদ্ধির যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সে সবার থেকে এগিয়েই থাকবে। জীবনের চলার পথে যত ঘটনা-দুর্ঘটনা, এবং বিপদ-দুর্যোগের সম্মুখীন সে হয় তা থেকে অন্যদের তুলনায় অনেক দ্রুত সে সঠিক নতীজা ও সিদ্ধান্ত আহরণ করতে সক্ষম হবে। বারবার সে একই বিপদ-দুর্যোগের শিকার হবে না।  যেমন হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে Ñ ‘মুমিন একই গর্ত থেকে দু’বার দংশিত হয় না।’ কেন হয় না? কারণ পূর্বের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করে।

আসলে আকল-বুদ্ধিওয়ালা কোন মানুষের কাছ থেকেই আশা করা যায় না যে, একই গর্তে দু’বার, তিনবার সে হাত দেবে। সুতরাং মুমিন, যিনি হবেন মানবতার সর্বোচ্চ নমুনা; যার মধ্যে ঘটবে মানবীয় গুণাবলীর সর্বসুন্দর অভিপ্রকাশ; যার মধ্যে বিচ্ছুরিত হবে সমস্ত মানবীয় সৌন্দর্যের দ্যুতি, তার কাছে তো আরো ভালোভাবে আশা করা যায় যে, বারবার তিনি একই ধোকার, একই প্রতারণার শিকার হবেন না।

পক্ষান্তরে মুনাফিকের মনমানস, ও স্বভাবপ্রকৃতি যেহেতু মুমিন  থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত, সেহেতু জীবনের বড় বড়, গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর ঘটনা- দুর্ঘটনা থেকে সে অতিঅল্পই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে এবং খুব কমই ফায়দা হাছিল করে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনÑ তারা কি দেখে না যে, এই লোকেরা প্রতিবছর একবার বা দু’বার পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়, তারপরো তারা মনোযোগী হয় না এবং উপদেশও গ্রহণ করে না।’

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যখনই  তারা ফিতনায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তাতে পড়েই থেকেছে।

মুনাফিকের স্বভাব ও ফিতরত মুমিনের সুস্থ, বিশুদ্ধ স্বভাব ও ফিতরত থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। ঈমানি ফিতরতের দাবী তো হলো জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং দ্বিতীয়বার একই বিপদ ও দুর্ঘটনার শিকার না হওয়া। পক্ষান্তরে মুনাফিকের স্বভাব ও ফিতরত শিক্ষাগ্রহণের দিকে যেন যেতেই চায় না। একারণেই আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকের অবস্থা বয়ান করেছেন যে, তার জীবনে বিপদ-মুছীবত, ঝড়-ঝাপটা, পরীক্ষা ও প্রতিকূলতা যাই আসুক, তা থেকে সে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করে না। এমনকি জীবনের বড় বড় ভুলবিচ্যুতি, বড় বড় বিপদ-দুর্যোগ, যার তিক্ত ফল বহুদিন তাকে ভোগ করতে হয় এবং সারা জীবন তার বড় কঠিন মূল্য পরিশোধ করতে হয়, তা থেকেও যথাযথ শিক্ষা সে গ্রহণ করে না।

ব্যক্তি যদি তার ব্যক্তিজীবনে বিশুদ্ধ স্বভাবের দাবী উপেক্ষা করে, জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো যদি পিছনেই ফেলে দিতে থাকে তাহলে তার ক্ষতি শুধু ব্যক্তির সীমাবদ্ধ পরিম-লেই আবর্তিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে ঐ ব্যক্তি যত উচ্চ অবস্থানের অধিকারী হবে; আপন পরিবার, গোষ্ঠী ও খান্দান এবং আপন সমাজে সে যত ‘বরেণ্য’ হবে তার ক্ষতি ও খাসারাও সেই পরিমাণ হবে। পক্ষান্তরে এ ভুল যদি কোন জাতি, সম্প্রদায় ও সমাজ করে তাহলে তার ক্ষতিও গোটা জাতি, সমাজ ও সম্প্রদায়কে বেষ্টন করে থাকে।

সাম্প্রতিক শোক ও লজ্জার উজ্জ্বল দিক

এই মাত্র সেদিন যা ঘটে গেলো, পরাজয়ের যে মহাকলঙ্ক আরবজাতি ও মুসলিম উম্মাহর উপর নেমে এলো,যার আলাদা কোন ব্যাখ্যা-পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই; আমাদের প্রত্যেকে তা ভালো করেই জানে; আমাদের প্রত্যেকেই তার তিক্ততা অনুভব করতে পারছে। একজন মুসলিম হিসাবে আমিও আপনাদের সব বিপদ-দুর্যোগ ও দুঃখ-কষ্টের সমান অংশীদার।

জীবনের এসব বিপদ-দুর্যোগের যদি কোন কল্যাণকর দিক থেকে থাকে তবে তা এই যে, আমরা ভবিষ্যতের জন্য তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবো এবং নির্ভুল ও যথাযথ সিদ্ধান্ত আহরণ করবো।

এই যে মর্মন্তুদ ঘটনা, যার মূল্য আমরা পরিশোধ করেছি জীবন দিয়ে, ইজ্জত-আবরু কলঙ্কিত করে এবং বিশাল ভূখ- হাতছাড়া করে, এমনকি মসজিুদল আকছা ...। তো এর যদি কোন কল্যাণের দিক থেকে থাকে; এর যদি কোন উজ্জ্বল দিক থাকতে পারে তাহলে তা শুধু এই যে, আমরা তা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ লাভ করবো এবং যে ভুলের এ পরিণতি, জীবনে সে ভুলের পুনরাবৃত্তি আর কখনো করবো না।

আমি এ মর্মন্তুদ ঘটনার কারণ-সমূহের বিশদ আলোচনায় যাবো না এবং এবিষয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনার অবতারণা করবো না। কারণ এটা এখনকার বারবার আলোচিত বিষয়। হতে পারে সে আলোচনা এখানেও শুরু হলে বিরক্তির কারণ হবে।

আমি শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে আলোচনা করবো যে, এ মর্মন্তুদ ঘটনা থেকে কী কী শিক্ষা আমাদের নিতে হবে। প্রথম যে শিক্ষাটা আমাদের চিন্তায় বদ্ধমূল করে নেয়া জরুরি তা এই যে, নাস্তিক্যবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও লা-দ্বীনী নেতৃত্ব সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী দিবালোকের মত যা পরিষ্কার করে দিয়েছে, যাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সন্দেহের অবকাশ নেই, তা এই যে, যেসব নাস্তিক্যবাদী, লা-দ্বীনী ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব আরব মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বহুদিন ধরে চেপে বসেছে তারা তাদের পরীক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও আমি এটাকে পরীক্ষা বা অভিজ্ঞতা বলতে প্রস্তুত নই। কারণ আমার মতে যা কিছু ঘটেছে তা পূর্ব থেকে নির্ধারিত পরিকল্পনা মতেই ঘটেছে। কোন সন্দেহ নেই যে, এটা পর্দার আড়ালের কারসাজি ও ষড়যন্ত্রের ফল।

এ অন্তসারশূন্য নেতৃত্ব শুধু ফিলিস্তীনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, বরং জাতির নিরাপত্তা রক্ষা করতে এবং দেশের ভাবমর্যাদা ও সীমান্ত রক্ষা করতেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

একসময় বলা হতো, অগ্রসর চিন্তাধারার উপর প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে কিছুটা সময়, কিছুটা ছাড় দেয়া উচিত। কারণ এই নেতৃত্ব এখন উন্নত সভ্যতা এবং প্রাগ্রসর বিপ্লবের দায়-দায়িত্ব এবং দাবী ও চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। তদুপরি এ নেতৃত্ব অদৃশ্য কার্যকারণ ও গায়বি ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নয়, বরং শুধু বিদ্যমান ও দৃশ্যমান সত্যের উপর আস্থা ও বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং এতটুকু সুযোগ তো তাকে অবশ্যই দিতে হবে, যাতে সে আরবনেতৃত্বের অঙ্গনে নিজের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সামনে সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করতে পারে।

তো নিন, এই দেখুন, তথাকথিত আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব-¡কে সময়ের কথিত ছাড় ও সুবিধাও দেয়া হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ ইতিমধ্যেই তারা ভোগ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাঠে নামার এবং নিজেদের যোগ্যতার পরীক্ষা দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন। এখানেও মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী পরম প্রতিপালকের বড় কোন একটা হিকমত ও প্রজ্ঞা নিহিত ছিলো যে, এসকল তথাকথিত নেতৃত্ব তাদের তূণীরের সবচে’ তীক্ষè, সবচে’ গতিসম্পন্ন ও শক্তিশালী তীরগুলোও পরীক্ষা করে দেখে নিক। ঐ সকল অস্ত্রশস্ত্রেও তারা সজ্জিত হয়ে দেখুক, যা ইতিহাসের কোন না কোন অধ্যায়ে মানুষ ব্যবহার করেছে, কিংবা মানবচিন্তা যার নাগাল পেতে পারে এবং যা ভূপৃষ্ঠের যে কোন শক্তির অধিকারে ছিলো ঐ সকল অস্ত্রশস্ত্রেও তারা নিজেদের সজ্জিত করে দেখুক। কুদরত ও প্রকৃতি কোন বিষয়েই কার্পণ্য করেনি; তাদের কোন ইচ্ছা পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। অনুকূল জনমত সৃষ্টি, গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার, সমগ্র প্রশাসনের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা এবং নিজেদের মতবাদ, চিন্তাধারা ও আদর্শের প্রচার প্রসারের জন্য সর্বাধুনিক উপায়-উপকরণ ব্যবহার করার পূর্ণ সুযোগ তারা পেয়েছে; চাহিদার সবকিছুই তাদের সরবরাহ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও প্রজ্ঞার গভীরতা ও ব্যাপকতার ন্যূনতম ধারণাও মানুষের সাধ্যের ভিতরে নেই। এই সুগভীর ও সর্বব্যাপী হিকমত বা প্রজ্ঞার দাবী এটাই ছিলো যে, তথাকথিত আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব, যারা নিজেদের বর্তমান যুগ ও সমাজের পরিচলনার জন্য এবং জাতি ও সম্প্রদায়কে পথ ও গন্তব্যের সঠিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী  ও সুযোগ্য বলে দাবী করতো কুদরত ও প্রকৃতির পক্ষ হতে সমকালের সকল উপায়-উপকরণ তাদের নাগালে ও ব্যবহারে এনে দেয়া হয়েছে। নেতৃত্বের ময়দান তাদের জন্য খালি ও প্রতিদ্বন্দ্বী-হীন করে দেয়া হয়েছে, যাতে তারা অবাধে কোন প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সর্বপ্রকার বৈষয়িক সাজসজ্জা এবং চিন্তা ও মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহারসহ আপন যোগ্যতার কারিশমা দেখাতে পারে। যা তাদের প্রাপ্য ছিলো এবং ছিলো না সেগুলোরও সর্বোচ্চ ব্যবস্থা কুদরত তাদের জন্য করেছে।

এতসব অনুকূল সুযোগ-সুবিধার পরো তাদের শোচনীয় ও লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে, এমন পরাজয় যার নযির মানবজাতির ইতিহাস যদি নাও বলি, কম সে কম মুসলিমজাতির ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

আরবজাতি ও মুসলিমউম্মাহর ললাটে কলঙ্কতিলক

যে সকল জাতীয়তাবাদী আরবনেতা আরববিশ্বের যাবতীয় সমস্যা, বিশেষ করে ফিলিস্তীন-সমস্যার সমাধান নিজেদের পথে ও মতে করে ফেলবেন বলে বড় বড় দাবী করেছিলেন, যাদের বাগাড়ম্বরে ইসলামী চেতনার ধারক মানুষগুলো নির্বাক হয়ে পড়েছিলো তারা নিজেরাই এখন প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, মানবজাতির ইতিহাসে তারা হচ্ছেন সবচে’ ব্যর্থ এবং সবচে’ অযোগ্য নেতা। আল্লাহর ইচ্ছায় তারা এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন যা খুব কমই কোন নেতার ভাগ্যে জোটে। তাদের জন্য ময়দান ছিলো একেবারে খালি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন; পথের সব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ, যা যে কোন নেতার ভয় ও দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিলো, বরং নেতাদের ভয়ে প্রতিপক্ষ মাঠ ছেড়ে গায়েবই হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ফল?!

আরবজাতির ললাটে তারা পরাজয়ের এমন কলঙ্কতিলক লাগিয়ে দিয়েছেন, যা লোহিত সাগরের পানিতেও ধোয়া যাবে না। এ কলঙ্ক শুধু আরবজাতির নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহরও। কারণ ঈমান, বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আরববিশ্ব ও মুসলিমবিশ্ব একাত্ম ও একাকার।

গত যুদ্ধের লজ্জাজনক পরাজয়ের এটা হলো প্রথম সবক যা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

স্বভাব ও ফিতরতের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহ

ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামবিরোধী চিন্তাচেতনা ও মতবাদ লালন-কারী আরবনেতারা সময়ের সর্বপ্রকার সহায়তা ও আনুকূল্য সত্ত্বেও এই যে মুষ্টিমেয় শত্রুর মোকাবেলায় পরাজয় বরণ করলেন, এতে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, আরব-জাতির ভাগ্য ইসলামের সঙ্গে এবং একমাত্র ইসলামের সঙ্গে জড়িত। মানবতার জন্য ইসলামের যে পায়গাম ও বার্তা সেটা ধারণ করেই এবং তার ছায়ায় পথ চলেই শুধু তারা উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে; অন্যকোন চিন্তা ও চিন্তাধারা, অন্যকোন মত ও মতবাদ আরব -দের জন্য কিছুই বয়ে আনতে পারে না ভাগ্য-বিপর্যয় ছাড়া।

আমাদের চোখের সামনেই তো এ তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো! কী বিস্ময়কর গতিতে, কী প্রবল প্রতাপের সঙ্গে ইসলামকে সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা নিয়ে এই আরবনেতৃত্ব আরববিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করলেন। দেখতে দেখতে গোটা আরববিশ্ব এবং আরবজনমত যেন তারা জয় করে নিলেন। আরবের জন্য আল্লাহ যে স্বভাব ও ফিতরত নির্ধারণ করেছেন সেই আরবীয় স্বভাব ও ফিতরতের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করলেন; ইসলামের আদর্শ ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে তারা পর্দার পিছনে ছুঁড়ে ফেললেন। এ দীর্ঘ সময়ে খুবই সম্ভব ছিলো যে, কুদরতের পক্ষ হতে তাদের চলার পথে বিভিন্ন প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিরোধের কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যার কারণে তারা আপন পরিকল্পনামত কাজ করতে পারবেন না, আর দায় চাপিয়ে দেবেন প্রতিকূলতার উপর, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’দের বিরোধিতার উপর। কিন্তু তা তো হয়নি! তারা তো কাজের পূর্ণ সুযোগ পেয়েছেন, যা মনে এসেছে তাই করেছেন, যাকে বলা যায়, সর্বোচ্চ স্বেচ্ছাচার! এভাবে শেষপর্যন্ত আরবজাতির সামনে দিবালোকের মত এ সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে যে, আরবদের কল্যাণ ঐ পথে নয়, ঐ চিন্তা ও চিন্তাধারার মধ্যে নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী এই নেতৃত্ব চরম ব্যর্থ ও অযোগ্য বলে আজ অকাট্যরূপে প্রমাণিত।

আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধাচারিদের শিক্ষণীয় পরিণাম

যারা আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়গাম ও বার্তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে, তাঁর চিরন্তন বিশ্বনেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যারা নবুয়ত দাবী করে তাঁর নবুয়ত ও রিসালাতকে ‘লালকার’ দিয়েছে তাদের পরিণাম সবসময় এমনই হয়েছে এবং ইতিহাসের শাশ্বত শিক্ষা এই যে, তাদের পরিণতি এমনই হবে। তারা পরাজিত হবে, পরাস্ত ও বিপর্যস্ত হবে; এমনকি কুদরতের প্রতিশোধের মুখে তারা বিধ্বস্ত হবে। যাদের বিদ্রোহ যত খোল্লামখুল্লা তাদের পরিণামও তত ভয়াবহ। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আ ঘোষণা করেছেনÑ

إن شانئك هو الأبتر

তোমার শত্রুই হবে কর্তিতলেজ (বে-নাম, বে-নসল)।

‘আব্তার’ বলে তাকে, সন্তানের অভাবে যার বংশধারা বিলুপ্ত হয়ে যায়, যার নসলের অগ্রধারা থেমে যায়। কোরায়শের ‘বদ-আখলাক’ নেতারা আল্লাহর নবীকে এই বলে কষ্ট দিতো যে, তাঁর কোন পুত্রসন্তান বেঁচে নেই। সুতরাং তিনি ‘আব্তার’ কর্তিত বংশধারার পুরুষ। তাঁর ঘরে ‘চেরাগ রওশন করার’ কেউ থাকবে না। এর জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, না, আপনি আব্তার নন, আপনার শত্রুদলই বরং আব্তার। ভবিষ্যতে আপনারই জয়জয়কার হবে, আপনার শত্রুরা হবে বে-নামনিশান।

এ আয়াতকে আমি কোরায়শের বিশেষ কোন মূর্খ ও গোঁয়ার ব্যক্তির সঙ্গে বিশিষ্ট মনে করি না। এবং আমার ধারণায় আব্তার শব্দটি শুধু নসল ও বংশগত বিষয়ের সঙ্গে বিশিষ্ট নয়, বরং এর অর্থ ও মর্ম আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। 

إن شانئك هو الأبتر হে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যে কেউ আপনার বিরোধী হবে, আপনার প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করবে, আপনার বিশ্বজনীন রিসালাত ও পায়গাম এবং কিয়াদাত ও নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে, ‘লালকার’ দেবে, জাতির সম্পর্ক আপনার থেকে ছিন্ন করে নিজেরা তাদের উপর চেপে বসতে চাইবে, জাতির চিন্তাচেতনা থেকে রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার পবিত্র উপাদান অপসারণ করতে চাইবে তাদের পরিণাম হবে ব্যর্থতা ও লাঞ্ছনা এবং যিল্লতি ও নিশ্চিহ্নতা। এ ছাড়া আর কিছু না।

এ পরিণামই হয়েছিলো মুসায়-লামা কায্যাব, আসওয়াদ আনাসী, তালহা আসাদী, ওবায়দ বিন মায়মূন, হাসান বিন ছাবাহ, বাহাউল্লাহ ইরানী, গোলাম কাদিয়ানী প্রমুখের।

একই পরিণতি হয়েছে যুগে যুগে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের পূজারী স্বৈরাচারী প্রবল প্রতাপ-শালী নেতাদের। ভাবিষ্যতেও যে কেউ উম্মাহর উপর নিজের অবৈধ দখল ও কব্জা প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, যে কেউ উম্মাহকে তার নবীর বিশ্বজনীন নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চালাবে সেও ভোগ করবে ঐ পরিণতি, কোরআন যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং ইতিহাস যার চিরন্তনতা প্রমাণ করেছে।

মুফাস্সিরীনকে আল্লাহ ত‘আলা উত্তম বিনিময় দান করুন; তারা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় যা কিছু লিখেছেন তার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও শ্রদ্ধা রয়েছে। তবে আমি আয়াতের ব্যাখ্যা ও মর্মকে এরূপ সীমাবদ্ধ মনে করি না। আমার মতে এর মর্ম আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। আমার মতে যারা বিশ্বনবীর বিশ্বজনীন নেতৃত্বকে ‘লালকার’ দেবে, যারা বিশ্বনবীর বিশ্বজনীন উম্মাহকে বিভ্রান্তির পথে নিতে চাইবে তাদেরও পরিণতি কোরআনের এই চিরন্তন ঘোষণার আওতায় পড়বে। ইতিহাসÑমানুষের কাছে যার একমাত্র দাবীই হলো ঘটনা ও দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত আহরণ করাÑ ইতিহাস এই ব্যর্থ অপদার্থ নেতাদের একই অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বার অর্জনের অনুমতি বা সুযোগ কিছুতেই দিতে পারে না। মানুষের ব্যক্তিজীবনেও ব্যর্থ অভিজ্ঞতার পুনরায়ণ ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে জাতির রাহবার, পথপ্রদর্শক ও নেতা যারা তাদের একই ভুলের পুনরাবৃত্তি তো জাতির ভবিষ্যতের জন্য অনেক বেশী ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

৬৭-র পরাজয়ের দ্বিতীয় শিক্ষা

সুবিধা ও স্বার্থের পূজারী নেতাদের সবসময়ের নীতি ও রীতি এই যে, মানুষকে তারা ব্যক্তিপূজায় বাধ্য করে, ক্ষমতা ও গদীর সামনে দেশের জনগণ মাথা নত করবে, এটাকেই তারা মনে করে তাদের বিজয় ও সফলতা। নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন এবং নিজেদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির চরিতার্থায়নের পথে বৈধাবৈধ কোনা পন্থা অবলম্বনকেই তারা দোষের মনে করে না। তাদের না দ্বীন ও ধর্মের চিন্তা আছে, না ইনসানিয়াত ও মানবতার প্রতি কোন দায় আছে। না তারা ব্যক্তির স্বাধীনতা স্বীকার করে, না মতপ্রকাশের অধিকার। তারা ব্যক্তিস্বার্থের সামনে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।

তারা প্রথমে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং নিজস্ব বাদ-মতবাদের মূর্তি তৈরী করে; তারপর সেই মূর্তির সামনে নিজেরাও  সিজদাবনত হয়, আবার জনগণকেও মাথা নোয়াতে বাধ্য করে। তাদের কাছে অন্য কোন মত, পথ ও পন্থার কোন মূল্য নেই। বরং তাদের পরিম-লের বাইরে অন্য কোন চিন্তাচেতনার আত্মপ্রকাশ- কেই তারা মনে করে অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এরূপ নেতা ও শাসক প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের কর্মফলেরই প্রকাশ, আর কিছু নয়। কর্মফলের শাস্তিরূপেই আল্লাহ জাতির কাঁধে তাদের চাপিয়ে দিয়ে থাকেন। কোরআন এরূপ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের দেখুন কত সুন্দর ও নিখুঁত চিত্রাঙ্কন করেছেÑ

ومن الناس من يعجبك قوله في الحياة الدنيا ويشهد الله على ما في قلبه وهو ألد الخصام، وإذا تولى سعى في الأرض ليفسد فيها ويهلك الحرث والنسل، والله لا يحب الفساد، وإذا قيل له اتق الله أخذته العزة بالإثم، فحسبه جهنم، ولبئس المهاد .

এমনও লোক আছে, দুনিয়ার জীবনে যাদের কথাবার্তা তোমাকে মুগ্ধ করে, তারা তাদের মনের কথার উপর আল্লাহকে সাক্ষী মানে, অথচ তারাই হলো চরম বিবাদপ্রিয়! আর যখন তারা ক্ষমতা লাভ করে তখন ভূখ-ে ফাসাদ সৃষ্টির এবং ফসল ও নসল বরবাদ করার চেষ্টা চালায়, অথচ আল্লাহ ফাসাদ পছন্দ করেন না। আর যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহকে ভয় করো তখন তাদের পেয়ে বসে পাপের অহংবোধ, তো জাহান্নামই যথেষ্ট তাদের জন্য, আর বড় মন্দ স্থান সেটা!

এসব ইসলামবিমুখ ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী আরবনেতাদের এর চেয়ে সুন্দর, বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবানুগ চিত্র আর কী হতে পারে! আয়াতের প্রতিটি অংশ যেন তাদের একেকটি চরিত্রবৈশিষ্ট্যের প্রতিবিম্ব!! তাদের বক্তৃতা, বিবৃতি এবং কলমের লেখা, দেখুন, কত চিত্তাকর্ষক! মানবতাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়, ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ে তাদের এবং তাদের অনুচরদের কী বাগ্মিতাপূর্ণ, কী অলঙ্কাসমৃদ্ধ ভাষা!! ঐ সকল আরবদেশের বেতারসম্প্রচার শুনুন, মুগ্ধতায় অভিভূত হতে হবে আপনাকে! পত্রিকায় তাদের ঝলমলে জেল্লাদার ছবি দেখুন, মনে হবে, এমন প্রতাপশালী নেতা কীভাবে ইসরাইলের হাতে পর্যুদস্ত হতে পারে?! এমন হিরো কীভাবে হতে পারে এমন জিরো!!

যদি আপনি কোরআনের সত্যায়ন এবং তার বক্তব্যের বাস্তব নমুনা দেখতে চান তাহলে এই আরববিপর্যয়ের উপর পত্রপত্রিকার আলোচনা, পর্যালোচনা এবং আরব-নেতাদের ‘দিলদেমাগে’ ঐ পরাজয়ের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা করুন। তারপর কোরআনের এই আয়াত পড়–ন (যা মদীনার মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে)Ñ

وإذا رأيتهم تعجبك أجسامهم، وإن يقولوا تسمع لقولهم كأنهم خشب مسندة، يحسبون كل صيحة عليهم، هم العدو فاحذرهم

যদি তোমরা তাদের দেখো তাহলে তাদের দেহাবয়ব তোমাদের মুগ্ধ করবে, আর যদি তারা কথা বলে তাহলে তাদের কথা শুনে মনে হবে, যেন তারা ঠেক দেয়া কাষ্ঠপুত্তলি। (ভয়-ভীতি তাদের এত যে,) প্রতিটি আওয়াযকে তারা মনে করে, বুঝি, তাদেরই বিরুদ্ধে। তারাই হলো (তোমাদের আসল) শত্রু। সুতরাং তাদের বিষয়ে সতর্ক হও।

কোরআনের এ আয়াতে তাদের বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবানুগ চিত্র মূর্তরূপে আমাদের সমানে এসে যায়। সেই সঙ্গে আমাদের প্রতি, ‘করণীয় কী’ সে নির্দেশনাও পাওয়া যায়। এটা আর কিছু না; কোরআনের চিরন্তন মু‘জিযা।

সাম্প্রতিক মর্মন্তুদ ঘটনাবলী থেকে প্রাপ্ত এটা হচ্ছে দ্বিতীয় শিক্ষা।

কোরআন বলছে, ‘যখন তারা ক্ষমতা লাভ করে তখন তাদের যাবতীয় কর্মতৎপরতার একমাত্র উদ্দেশ্য হয় যমিনে ফাসাদ ছড়ানো এবং জানমাল বরবাদ করা।’ এখন আপনি তাদের শাসনাধীন দেশগুলোর দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন, দেশকে তারা বিরানভূমি বানিয়ে ছেড়েছে। ভয়-ভীতি ও সন্ত্রস্ততা যেন পুরো সমাজকে, সমাজের জীবনকে ঘিরে আছে। নিরপরাধ মানুষের বেঁচে থাকাই অসম্ভব করে ফেলা হয়েছে। যারা হতে পারতো দেশের সম্পদ, দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিক থেকে, তারা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছে, শুধু এই অপরাধে যে, তারা স্বৈরাচারের ধর্মহীন চিন্তাধারার সঙ্গে একমত হতে পারেনি। ঐ সবদেশে জনগণের মধ্যে না আছে স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা, আর না আছে নিজের প্রতি, নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসের প্রতি, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আস্থা।

এই আস্থা ও আত্মনির্ভরতা হচ্ছে মানবজীবনের ঐ সর্বোত্তম সম্পদ যা দ্বারা যুগে যুগে মানুষ উপকৃত হয়েছে, যার সাহায্যে মানুষ জীবন ও সভ্যতা গড়ে তুলেছে এবং সকল প্রতিকূলতা ও দুর্যোগের সফল মোকাবেলা করেছে। প্রাচীনকালের স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী শাসকরাও প্রজাদের জীবন থেকে এ সম্পদ ছিনিয়ে নেয়নি। কিন্তু আজকের তথাকথিত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে প্রগতিশীল নেতাদের যেখানে একচ্ছত্র শাসন ও শোষণ, সবার আগে এই মহামূল্যবান সম্পদেরই অহপরণ হয়। মুসলিম দেশ বলুন, আরবদেশ বলুন, যেখানেই তাদের হুকুমত সেখানে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আপনি এ জিনিসটির অভাব দেখতে পাবেন। তাদের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি তো নেই; এমনকি  নিজেদের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাস থেকেও তারা বঞ্চিত। নিজের যোগ্যতার প্রতি আস্থা নেই, নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসের প্রতি আস্থা নেই। নিজের কর্ম, দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আস্থা নেই। আস্থাহীন জীবনের চেয়ে তো মৃত্যু অনেক ভালো! একজন ছাত্র যত মেধাবী হোক, যদি তার মধ্যে নিজের মেধা ও যোগ্যতার প্রতি আস্থা না থাকে তাহলে পরীক্ষায় সে কৃতকার্য হতে পারে না। কোন সিপাহীর যদি তলোয়ার না থাকে, বন্দুক না থাকে, বা গুলি শেষ হয়ে যায়, সেটা এত চিন্তা-পেরেশানির বিষয় নয়, কিন্তু যদি তার নিজের ‘সৈনিকতা’র প্রতি, নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি আস্থা না থাকে তাহলে সবকিছু থেকেও বলতে হবে, তার কাছে কিছুই নেই। সে নিজের এবং অন্যের জন্য দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্যই শুধু বয়ে আনতে পারে।

এই যে যুদ্ধটা হলো, ইহুদিদের কাছে আরবসেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ কী? অস্ত্রের অভাব ছিলো? সামরিক দক্ষতার ঘাটতি ছিলো? পরিকল্পনায় বড় কোন ত্রুটি ছিলো? না, সবই পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিলো। যা ছিলো না তা হলো নিজের প্রতি, নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি, যুদ্ধের ময়দানে নিজের আত্মোৎসর্গের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। এটাই বতর্মান আরব-জনগোষ্ঠীর সেই মহাক্ষতি, যার কোন ক্ষতিপূরণ হতে পারে না।

জাতি ও জনগোষ্ঠী হলো বহমান নদীর মত। তাতে ফেনা হয়, খড়কুটা ভেসে আসে, মাটি ও পাথরও আসতে পারে এবং আসে, কিন্তু নদীর বহমানতায়  তেমন কোন পার্থক্য হয় না

فأما الزبد فيذهب جفاء وأما ما ينفع الناس فيمكث في الأرض

ফেনা তো মিলিয়ে যায়, মানুষের জন্য যা উপকারী তাই শুধু ভূমিতে স্থির হয়।

জীবনের বহমান স্রোতে বিপদ-দুর্যোগ আসতেই পারে, জয়-পরাজয়ও হতে পারে, এটা এত বড় চিন্তার বিষয় নয়। যদি বিবেক জাগ্রত থাকে, যদি আত্মবিশ্বাস অক্ষত থাকে, যদি চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সঠিক বোধ ও উপলব্ধি থাকে। এগুলো যদি থাকে তাহলে কঠিন থেকে কঠিন প্রতিকূলতা ও বিপর্যয়ের মধ্যেও হতাশ হওয়ার কারণ থাকে না। কেননা, এই আত্মবিশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে জাতি যে কোন সময় তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, পারে নিজের পিছনের ভুলগুলো সংশোধন করে সঠিক পথে অগ্রসর হতে।

কিন্তু যখন কোন জাতি ও জানগোষ্ঠীর অনুভূতি ও উপলব্ধি এমনই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় যে, জয়-পরাজয়ের পার্থক্য বুঝতে পারে না; শত্রু-মিত্রের তফাৎ বুঝতে পারে না। শত্রুর প্রতি শত্রুতা এবং মিত্রের প্রতি মিত্রতা রক্ষার যোগ্যতা থাকে না, এমন জাতি ও সম্প্রদায় নিজেই নিজের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়, তার ধ্বংসের জন্য আলাদা শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না।

বর্তমান নেতৃত্ব আমাদেরকে আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের শক্তি ও সম্পদ থেকে এমন বঞ্চিত করেছে যে, আমরা নিজেরা কিছু করতে পারি, আমাদের কিছু করার যোগ্যতা আছে, এটা ভাবতেও যেন আমাদের ভয়। অথচ এই আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের কল্যাণেই ইতিহাসের প্রত্যেক পর্বে আমরা এমন প্রতিকূলতা, এমন সব হামলা-হানাদারি এবং এমন সব দুর্যোগের মোকাবেলা করেছি, যা অন্য কোন জাতির ক্ষেত্রে হলে তাদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যেতো এবং এত দিনে তারা ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হতো। কিন্তু এই জাগ্রত জীবন্ত উম্মাহ সুদৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস, জাগ্রত অনুভূতি এবং জীবনের প্রতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি, দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের কল্যাণেই ইতিহাসের প্রতিটি ঝড়তুফান নিরাপদে পার হয়ে এসেছে, বরং ইতিহাসকে আমরা আগের ধারায় ফিরে আসতে বাধ্য করেছি। শত্রুজাতির ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর হামলা ও হানাদারির আমরা মোকাবেলা করেছি নির্ভয়ে, পরম সাহসিকতার সঙ্গে।

একটি পরাজিত বাহিনীও যদি ঈমানের শক্তি থেকে বঞ্চিত না হয়, আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্কটে যদি না পড়ে; যদি ত্যাগ ও আত্মত্যাগের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত থাকে, যদি দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আশ্বস্ত থাকে তাহলে একটি পরাজিত বাহিনীরও সাহস ও মনোবল সজীব থাকতে পারে এবং চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও সে লড়াইয়ে ফিরে আসতে পারে, এমনকি বিজয় তার ললাটচুম্বনও করতে পারে। আপনি কি পড়েননি গাযওয়া হামরাউল আসাদ-এর সেই অবিস্মরণীয় ঘটনা?! আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর আছহাব (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) যখমে চুরচুর অবস্থায় অহুদের ময়দান থেকে ফিরছেন। তখনো শরীর থেকে যুদ্ধের ধূলো ঝাড়ার সুযোগ হয়নি। এমন কঠিন সময়ে আল্লাহর রাসূলের হুকুম হলো, ‘কোরায়শের পিছনে ধাওয়া করো’।

এই মাত্র যে শত্রুর হাতে বিপর্যস্ত হয়েছেন, সত্তরজন শহীদের জানাযা পড়ে মাত্র ফারেগ হয়েছেন, তারা করবেন ধাওয়া?! দুনিয়ার কোন বাহিনী এ অবস্থায় ফিরতি হামলার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। কিন্তু তাঁরা হুকুম পেলেন, আর বলে উঠলেন, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!! ঐ গাযওয়ায় লড়াই তো হয়নি, কিন্তু কোরায়শের মদীনার দিকে রোখ করার সাহস আর হয়নি। সোজা মক্কায় গিয়ে তবেই দম নিয়েছে।

তৃতীয় শিক্ষা

সাম্প্রতিক যুদ্ধে যে বিপর্যয় ঘটে গেলো তাতে প্রমাণ হয় যে, আমাদের জীবনের গাড়ি এতদিন ভুল ‘ট্রাকে’ চলেছে। এখন প্রয়োজন হলো প্রথম সুযোগেই ভুলের সংশোধন করা; অন্যথায় জীবনের গাড়ি বারবার শুধু দুর্ঘটনায় পড়বে, বারবার শুধু বিপর্যয় নেমে আসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত কিশতির তলদেশে ছিদ্র থাকবে এবং পানি উঠতে থাকবে ততক্ষণ যিন্দেগির কিশতি খাতরা থেকে মুক্ত হতে পারে না। আজ আরবজাতি ও তাদের নেতৃত্ব ঐ ছিদ্রযুক্ত কিশতির সওয়ারদেরই মত বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কিশতির ছিদ্রপথে ভিতরে পানি আসছে, কিন্তু সওয়ার যারা, কাল্পনিক জলদস্যুদের নিয়ে পেরেশান! তাদের কাল্পনিক হামলা থেকে বাঁচার জন্য চিন্তা-তদ্বির করছে, অথচ কিশতির ছিদ্রপথ সম্পর্কে বে-খবর! এমন কিশতি এবং তার সওয়ারদের আনজাম ও পরিণতি কী হতে পারে?!

জাতির উত্থান-পতন ঘটে কীভাবে?!

বিভিন্ন মানবসমাজ ও জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন রাজ্য ও তার শাসকবর্গের ইতিহাস পড়ে দেখুন। একটি জাতির উত্থান হচ্ছে, আরেকটি জাতির পতন হচ্ছে। একটি সা¤্রাজ্য শক্তি ও প্রতাপের সঙ্গে তার পরিধি বিস্তার করে চলেছে, আরেকটি(৩৯ এর পর) সা¤্রাজ্য ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে এগিয়ে চলেছে শেষ সময়ের দিকে। কেন এমন হয়? কীভাবে হয়?? গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবেন, উত্থানের সময় সবকিছুতেই থাকে শক্তি ও প্রাণশক্তির স্ফূরণ! স্বভাবের মধ্যে থাকে হিম্মত ও সাহস, বাহাদুরি ও বীরত্ব এবং অনমনীয়তা, অবিচলতা, ধীর-স্থিরতা। তারা তখন কষ্টসহিষ্ণুতা ও প্রতিকূলতার মোকাবেলা করায় অভ্যস্ত থাকে। জাতির স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যে যখন এসব গুণের প্রবলতা থাকে তখন জাতির গাড়ি উন্নতি ও উত্থানের পথেই চলতে থাকে।

তারপর সময়ের ধারায় তাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়। তাদের সাহস ও মনোবলে যেন ঘুণে ধরে। এই দুর্বলতা ও সাহসহীনতা একসময় তাদের সর্বসত্তায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন অতীতের এই সাহসী ও কর্মোদ্যমী জাতিই ভোগবিলাসে মেতে ওঠে, আমোদ-প্রমোদ ও বিনোদনে ডুবে থাকে, প্রত্যেকে খাহেশাত ও প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়। সম্পদের প্রাচুর্য, উপায়-উপকরণের প্রবাহ এত বেশী থাকে; মানুষের চিন্তায় সঙ্গীতের সুর, নৃত্যছন্দ ও নুপুরের ঝঙ্কার এমনভাবে ছেয়ে যায় যে, সেটাকেই সে মনে করে জীবনের পরম স্তর! যিন্দেগীর আখেরি মি‘রাজ। যখন কোন জাতি এ অবস্থায় উপনীত হয় তখন সেটাই হয় তার ক্ষমতা ও প্রতাপ এবং জাতীয় মর্যাদা ও আভিজাত্যের মুমূর্ষুকাল।

তখন থেকে শুরু হয়ে যায় পতনের দিকে যাত্রা, যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত থেকে দ্রুতই হতে থাকে। এই চরম সত্যকে মাশরিকের কবি আল্লামা ইকবাল পরিবেশন করেছেন একটিমাত্র কবিতাপংক্তিতে (তরজমা)Ñ

‘আমি তোমাকে বলি শোনো জাতির ভাগ্য-ইতিহাস/শুরুতে তীর-তলোয়ার, শেষে সঙ্গীত-নুপুরের ঝঙ্কার।’

সমাজের সর্বস্তর এবং জাতির সর্বশ্রেণী যখন আরাম আয়েশে মজে যায়। অভিজাত মহল যখন শিল্পচর্চা, সংস্কৃতির সেবা, ললিতকলার পরিচর্যা ইত্যাদি নাম দিয়ে প্রবৃত্তিপূজায় ডুবে যায়। শাসকগোষ্ঠী যখন অনাচার, স্বেচ্ছাচার ও ফিতনা-ফাসাদের শিকার হয়ে পড়ে। হাস্যরস ও চিত্তবিনোদনকে যখন সাহস, পৌরুষ, অবিচলতা ও প্রতিজ্ঞার উপর অগ্রাধিকার দেয়া শুরু হয় তখন এর পরিণতি ধ্বংস ও বরবাদি ছাড়া আর কী হতে পারে?!

আব্বাসী সা¤্রাজ্যের পতন এবং তাতারী জনগোষ্ঠীর উত্থানের কাহিনী পড়–ন। সেখানেও আপনি দেখতে পাবেন একই নাটকের দৃশ্যায়ন। বাগদাদের বাসিন্দারা ভোগবিলাসের প্রতিযোগিতায় একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিন্তায় বিভোর ছিলো। সঙ্গীত, নৃত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কে কাকে ছাড়িয়ে’, এটাই তখন হয়ে পড়েছিলো জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাদের চিন্তাজগতের কোন অংশেই ধর্মচিন্তার অস্তিত্ব ছিলো না। দ্বীন ও দ্বীনিয়াত তাদের জীবন থেকে নির্বাসিত, তারাও দ্বীন ও শরী‘আতের রক্ষাবলয় থেকে বহিষ্কৃত। অলসতা, নিস্তরঙ্গতা ও নির্জীবতা, এগুলোই ছিলো তখন তাদের বৈশিষ্ট্য। তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও সৃজনশীলতা ব্যয় হতো পানাহারে আড়ম্বর ও পোশাকে জৌলুস সৃষ্টির পিছনে। তখন চিন্তাশীল সমাজে দলীল-প্রমাণসহ বিতর্ক হতো স্বর্ণের পাত্রে শরাব বেশী নেশা আনে, নাকি রৌপ্যপাত্রে?! দিন-রাত প্রতিটি প্রাসাদ ও বালাখানা থেকে আসতো শুধু গায়িকাদের গানের কণ্ঠ এবং নৃত্যপটিয়সি-দের নুপুরের ঝঙ্কার। পরিণাম কী হলো? দূর প্রাচ্যের কারাকুরাম পর্বত থেকে তাতারী নামের একটি ঝড় এলো। আর বাগদাদের আয়েশি জীবন রক্তের বন্যায় ভেসে গেলো! বাগদাদ শহরে বিশলাখ মানুষের লাশ পড়ে থাকলো দাফন-কাফন ছাড়া! হাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন, ‘বিশলাখ’!!

ঐ সময় তাতারীদের কষ্টসহিষ্ণু-তার অবস্থা ছিলো এমন যে, একমুঠ সিদ্ধ চাল, আর একঢোক পানি তাদের জন্য যথেষ্ট ছিলো। সেটা তারা ঘোড়ার পিঠেই সেরে নিতো। ঘোড়া থামতো শুধু তখন যখন বিশ্রাম ছাড়া সওয়ারকে বহন করা আর সম্ভব হতো না।

ভারতবর্ষে মোঘল সা¤্রাজ্যের পতনের কাহিনীও ছিলো একই রকম। মোঘলরা ভারতবর্ষে দীর্ঘ চার শতাব্দী পর্যন্ত এমন শান ও দবদবার সঙ্গে সা¤্রাজ্য শাসন করেছে যার নমুনা ভারতের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সমগ্র উপমহাদেশ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চলে এসেছিলো তাদের শাসনের আওতায়। স্থানীয় যত শক্তি ছিলো, যত শাসক ও নৃপতি ছিলো সবাই তাদের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছিলো। এমন শানশওকতের সা¤্রাজ্য, এমন সুসংহত ও সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা, যখন তাতে জরা-বার্ধক্যের আলামত দেখা দিলো  তখন শাহানশাহ, আমীর-ওমরা ও রাজকর্মচারীদের অবস্থা এমন হলো যে, চিত্তবিনোদন ও নাচগানের জলসা থেকে তাদের যেন ফুরসতই ছিলো ন। বাহ্যিক জাঁকজমক ও শানশওকত নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিলো এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ আমোদ-ফুর্তিতে ব্যতিব্যস্ত ছিলো।

নাদের শাহ, যার তাজাদম হুকুমত ইরানে তখন কায়েম হয়েছে, খুব মামুলি ও ক্ষুদ্র কলেবরের একটি ফউজ নিয়ে সে ভারতবর্ষে হামলা করলো। নাদের শাহের কোন আশা ছিলো না কোনদিক থেকে কোনপ্রকার সাহায্য পাওয়ার। পক্ষান্তরে চারদিক থেকে সে স্থানীয় বড় বড় ও শক্তিশালী ফউজের ঘেরাওয়ের মধ্যে ছিলো। কিন্তু নাদের শাহ ও তার বাহিনী ছিলো কষ্টসহিষ্ণু। আরাম আয়েশের যাবতীয় উপসর্গ থেকে ছিলো সম্পূর্ণ মুক্ত। আর মোঘল বাদশাহ! আরাম আয়েশ, ভোগবিলাস ও চিত্তবিনোদনের ফুর্তিমউজে তিনি এমনই ডুবে থাকতেন যে, তাকে বলা হতো ‘রঙ্গিলা বাদশাহ’।

মোঘল বাদশাহ মুহাম্মাদ শাহ যখন নাদের শাহের হামলার খবর পেলেন তখন আস্তাবলের দিকে না গিয়ে গেলেন প্রাসাদের ছাদে এবং নাদের শাহের তা-ব দেখে অনুতাপের কণ্ঠে বলে উঠলেন,  ‘আমাদের কর্মের পরিণাম নাদের শাহের রূপ ধরেছে।’

আসুন, নিজেদের ভুল খুঁজে দেখি

মোঘল বাদশাহ মুহাম্মাদ শাহ নিজের ভুল খুঁজে বের করেছিলেন, তবে বড্ড দেরিতে, বড় বেমক্কা অবস্থায়। তাই তা তার কোন কাজে আসেনি। আমাদের সামনে অবশ্য এখনো সুযোগ আছে। এখনো আমরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারি, যদি সত্যি সত্যি আমরা আজকের যিল্লতি থেকে মুক্তি চাই। আমাদের কর্তব্য হবে আর সময়ের অপচয় না করে এখনই আমাদের জাতীয় জীবনের ভুলগুলো খুঁজে বের করা এবং সেটা খুঁজতে হবে অন্য কোথাও নয়, আমাদেরই আরাম আয়েশ ও ভোগবিলাসপূর্ণ জীবনের মধ্যে, নাচগানের মাইফেল এবং সঙ্গীতের জলসায়।

যে জীবন আবর্তিত হয় ‘রঙ্গিন পানির’ ¯্রােতে, নাচগানের তরঙ্গদোলায়, এবং আমোদ-প্রমোদের উপায়-উপকরণকে কেন্দ্র করে সে জীবন কোন প্রতিকূলতা, কোন কঠিন পরিস্থিতি এবং কোন সমস্যার জটিলতার সম্মুখীন হওয়ার সামর্থ্য রাখে না। তার কাছ থেকে তা আশাও করা যায় না। নিজের মর্যাদা, আভিজাত্য ও ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য সে কোন হানাদার শক্তির মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াবে, এটা কল্পনা করাও সম্ভব না।

এমনকি জীবনের সংগ্রামক্ষেত্রে নিজের কর্মযোগ্যতার প্রমাণ দেয়া এবং কর্তব্যকর্ম পালন করা, এটাও তার পক্ষে সম্ভব না।

আজ এমন একটা সাদামাটা যুদ্ধে এমন একটা ভীরু জাতির বিরুদ্ধে আমাদের এই যে লজ্জাজনক পরাজয় এর কারণ আর কিছু না; এর কারণ হলো আমাদের উচ্চ নৈতিকতা থেকে বঞ্চিত জীবন এবং দ্রুত ও লাগাতার চারিত্রিক অবক্ষয়। এটাই আমাদের আগামী জীবনের জন্যও বড় খাতরা ও বিপদের কারণ।

রোম ও পারস্যের রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রাচীন আরবজাতি যে বিস্ময়কর বিজয় ও সফলতা অর্জন করেছিলো, নিঃসন্দেহে সেটা ছিলো তাদের ঈমানি শক্তিরই ফসল। আমি তা স্বীকার করি এবং গর্বের সঙ্গে! তবে এটাও আমাকে বলতে হবে যে, তাদের বিজয় ও আধিপত্যের পিছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো জাতি হিসাবে তাদের তখনকার ‘জাফাকাশী’ ও কষ্টসহিষ্ণুতা এবং রুক্ষ-কঠিন জীবনযাপনে তাদের অভ্যস্ততা।

এজন্যই আমরা দেখতে পাই, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর এই উম্মাহর সবচে’ বড় ও প্রাজ্ঞ মুরব্বি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর জোরালো উপদেশ ছিলোÑ

‘রুক্ষকঠিন’ জীবন যাপন করো, ঘোড়ার খালি পিঠে বসার অভ্যাস করো এবং লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার মশ্ক করো।’

কিন্তু আজ আমাদের জীবনে, বিশেষ করে তরুণদের জীবনে কোথায় সেই কষ্টসহিষ্ণুতা! সেই সাহস, পৌরুষ ও ‘মর্দানা শান’!! কোথায় সেই ‘রুক্ষকঠিন’ জীবনের সঙ্গে পরিচয়!!

হে আরবের তরুণদল! তোমরাই তো প্রাচ্যের জাতিবর্গকে কষ্ট-সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছো। জীবনের কঠিন থেকে কঠিন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সহাস যুগিয়েছো। আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসের  প্রতি ঘৃণা তোমরাই তাদের দান করেছো। বাহদুরি ও শাহসওয়ারিতে তোমরাই ছিলে আদর্শ।

আজ আমরা হিন্দুস্তান থেকে আরব-জাহানে আসি; আমাদের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি শুধু খুঁজে ফেরে বিজলীগতির ঐ সব আরবঘোড়া, যার বহু আলোচনা বারবার পড়েছি দিওয়ানুল হামাসার কবিতায়, প্রাচীন আরবকবিদের কাছীদায় এবং  যুদ্ধের বিভিন্ন (৪৫-এর পর) দাস্তানে। যার অনবদ্য শক্তি ও সাহসের কাহিনী পড়েছি হাদীছ ও সীরাতে। কিন্তু আমাদের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি তৃষ্ণার্তই থেকে যায়। কোথায় আজ আরবের সেই তেজী ঘোড়া ও তার তাজাদম সওয়ার!! আমাদের শাসক ও শাসিত, তাদের তো কয়েক কদম হাঁটাই হয়ে পড়ে কঠিন। রোদমাথায় চলার কথা তো ভাবাও যায় না। কষ্ট সহ্য করা, প্রতিকূলতার মোকাবেলা করা এবং কোন রুক্ষতা ও কঠিনতা বরদাশত করা আমাদের পক্ষে এখন আর সম্ভবই না। কেন? কোথায় গেলো অতীতের সেই আরব তরুণ, যাদের শৈশবে ছিলো তলোয়ারের খেলা, তীরের নিশানবাযি! আর ছিলো ঘোড়-সওয়ারি!! যাদের তারুণ্যে ছিলো ঘোড়ার পিঠে দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই,  ছিলো জান দেয়া এবং জান নেয়া!!

ফিলিস্তীনের ভূমি জবর-দখলকারী ইহুদীযুবকদের দিকে একটু দেখুন এবং তাদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করুন। (ফিলিস্তীনের

মুফতিয়ে আ‘যম) মুহতারাম আমীন আলহোসায়নী এখানে আছেন; আমার কথা শুনছেন। তিনি জীবনের দীর্ঘকাল অধিকৃত ফিলিস্তীনে জীবন-মৃত্যুর ঝুলন্ত তলোয়ারের নীচে পার করেছেন। খুব নিকট থেকে ইহুদিদের জীবনাচার তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করুন; প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রের জন্য বাধ্যতা-মূলক হলো ছুটির সময় নির্ধারিত দূরত্ব পর্যন্ত রোদের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস করা এবং অস্ত্রচালনা শিক্ষা করা। ইহুদীরা একসময় অলসতা, কর্মবিমুখতা ও আরামপ্রিয়তায় প্রসিদ্ধ ছিলো, যেমন আরবের তরুণদল প্রসিদ্ধ ছিলো ঘোড়সওয়ারি ও তলোয়ারচালনায় এবং সর্বপ্রকার কষ্টসহিষ্ণুতায়। কিন্তু আজ দুনিয়া বদলে গেছে! আজ তো দিন, রাত হয়ে গেছে, আর রাত হয়ে গেছে দিন।

খেলাধূলা, চিত্তবিনোদন, আমোদ-ফুর্তি এগুলোর স্বভাব বৈশিষ্ট্য হলো অলসতা, আরামপ্রিয়তা ও ভীরুতা। আর এগুলো যখন কোন জীবনে বাসা বাঁধে তখন স্বাভাবিক পরিণাম হলো পরাজয়, পরাজয় এবং পরাজয়।

আজ আমাদের কর্তব্য হলো, জয়-পরাজয়ের ঐ সব কারণ সন্ধান করা যা কোরআনে খুলে খুলে বয়ান করা হয়েছে; আল্লাহর রাসূল স্পষ্ট ভাষায় বয়ান করেছেন। দিকে দিকে ইসলামের বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছেন যে সকল স্বনামধন্য সিপাহসালার তারা ভালো করেই জানতেন, জয় আসে কোন রাজপথ দিয়ে;  আর পরাজয় আসে কোন চোরাপথে।

তারা কোরআনের পথে চলেছেন বিজয়ের জন্য এবং পরাজয় থেকে দূরে থাকার জন্য। আমরা আজ কোরআনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছি। তাই বিজয় আমাদের হাতছাড়া, আর পরাজয় আমাদের ললাটের কলঙ্কতিলক।

আরবের হে তরুণদল, মুসলিম উম্মাহর হে জোয়ান, এসো আবার কোরআনের পথে! উঠে এসো ধর্মনিরপেক্ষতার চোরাবালি থেকে। আবার চলো ছাহাবা কেরামের পথে!! আবার চলো ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর পথে!! আবার ফিরে আসবে বাইতুল মাকদিস ও মসজিদুল আকছা তোমাদের কাছে ইনশাআল্লাহ!! *

 

যেভাবে শুরু আরবদের দুর্ভাগ্য

আরবরা নিজেদের কর্মকাণ্ডর পক্ষে যত কৈফিয়ত ও সাফাই পেশ করুক, আজ ইতিহাসের সত্য এটাই যে, আরবজাহান থেকে, বিশেষ করে হিজাযের মাটি থেকে তখন এক ঝড় উঠেছিলো, অগ্নিঝড়! উছমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহের ঝড়!!

সেদিনটা আরবদের ইতিহাসে বড়ই দুর্ভাগ্যের দিন ছিলো। যদি কখনো আরবদের ইতিহাস সততার সঙ্গে লেখা হয় তাহলে এটা লিখতে হবে যে, আরবদের ইতিহাসে সবচে’ অশুভ সময় এসেছিলো তখন যখন তারা ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা তুলেছিলো বৃটিশদের কূটচক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে। এর চেয়ে ধ্বংসাত্মক ভুল আরবরা আজ পর্যন্ত করেনি। তারা বৃটিশদের দেখানো দিবা-স্বপ্নে এমনই বিভোর ছিলো যে, চিন্তা করারও সুযোগ হয়নি, কত বড় আত্মঘাতী পথে তারা চলেছে।

আসলে সত্যি সেদিন তারা জাতীয় আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছিলো। খলীফাতুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে যত ত্রুটি বা বিচ্যুতিই তাঁর ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা ইসলামের সবচে’ বড় দুশমন ইংরেজদের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিলো। খলীফা আব্দুল হামীদ তখন ফিলিস্তীনের পাক যমীন আগলে রেখেছিলেন নিজেকে ইহুদিশক্তির মোকাবেলায় ঢাল বানিয়ে। সে ঢালেই আঘাত করেছিলো আরবরা, সুলতান আব্দুল হামীদ অপসারিত হলেন। তাতে আরবদের নীরব সম্মতি ছিলো। তারপরো খেলাফত বেঁচে ছিলো, কিন্তু ধূর্ত ইংরেজের প্ররোচনায় আরবরা করলো তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যার সাজা আজো ভোগ করছে আরবজাতি!!

ইতিহাস আসলে কাউকে ক্ষমা করে না।

 

লরেন্স অব এরাবিয়া; তার চক্রান্ত!

আরবদেরকে উছমানী তুর্কীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলার মূল দায়িত্ব ছিলো যার উপর তিনি হলেন বিশিষ্ট ইংরেজ কূটনীতিক লরেন্স। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময়টাতে তিনি আরবজাহানে সক্রিয় ছিলেন। তারপর তার কর্মক্ষেত্র ছিলো মক্কার প্রশাসক হোসয়ান বিন আলীর শাসনাধীন এলাকা।

তিনি উছমানীদের বিরুদ্ধে আরবদের উত্তেজিত করেছিলেন একথা বলে যে, তারা আরব-সভ্যতা, আরবসংস্কৃতি এবং আরবীভাষার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। খেলাফতের আসল হকদার হলো আরবজাতি। খেলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুলের পরিবর্তে হতে হবে মক্কা বা মদীনা।

আরবীভাষা তিনি আরবদের মতই অনর্গল বলতে পারতেন। আরবসংস্কৃতিও ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। আরবী পোশাকই ছিলো তার ‘প্রিয়’। এভাবে তিনি আরবদের অন্তরেও জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাকে বলা হতো, লরেন্স অব এরাবিয়া।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, আরবরা উছমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বৃটিশের পক্ষে যোগ দিয়েছিলো। ওদিকে ইহুদিরাও ছিলো বৃটিশের পক্ষে। তবু আরবদের চোখ খুলেনি! হোসায়নকে খাব দেখানো হয়েছিলো, সমগ্র আরবভূখণ্ডের মালিকানা তাকে দেয়া হবে। সেখানে তিনি আরব ইসলামী খেলাফত কায়েম করবেন। আর ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো, ফিলিস্তীনের ভূখণ্ডে এবং পবিত্র জেরুসালেমে তাদের বাসভূমি তৈরী করে দেয়া হবে।

বৃটিশ-মার্কিন বলয়ে আরব-নেতাদের বিচরণ কি এখনো বন্ধ হয়েছে?! সউদী আরবের ফিলিস্তীনপলিসি এখনো হোয়াইট হাউজ থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় না? তাহলে ইহুদিদের দোষটা হলো কোথায়?

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা