আরাকান সংখ্যা (৩/১)

আরাকানসংখ্যা (বিশেষ).

রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠীর নিধনযজ্ঞের স্বরুপ সন্ধানে

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

সোমবার ৯ই অক্টোবর নয়া দিগন্তে আরাকান বিপর্যয় সম্পর্কে একটি মূল্যবান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিখেছেন নয়া দিগন্তের নিয়মিত কলাম লেখক গৌতম দাস। সেই লেখাটি অবলম্বন করে আমরা বর্তমান শিরোনামে বর্তমান লেখাটি সাজিয়েছি। নয়া দিগন্ত ও গৌতম দাসের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

*** এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর যে ভয়াবহ গণহত্যা, গণধর্ষণ ও জাতিগত উচ্ছেদের ‘কহর’ নেমে এসেছে তা অতীতের যে কোন হিংশ্রতা, নৃশংসতা ও পাশবিকতাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিশ্বের যে কোন ধর্মেরই বিবেকবান মানুষ এ বিষয়ে খুবই চিন্তিত যে, কেন এটা হলো বা হচ্ছে? এর পিছনে কী কী কারণ ক্রিয়াশীল। কেউ কেউ ভাবছেন, এর পিছনে রাখাইন অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিবর্গের অর্থনৈতিক স্বার্থ মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। কারো কারো মতে ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ হচ্ছে এর মূল কারণ। একটা কথা আমরা সবাই জানি যে, রোগ এবং রোগের উপসর্গ এক জিনিস নয়। চিকিৎসা করতে হয় মূল ব্যাধির, উপসর্গের নয়। তো রোহিঙ্গা উচ্ছেদ নামের এই যে ভয়াবহ এক ট্রাজেডি, এর মূল উৎসটা কী? যদি আমরা সমস্যার সঠিক সমাধান চাই তাহলে সেটাই জানতে হবে সবার আগে।
আরাকানে রোহিঙ্গাবিপর্যয়ের যে কারণ উপরে বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে প্রকতৃপক্ষে ব্যাধির উপসর্গ, মূল ব্যাধি নয়। মূল ব্যাধিটা হচ্ছে অবার্মিজ জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখা এবং বার্মিজ জনগোষ্ঠীর হাতে সকল ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা। এতে সমস্যা দেখা দিয়েছিলো বহুমুখী জাতিগত বিদ্রোহ ও সশস্ত্র লড়াই। আর তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যই ছিলো মুসলিম বিদ্বেষের আশ্রয়গ্রহণ, যাতে সর্বজনগোষ্ঠীর দৃষ্টি ও মনযোগ এককদিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। একটু বিশদ ব্যাখ্যায় যাওয়া যেতে পারে। মিয়ানমার বা বার্মার সবচে’ বড় জনগোষ্ঠী হলো বার্মিজ; মোট জনসংখ্যার প্রায় ষাটভাগ। বার্মায় আরো বহু জনগোষ্ঠী রয়েছে। সরকারি- ভাবে যাদের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বলে স্বীকার করা হয় সেগুলোর সংখ্যা ১৩৫। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এই স্বীকৃতির বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আরাকান, তথা মিয়ানমারের বৈধ অধিবাসী নয়, বরং অনুপ্রবেশকারী। ষাটভাগ বার্মিজের বাইরের ৪০ ভাগ হলো এই সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী, যাদের সংখ্যা বিশাল বলেই মানতে হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় বার্মিজ জনগোষ্ঠীর নেতারাই ছিলেন ক্ষমতার আসল ভোগদার। তবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীও কমবেশী কিছু ক্ষমতা, কিছু সুবিধা ভোগ করে আসছিলো। কিন্তু বার্মিজ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব চাচ্ছিলো ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করতে। তাই তারা অবার্মিজ সব জনগোষ্ঠীকে সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত করার এবং রাজনৈতিক গুরুত্বপর্ণূ সব পদ থেকে তাদের অপসারণ করার ব্যবস্থা নিয়েছিলো। এ দুই কাজের মাধ্যমে অবার্মিজ জনগোষ্ঠীকে দেশের সকল শক্তি ও মুনাফার কেন্দ্রগুলো থেকে মুছে ফেলা হয়েছিলো। অবার্মিজদের প্রতি বার্মিজদের আচরণগত ঐ ট্রাডিশন, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার চর্চা এখন মিয়ানমারের সর্বত্র বিদ্যমান। ফলে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পরো অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মুক্তি ও স্বায়ত্বশাসনের দাবী ও লড়াইকে বার্মিজ জনগোষ্ঠী নির্মমভাবে দমন ও নিমূর্ল করার নীতি গ্রহণ করেছিলো এবং একমাত্র এ পথেই তারা পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিলো। এটা আরো নির্মম হয়েছিলো ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের হাতে, যা ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। বার্মার মূল সমস্যা এই চল্লিশ ভাগ অবার্মিজ জনগোষ্ঠীকে দমন ও নির্মূেলর চিন্তা থেকেই সৃষ্ট। এখানে আরেকটা বিষয়। ঐ চল্লিশ ভাগের মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী মাত্র চারভাগ। তারা সবাই আবার রাখাইন বা আরাকানের বাসিন্দা নয়। বার্মার সব প্রদেশেই তারা অল্প সংখ্যায় ছড়িয়ে রয়েছে। ১৯৮৮ সালে নে উইনের পতনের পর অবার্মিজ জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখার এক নতুন কৌশল অবলম্বন করা হয়। অর্থাৎ পুরো জনগোষ্ঠীর সামনে বার্মিজ-অবার্মিজ বিভাজনটি গোপন করে বৌদ্ধ- অবৌদ্ধ বিভাজনকে সামনে আনার কৌশল। এতে জনসংখ্যার অনুপাতটা দাঁড়ায় বৌদ্ধ আটাশি ভাগ, খৃস্টান ছয় ভাগ, মুসলিম চার ভাগ ইত্যাদি। এভাবে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের আড়ালে খুব সহজেই বার্মিজদের নিরঙ্কুশ শাসন, শোষণ এবং জাতীয় সম্পদের একচ্ছত্র ভোগের পথ খুলে যায়। তাই জেনারেলরা এটাকে নীতিরূপে গ্রহণ করলেন। যেমন কাচিন বা শান জনগোষ্ঠী, যারা নিজ প্রদেশের াস্বধীনতা বা াস্বয়ত্বশাসনের জন্য বার্মিজদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলো তাদের সামনে জেনারেলরা হাজির করলেন বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ তত্ত্ব। অর্থাৎ বৌদ্ধ হিসাবে আমরা- তোমরা অভিন্ন। বলাবাহুল্য, অবার্মিজ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীগুলো বার্মিজ বৌদ্ধদের টোপটি সহজেই গিলেছিলো। এই নতুন জাতিগত বিভাজনকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্যই বার্মিজ-অবার্মিজ জনগোষ্ঠীর সাধারণ শত্রু হিসাবে মুসলমাদের চিহ্নিত করা হয়। বার্মিজ বৌদ্ধ জেনারেলদের সামরিক শাসন ‘গণতন্ত্র প্রেমিক’ পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অবরোধের কবলে পড়েছিলো। সামাজতান্ত্রিক চীন-রাশিয়া ও গণতান্ত্রিক ভারত এই সুযোগে বার্মায় অর্থনৈতিক মুনাফা লাভের চেষ্টা শুরু করে, যা পশ্চিমাদের বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। পশ্চিমারা পরিষ্কারভাবে অর্থনৈতিক মুনাফার খেলায় পিছিয়ে পড়ছিলো। তাদের তখন প্রতিযোগিতায় ফিরে আসার গরজ ছিলো। এদিকে গণতন্ত্রের লেবাসটাও গায়ে চড়িয়ে রাখার দায় ছিলো। তাই অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য নিছক মুখরক্ষার খাতিরে গণতান্ত্রিক সংস্কারের শর্ত আরোপ করা হলো। জেনারেলদেরও গরজ ছিলো পশ্চিমা বাজার এবং পশ্চিমা অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্করক্ষার। তো রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কারটা হবে কী? না, বেশী কিছু না। একচ্ছত্র বার্মিজ সামরিক ক্ষমতাকে বহাল রেখে গণতন্ত্রের নেত্রী সূ চীকে শুধু গণতান্ত্রিক অলঙ্কাররূপে গ্রহণ করা। এটাই ছিলো পশ্চিমাদের বিরাট গণতান্ত্রিক সংস্কার যার পুরস্কার জেনারেলরা পেয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। ইতিমধ্যে বার্মিজ বৌদ্ধ জেনারেলরা বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সহিংস ধ্যানধারণাঅঘোষিতভাবে রোহিঙ্গা অরোহিঙ্গা, বা বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বিভাজনের মাধ্যমে আরো দুবর্ল ও নিঃসঙ্গ করে ফেলা হয়েছিলো। বলাবাহুল্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিলো এই সহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান বাহন। তারাও এ পথে ধর্মীয় ক্ষমতার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শাসনক্ষমতার াস্বদ পাচ্ছিলো। এটাই হলো বর্তমান মিয়ানমারের মূল সমস্যা এবং রোহিঙ্গাট্রাজেডির মূল উৎস, আর যা কিছু সব হলো উপসর্গ। ২০১০ সালে যখন নির্বাচনের সময় হলো তখন পরিস্থিতি মোটামুটি বার্মিজ সামরিক জেনারেলদের নিয়ন্ত্রণে। কারণ উদ্দেশ্যই তো ছিলো সূ চীর দলকে অলঙ্কার হিসাবে মেনে নিয়ে ২০১৬-এর পরবর্তী নির্বাচনে আলঙ্কারিক ক্ষমতায় আনা। সবপক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে এরই পূর্বপ্রস্তুতি ছিলো দুই হাজার দশের কথিত নির্বাচন ও ক্ষমতা বদল। এর আগে সামরিক শাসকরা নিজেরাই একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে ইউনিয়ন সলিডারেটি অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি নামে। সংক্ষেপে যার নাম ইউ এস ডি পি। সূ চীর দল ন্যশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি দশ-এর নির্বাচন বর্জন করেছিলো মূলত সমঝোতার ভিত্তিতে। তাদের সম্ভবত বলা হয়েছিলো পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করার জন্য। কিন্তু জেনারেলদের মাথায় তখন অন্য কূটবুদ্ধি। তারা চাচ্ছিলেন, সূ চী নির্বাচনের মাঠে নামার আগে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী শক্তিকে একচ্ছত্র অবস্থানে নিয়ে আসা, যাতে এ রাজনৈতিক দর্শন গ্রহণ করতে সবাই বাধ্য হয়। বালাবাহুল্য এ কাজে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটা বিরাট অংশ সামরিক শাসকবর্গ সাংগঠনিক- ভাবেই কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলো। তাদের সাংগঠনিক পরিচয় ছিলো কমিটি ফর প্রটেকশন অব ন্যাশনালিটি অ্যান্ড রিলিজিয়ন, স্থানীয় ভাষায় মা বা থা আন্দোলন। মা বা থা রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশের শুরুতেই চারটি আইনের খসড়া তৈরী করে এবং সংসদকে পাশ করিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানায়। পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা দেখতে পারি চারটি আইনে আসলে কী আছে? প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এই আইনচতুষ্টয় ছিলোই মূলত মুসলিমদের লক্ষ্য করে। যেমন ১-ধর্মবদল করতে হলে আগে রেজিস্ট্রেশন ও অনুমতি নিতে হবে। (এ আইন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হবে একমাত্র মুসলমান। কারণ মুসলিমরা সাধারণত ধর্ম বদল করে না। অন্য ধর্মগোষ্ঠী থেকেই মানুষ ইসলাম ধর্মে আসে সাধারণত ইসলামের আদর্শগত সৌন্দর্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।) ২-জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ আইন এতটাই নিগ্রহ- মূলক যে, প্রশাসন যদি মনে করে, জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে সংখ্যাভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ফলে কোন এক গোষ্ঠী তুলনামূলক অধিক পরিমাণে সম্পদ ভোগ করছে তখন ভারসাম্যরক্ষার জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারবে। আর সে ব্যবস্থা অন্যগোষ্ঠীর জনসংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে নয়, বরং অপর জনগোষ্ঠীর সংখ্যাহ্রাসের মাধ্যমে। বলাবাহুল্য, ভোগবাদী মানসিকতার কারণে সব জনগোষ্ঠীতেই জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা। পক্ষান্তরে মুসলিম জনগোষ্ঠী অধিকতর পরিবারবৎসল এবং সন্তান গ্রহণে

আগ্রহী। ৩-আন্তধর্মীয় বিবাহ নিষিদ্ধ করতে হবে। (এ আইনের মূল কারণ হচ্ছে বার্মিজ বা মগ পুরুষরা সাধারণত অলস ও বহির্মুখী। পক্ষান্তরে মুসলিম পুরুষেরা সাধারণত গৃহমুখী। তাই অন্যগোষ্ঠীর নারীরা মুসলিম যুবককে বিবাহ করতে আগ্রহী হয়।) ৪-বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে হবে। বলাবাহুল্য, এর পিছনেও সমাজসংস্কারের কোন সদিচ্ছা ক্রিয়াশীল নয়, বরং রাজনৈতিক মতলবই ক্রিয়াশীল। সাবেক জেনারেল থেইন সেইনের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো জেনারেলদের রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি। তিনিই ছিলেন দলের সভাপতি। তিনিই দশের তথাকথিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক সংস্কারগুলোও হয়েছিলো তার মাধ্যমে। মা বা থার প্রস্তাবিত চার আইন তিনিই সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। উপরোক্ত আইনের যে প্রস্তাব তা ছিলো মূলত উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তা -বাদীদের মস্তিষ্কপ্রসতূ। এ আইনের স্বপক্ষে এমন সর্বগ্রাসী প্রচার চালানো হয়েছিলো যে, সম্ভবত একজনও অমুসলিম এর বিপক্ষে ছিলো না। এরই ফল দেখা গেলো ২০১৫-এর নির্বাচনে। তখন সূ চীর এনএলডিসহ কোন দলই কোন মুসলিম প্রার্থী দেয়নি। কারণ মা বা থা ভিক্ষুসঙ্ঘ মুসলিমবিরোধী ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো যে, মনে করা হতো, মুসলিম প্রার্থী দেয়া মানে নির্বাচনে পরাজয়। তো এই হলো বর্তমান রোহিঙ্গা বিপর্যয়ের মূল স্বরুপ। এখান থেকেই শুরু করতে হবে রোগের চিকিৎসা।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা