আরাকান সংখ্যা (৩/১)

সম্পাদকের রোযনামচা

সম্পাদকের রোযনামচা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

২৮/২/৩৯
হিঃ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একজন রোহিঙ্গাশিবির পরিদর্শন করতে গিয়ে বললেন, ‘নাফনদীতে শিশুদের লাশ ভেসে বেড়াচ্ছে। দেখে কষ্ট হলো। এমন বেদনাদায়ক ক্ষেত্রে বেড়ানো শব্দের ব্যবহার! তাও লাশ সম্পর্কে! বলা যেতো, লাশ ভেসে আসছে, বা যাচ্ছে। আকাশে ভাসমান ও চলমান মেঘের ক্ষেত্রে বলা যায় আকাশে ভেসে বেড়ায়, নদীতে ভাসমান লাশের ক্ষেত্রে কিছুতেই নয়।
২৯/২/ ৩৯
হিঃ একশ্রেণীর পত্রিকা লিখছে, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ’ তাদের জন্য হয়ত ঠিক আছে। তারা তো এই বিপর্যস্ত অসহায় বনী আদমগুলোকে উটকো ঝামেলাই ভাবছে। মুখে বলুক আর নাই বলুক। সুতরাং তারা অনুপ্রবেশকারী বলতেই পারে। কিন্তু নয়া দিগন্তেও শব্দটি দেখে থমকে যেতে হলো! নয়া দিগন্তও কি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকারী মনে করে? নিশ্চয় না। তাহলে তো শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়ার দরকার ছিলো।
৩/১/৩৯
হিঃ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রতিদিনের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো নিয়মিত লেখা, সংবাদ, প্রতিবেদন ইত্যাদি প্রকাশ করছে। কিছু কিছু লেখা বা রিপোর্টিং-এর মান বেশ ভালো। ভাষাও সুন্দর, তথ্যেরও যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা আছে। পড়লে মনে হয়, হৃদয়েরও ছোঁয়া আছে। অর্থাৎ বিষয়টি হয়ত লেখকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে, ব্যথিত করেছে। এমন লেখা পাঠককেও আপ্লতু করে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, অধিকাংশ লেখার ভাষা তেমন মানোত্তীর্ণ নয়। হৃদয়েরও যেন ছোঁয়া নেই। লিখতে হবে তাই যেন লেখা। একটা দায়সারা ভাব। একজন লিখেছেন, এই প্রসঙ্গে আরকানের ইতিহাসটা জেনে নেয়া যাক। ... কত যেন আয়েশি মুডে আছেন লেখক। যেন বলছেন, এই অবসরে খেলার স্কোরকার্ডটা দেখে নেয়া যাক। এটা তরল শৈলী, গুরুগম্ভীর ক্ষেত্রে, বা শোকের ক্ষেত্রে এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
১/৩/৩৯
হিঃ একজন লেখক মোটামুটি ভালোই লেখেন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার একটি বক্তব্য সম্পর্কে লিখেছেন, এটা কি মামাবাড়ীর আব্দার যে বললেই হবে? মামাবাড়ীর আব্দার, ছেলের হাতের মোয়া, এগুলো বাংলাভাষার বাগধারা। যথাক্ষেত্রে এর ব্যবহার লেখাকে হৃদয়গ্রাহী করে। কিন্তু যদি যথাস্থানে না হয়, লেখার সৌন্দর্য নষ্ট করে। এখানেও তাই হয়েছে। লেখার গাম্ভীর্য এবং শোকের আবহ তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
৪/১/৩৯
হিঃ আমি লিখেছিলাম, ‘রোহিঙ্গাসমস্যা’ ছেলে জানতে চাইলো, সমস্যা শব্দের ব্যবহার ঠিক আছে কি না। মনে হয় বুঝতে পেরেছি, ছেলে কী বলতে চাচ্ছে। রোহিঙ্গারাই সমস্যা, নাকি রোহিঙ্গাদের সমস্যা, বোঝা যায় না। তো দু’দিকেই চিন্তাকে নিয়ে যায় এমন শব্দ না লেখাই তো ভালো, বিশেষ করে যার কলমের জন্য রোহিঙ্গা মুহাজিরীনের বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। মনে হলো কিছুটা যুক্তি আছে। লিখলাম, ‘রোহিঙ্গাসঙ্কট’ ছেলের, মনে হলো পছন্দ হয়েছে। রোহিঙ্গাবিপর্যয় হতে পারে, একইভাবে হতে পারে রোহিঙ্গাট্রাজেডি। ৮/২/৩৯ হিঃ রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে শরণার্থী শব্দটির ব্যবহার আমার কাছে মনে হয় অসম্মানজনক। আল্লাহর শোকর, সম্ভবত আমার কলম থেকেই প্রথমে মুহাজির শব্দটি এসেছে। ‘রিফিউজি’ বলছে কেউ কেউ। শরণার্থীর তুলনায় এশব্দটি কিছুটা যেন তাচ্ছিল্যজ্ঞাপক। মুহাজিরীন শব্দটি যেমন মর্যাদাপূর্ণ তেমনি শরীয়তসমর্থিত।
১৩/২/৩৯
হিঃ বেশ কিছু দিন থেকেই ভিতর থেকে প্রবল তাগাদা অনুভব করছিলাম, পুষ্পের তৃতীয় প্রকাশনা শুরু করা দরকার। অনুকলূ সময়ের অপেক্ষায় থাকা আর মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। তবু পরিবেশ পরিস্থিতি এবং নিছাবি কাজের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে বুঝতে পারছিলাম না কী করবো! হঠাৎ আজ রাতে মনের সব দ্বিধা- দ্বন্দ্ব মুছে গেলো। শুধু তাই নয়, এ চিন্তাটাও আল্লাহ তা‘আলা দান করলেন যে, প্রথম সংখ্যাটা হবে আরাকানসংখ্যা। সেভাবেই আজ কাজ শুরু করলাম। জানলো শুধু আমার ছেলে, দুই মেয়ে, আর তাদের মা। কেন জানি, ইচ্ছে হলো না, আগে থেকে আর কাউকে জানাতে। (প্রথমে লিখেছিলাম, ‘ইচ্ছে হলো না, আগে ভাগে আর কাউকে জানাই।’ মনে হলো, একটু যেন তরলতার ছাপ আছে। খুব হালকা একটা ছাপ। অথচ অত্যন্ত সংবেদনশীল মুহর্তূ সম্পর্কে লেখা! দু’টোর মধ্যে তুলনা করে দেখা যেতে পারে।)
১৪/২/৩৯
হিঃ আল্লাহর সাহায্যের স্নিগ্ধ কোমল একটি স্পর্শ যেন অনুভব করলাম। প্রথম কথা হলো, এ চিন্তা আমার অন্তরে কীভাবে উদিত হলো যে, এখনই পুষ্পের তৃতীয় প্রকাশনা শুরু করার উপযুক্ত সময়?! দ্বিতীয়ত, কীভাবে মনে হলো, পুষ্পের উদ্বোধনী সংখ্যাটা হতে হবে আরাকানসংখ্যা?! আর আজ পেয়ে গেলাম হযরত আলী মিয়াঁ রাহ. এর সেই ঐতিহাসিক বয়ান যা অন্তত চল্লিশ বছর আগে তিনি বার্মার মুসলমানদের উদ্দেশ্যে পেশ করেছিলেন, এক ইলহামী সতর্কবাণী রূপে। হৃদয়টা আনন্দে আপ্লতু হলো। নিশ্চয় এটা আমার আল্লাহর সাহায্য! সাফফানার এখন অনেক পেরেশানির সময়। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার সবটুকু দায়িত্ব তার। সারা সময় তাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়। আর সংসার তো আছেই। তবু তাকে বললাম, বয়ানটা তরজমা করার জন্য। বললাম, তুমি একটা খসড়া তরজমা কর, বেশী মেহনত করার দরকার নেই। সম্পাদনা আমি করে দেবো। ‘আলী মিয়াঁ রাহ. এর বয়ান!’ এমন ভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো! এমনভাবে আপ্লতু কণ্ঠে আল্লাহর শোকর আদায় করলো!! আমারও খুব ভালো লাগলো! আমার দুই মেয়ের প্রতিক্রিয়া দু’রকম। বড় মেয়ে খবরটা শুনে খুশী হতে গিয়েও যেন থেমে গেলো। তাহলে তো আবার শুরু হয়ে যাবে সেই রাত জাগা, সেই াস্থ্যক্ষস্বয়ী পরিশ্রম, সাধনা!! ছোট মেয়ে খবরটা শুনলো। আর আনন্দে ... বুঝতে পারছি না, কী শব্দ বলবো। শেষে বললো, ইনশাআল্লাহ গায়ব থেকে আল্লাহ সাহায্য করবেন, সহজ করে দেবেন। ছেলেরটা ছিলো দুইয়ের
মিশ্রণ। আর ... থাক!!
১৫/২/৩৯
হিঃ মনে হলো, কয়েকবারই মনে হলো, আমার প্রিয় ফায়রোযকে জানাই। তার তো অধিকার আছে জানার। খুশীও হবে অনেক। শেষে মনে হলো থাক। ওর আনন্দটা অন্য রকমই হোক। কথাটা লিখবো কি না, বুঝতে পারছি না। ভুল হলে আল্লাহ মাফ করুন। কারো কারো প্রতি মনে এত কষ্ট যে, যদি সম্ভব হতো ব্যবস্থা করতাম, আমার পুষ্প যেন ...। আল্লাহ তুমি মাফ করে দাও।
১৬/২/৩৯ হিঃ
দু’দিন থেকে ভাবছি, সম্পাদকীয় কী হবে?! কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভিতরে চিন্তাটা যেন একেবারে শূন ্য, ফাপা। হঠাৎ মনে হলো। কে মনে করিয়ে দেন?! হঠাৎ মনে হলো, আমি লিখবো, ভাবছি কেন! আমাকে পর্দা করে তো তিনি লিখে দেবেন। وما رميت إذ رميت ولكن الله رمى
ব্যস, ইতমিনান হয়ে গেলো। শুধু ইনতিযার, কখন শুরু হবে আকাশ থেকে করুণার ঝিরঝির শিশির! এবং .. এবং শুরু হলো। আমার প্রিয় ছাত্রটি শিউলী ফুল নিয়ে এলো। কী সুন্দর করে সাজিয়েছে! কী হালকা কোমল ঘ্রাণ!! ইচ্ছে করে তাকিয়েই থাকি! আর ইচ্ছে করে, শিউলীফুলের মত সুবাস অর্জন করি, শুভ্রতা ও পবিত্রতা অর্জন করি। এত ছোট্ট গাছে এত ফুল!! বললাম, ছেলেদের একত্র করো। আমি তাদের উপর ফুল ছিটাবো।
(ছিটাবো শব্দটা কেমন? আর কোন শব্দ হলে হয়ত ভালো হয়। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।)
আবার একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আমি শুধু আকাশের দিকে তাকালাম, কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে, কৃতার্থ চিত্তে। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর। চিন্তাটা কী?! মাদরাসার ছোট্ট বাগানটিতে প্রতিদিন কত ফুলই তো ফোটে! আমার অন্তরে প্রতিটি ফুলের জন্যই তো রয়েছে কৃতজ্ঞতা! তারপরো কেন মনে হয়, কোন ফুলটি যেন এখনো ফুটলো না! এটাই হলো ‘আকাশের ঝিরঝির শিশির’!! এখান থেকেই পেয়ে গেলাম, পুষ্পের তৃতীয় প্রকাশনার উদ্বোধনী সম্পাদকীয়-এর প্রাথমিক ধারণা। প্রশ্ন হলো, শিউলী ফুলে তো কাঁটা নেই, অথচ আমার জীবনে তো ফুলের চেয়ে কাঁটারই বড় ভূমিকা! হঠাৎ মনে হলো, শিউলী ফুলের কোমলতা থাক আমার হৃদয়ে। কলমের মুখে আসুক সেই ফুলের কথা যার রয়েছে, সুবাস এবং কাঁটা, যে কাঁটা রক্ত ঝরায়, ব্যথা দেয়। আবারও বলি, তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর। ১৮Ñ২Ñ৩৯ হিঃ নয়া দিগন্ত। ১৪ই সফর ১৪৩৯ হি. উপসম্পাদকীয় পাতায় একটি সাদামাটা লেখা। শিরোনাম, ‘আর কতকাল চেয়ে চেয়ে দেখবে বিশ্ব’। শিরোনাম থেকেই পূর্ণ একটি লেখার অবয়ব আমার চিন্তায় উদ্ভাসিত হলো। আল্লাহর রহমতে এক বৈঠকেই লেখা হয়ে গেলো। শিরোনাম সম্পর্কে প্রাথমিক চিন্তাটা হলো ‘হে বিশ্বশক্তি, হে বিশ্ববিবেক, আর কতকাল এ নীরবতা!!’ এরপর অগ্রপশ্চাৎ করলাম, ‘আর কতকাল এ নীরবতা ...!! তারপর মনে হলো ‘শক্তি’ শব্দটি থাক, নেদা-এর মধ্যে এক শব্দের পর দু’শব্দের নেদা শ্রুতিমধুর হবে। তাছাড়া নেদাটি কোন শক্তিকে লক্ষ্য করে না হোক, বিশ্বের মানুষ এবং তাদের বিবেককে লক্ষ্য করে হোক। এভাবে চূড়ান্ত হলো শিরোনামটি। এবারের প্রথম কথা ও শেষ কথায় যেন সংখ্যার বিষয়বস্তুকে স্পর্শ করে সেদিকটি চিন্তা করা হয়েছে।

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা