আরাকান সংখ্যা (৩/১)

আরাকানসংখ্যা (বিশেষ).

আরাকানট্রাজেডি, রোহিঙ্গানিধন কেন?

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

বর্তমানে চলমান গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযানসহ ইতিহাসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ আকারের হত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতার ঘটনা সাতবার ঘটেছে। ১৯৭৮,৯১, ২০১২,১৪,১৬ এবং বর্তমান উচ্ছেদ অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু, পুরুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ১৯৪২ এর দাঙ্গায় হত্যা করা হয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম। এছাড় বিভিন্ন সময়ের বর্মিজ নৃশংসতা থেকে বাঁচার জন্য গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম ক্ষুধা, অনাহার ও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে মারা গিয়েছে। ১৭৮৪ সালে বর্মিজ রাজা

ভোদাপায়া আরাকান দখলের পর ত্রিশহাজার আরাকানীকে হত্যা করেন, যাদের অধিকাংশই ছিলো মুসলিম। প্রতিবারই নিধন ও গণহত্যার সময় ব্যাপক জ্বালাও পোড়াও করা হয়েছে বহু রোহিঙ্গা জনপদে। চালানো হয়েছে নির্বিচার ধর্ষণপৈশাচিকতা। ১৯৪২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণহত্যাই হলো রোহিঙ্গাদের জীবনে সবচে’ শোকাবহ ঘটনা। ঐ বছর জুনমাসে জাপানিদের হাতে পতন ঘটে আরাকানের রাজধানী আকিয়াব বন্দরের। একসময় বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দখলদার বৃটিশ- বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় জাপানের সার্বিক সহায়তায়। তখন বার্মার জাতীয় নেতায় পরিণত হন বর্তমান মিয়ানমারের নেত্রী সূ চীর পিতা জেনারেল অং সান। জাপানীদের পক্ষে লড়াই করেছে বর্মীরা, ব্রিটিশদের পক্ষে মুসলিমরা। যদিও বহু বিশিষ্ট রোহিঙ্গা, জেনারেল অং সানের পাশে ছিলেন। রোহিঙ্গাদের ব্রিটিশ -পক্ষগ্রহণের কারণ, এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যে, আরাকানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। বস্তুত ইংরেজদের মত ‘ওয়াদাখেলাফ’ জাতি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদের আত্মরক্ষার অন্তত ন্যূনতম ব্যবস্থা না করেই আরাকান ছেড়ে চলে যায়। তখন বৌদ্ধ ও বর্মিজ সন্ত্রাসীরা নৃশংস- ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের উপর, মেতে ওঠে ভয়াবহ গণহত্যায়। দীর্ঘ দিন চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসের তা-বলীলা। বিশিষ্ট রোহিঙ্গা পুঁথিসাহিত্যিক খলীলুর- রহমানরচিত কারবালা-ই-আরাকান -এ এর উল্লেখ রয়েছে। বর্মীদের রোহিঙ্গাবিদ্বেষের আরেকটি কারণ মনে করা হয়, ১৯৪৭ সালে দেশ- বিভাগের সময় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলো। লীগনেতা তখন যদি এ আবেদনে কার্যকরভাবে সাড়া দিতেন তাহলে আজ ইতিহাসের চেহারা হতো সম্পূর্ণ অন্যরকম। বস্তুত আমাদের সুদীর্ঘ রাজনীতির ইতিহাসে অতি সঙ্কীর্ণ পরিসরে মুসলিমস্বার্থ নামে কিছু থাকলেও, ইসলাম কখনো বিবেচনায় ছিলো না। ১৯৪২ সালের দাঙ্গা ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যার প্রথম দিকের নেতৃত্বে ছিলেন প্রসিদ্ধ পল্লীগীতি কবি মুহাম্মাদ জাফর কাওয়াল। রোহিঙ্গাট্রাজেডির উপর তার রচিত বিদ্রোহী কবিতা ও বিপ্লবাত্মক গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে লোকজন দলে দলে তার ‘মুজাহিদ’ বাহিনীতে যোগ দেন। এসময় কারেন জনগোষ্ঠীসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বর্মীশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে রোহিঙ্গারা বার্মাসরকারের অধীনেই তাদের অধিকার দাবী করলেও বার্মীজরা তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসগত ভাবেই রোহিঙ্গাদের ধর্মযদ্ধু বা জিহাদের বিধান। ১৯৬১ সালের ৪ঠা জুলাই তৎকালীন বর্মী প্রধানমন্ত্রী উ নু-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গা মুজাহিদরা অস্ত্র সমর্পণ করেন। কিন্তু ‘১৯৬২ সালের ২রা মার্চ জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারির পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে আসে দুর্ভাগ্যের দীর্ঘ কালো অধ্যায়, যার নৃশংসতা আজো প্রত্যক্ষ করছে বিশ্বসম্প্রদায়। বর্তমানে মিয়ানমার ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণরুপে উগ্রতা ও প্রতিহিংসাবাদী বৌদ্ধভিক্ষু- সমাজের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। এ কারণে সামরিক জান্তা ও গণতন্ত্রের নেত্রী বলে খ্যাত সূ চীর মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন বা ধরে রাখার উন্মত্ত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একপক্ষ রোহিঙ্গানিধনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, অপর পক্ষ তাতে নির্লজ্জ সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, সহিংস জাতীয়তাবাদের প্রচারক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা ধরে রাখা। এভাবে মূলত ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ, আর পাশ্বর্ত ক্ষমতা ও রাজনীতির নোংরা চক্রান্তের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে ভস্বাবত নির্বিরোধী ও শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। ইতিহাসের ফায়ছালা ও সিদ্ধান্ত যদি সঠিক হয় তাহলে পূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়, আরাকানের সবুজ মানচিত্র লাল রক্তের যে দাবী করে তা যদি পূর্ণ করা যায় তাহলে রোহিঙ্গারা অবশ্যই আবার ফিরে পাবে তাদের প্রিয় আরাকান, হয়ত এক শতাব্দী পরে, তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। ইতিহাসের ফায়ছালা পক্ষে পেতে হলে ধৈর্য, সাধনা, প্রস্তুতি, ঐক্য ও প্রতীক্ষার কোন বিকল্প নেই

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা