আরাকান সংখ্যা (৩/১)

আরাকানসংখ্যা (বিশেষ).

যে অতীত মুছে ফেলা সম্ভব নয় হে অং সান সূ চী!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ছবিতে ১৯৩৬ সালের রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা। মাঝে উঁচু চেয়ারে আসীন ব্যক্তি হলেন এম এ রাশীদ। ডানে সূচীর বাবা  অং সান এবং বামের ব্যক্তিটি হলেন ভবিষ্যতের সেনা শাসক জেনারেল উ নূ। এ নেতারাই হলেন াস্বধীনতার সংগ্রামের অগ্নিপরুুষ। অথচ এই অসাম্প্রদায়িক গৌরবের অতীত আজ মুছে ফেলতে চায় বার্মার অকৃতজ্ঞ শাসকেরা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সেনা প্রধান জেনারেল মিন অং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তার দেশের সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। আর ২৫শে আগস্টের হানাদারির পর ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সূ চী প্রথম যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙ্গালী’ নামে আখ্যায়িত করে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছিলেন তিনি। এ দুই ক্ষমতাদর্পীর বক্তব্যে মনে হতে পারে, বার্মার ইতিহাসে মুসলিমসমাজ বা আরাকানের রোহিঙ্গাদের বুঝি কোন ভূমিকাই নেই! কিন্তু ইতিহাস কী বলে? বাস্তবতাই বা কী? অং সান সূ চীর বাবা জেনারেল অং সানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন একজন মুসলিম আব্দুর রাজ্জাক্ব  স্বাধীনতা-উত্তর যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন অং সান তার শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক্ব  আর ১৯৪৭-এর ১৯শে জুলাই জেনারেল অং সান-এর সঙ্গে যে ছয়জন মন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন তিনি। ১৯শে জুলাই হচ্ছে এখন বার্মার ‘শহীদদিবস’! সূ চী কীভাবে মুছে ফেলতে চান শহীদ আব্দুর রাজ্জাক্ব নাম?! একমাত্র তিনিই তো নন। তার বাবার সবচে’ কাছের মানুষদের আরো অনেকেই ছিলেন বিশিষ্ট মুসলিম। বৃটিশ অধীনতার সময় বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রভূিম ছিলো রেঙ্গুন বিশ্ব- বিদ্যালয়, আর তার ছাত্র- রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতো বিশ্ব- বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ, যার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এম এ রশীদ। এসময় অং সান এর প্রধান রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন এম এ রশীদ ও উ নু। ১৯৩৬ এ রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদে অং সান হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, আর এম এ রশীদ হলেন প্রেসিডেন্ট। এম এ রশীদকে অং সান বলতেন রশীদ ভাই। অং সানের নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে এম এ রশীদ ও জেনারেল উ নু -এর বন্ধুত্ব অটুট ছিলো। ১৯৪৭ সালে বার্মার সংবিধানের অন্যতম খসড়াকারীও ছিলেন এম এ রশীদ। পরে তিনি দেশটির শ্রমমন্ত্রীও হন। অং সান, এম এ রশীদ ও আব্দুর রাজ্জাক্ব, এই চারের বন্ধুত্বেই গড়ে উঠতে পেরেছে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সম্ভাবনা। এর ভিত্তিতেই ১৯৪৮ -এর ফেব্রুয়ারিতে পাংলংয়ে যে ঐতিহাসিক জাতিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তাতে অং সান বলেছিলেন, বার্মা হবে সর্বজাতির ইউনিয়ন। বর্মীরা এক কায়েত পেলে অন্যরাও এক কায়েত পাবে। এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেই কাচীন-কারেন- শান-মুসলমান সবাই বার্মা ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলো। আজ সেই অং সান-এর কন্যা বলতে চাচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বলতে কিছু নেই, সব বাঙ্গালী, স্রেফ বাঙ্গালী। স্ববিরোধিতা আর কাকে বলে! এটাই যদি সত্য হয় তাহলে ১৯৪৮ থেকে ৯০ পর্যন্ত সুলতান মাহমূদ, আবুল বাশার, আব্দুল গাফফার, জোহরা বেগম প্রমখু কীভাবে আরাকানের মুসলিম- প্রধান এলাকা থেকে বার্মার পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বছরের পর বছর? আকিয়াবের এমপি সুলতান মাহমূদ ১৯৬০-এ জেনারেল উ নুর মন্ত্রিসভায় যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেটা কোন জাতিসত্তার পরিচয়ে? কারা ভোট দিয়েছিলো তাকে? সব থাক, শুধু বলুন, ১৯৯০ এ যখন সামরিক বাহিনীর অধীনে বার্মায় প্রথমবারের মত বহুদলীয় নির্বাচন হলো (যাতে জয়লাভ করেও সূ চী ও তার দল সরকার গঠন করতে পারেনি) ঐ নির্বাচনে চারজন মুসলিম রোহিঙ্গা কোন পরিচয়ে কাদের ভোটে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলো? কীভাবে তখন আরাকানের রোহিঙ্গারা নিজস্ব রাজনৈতিক দল (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এন্ড হিউম্যান রাইটস পর্টি) থেকে আটজন প্রার্থী হওয়ার অনুমতি পেয়েছিলো? এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় ১৯৯০ এর নির্বাচনে বিজয়ী রোহিঙ্গাপ্রার্থীর অন্যতম শামছুল আনোয়ারকে অং সান সূ চী ৯৮ রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসাবে পিপলস পার্লামেন্টে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, আর শুধু ঐ ডাকে সাড়া দেয়ার অপরাধে তার ৪৭ বছর জেল হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, তার পুত্রকন্যাদেরও ১৭ বছর করে জেল হয়েছিলো!! সুন্দর কৃতজ্ঞতা! সুন্দর প্রতিদান!! বার্মার মুসলিম নেতৃত্বকে মুছে দেয়ার প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হয় ব্যরিস্টার উ কো নি-কে। তিনি ছিলেন মিয়ানমারের অন্যতম বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান- বিশেষজ্ঞ। সূ চীর আজকের অবস্থানের পিছনে তার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। যখন সন্তানদের বিদেশী নাগরিকত্ব থাকার অজুহাতে আজকের সামারিক জান্তাই যখন সূ চীর ক্ষমতা গ্রহণে বাধা তৈরী করে তখন উ কো নি-ই একটি সাংবিধানিক উপায় বের করেন। সংবিধানের ভিতরে থেকেই বিকল্প সরকারপ্রধান হিসাবে সূ চীর জন্য স্টেট কাউন্সিলর-এর পদসৃষ্টির পথ দেখিয়ে দেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘ দিন সূ চী-এর আইনি উপদেষ্টা। ১৯৮২ সালের যে আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় তার সমালোচনা করাই হয়ত ছিলো তার অপরাধ। সামরিক গোয়েন্দা প্রকাশ্য রাজপথে তাকে যখন হত্যা করলো সূ চী বললেন, এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস! আর আজ!! সুন্দর কৃতজ্ঞতা! সুন্দর প্রতিদান!! 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা