শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

আরাকান সংখ্যা (৩/১) | আরাকানসংখ্যা (বিশেষ).

তবু এটা গণহত্যা নয়! কাকে বলে গণহত্যা?!

 

আরাকানে মানবিক বিপর্যয় শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে জাতিসঙ্ঘমহাসচীব বেশ সুকৌশলে কড়া কড়া কথা বলা শুরু করেন, যাতে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয় যে, জাতিসঙ্ঘ আরাকান ট্রাজেডি এবং রোহিঙ্গানিধনের ঘটনাকে বেশ শক্ত হাতেই গ্রহণ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ ও তার মহাসচীব যে আইওয়াশ ছাড়া আর কিছু নন সেটা সচেতন মানুষের নযরে ধরা পড়তে সময় লাগেনি। বাংলাদেশের ‘প্রকতৃ’ বিরোধীদলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ সত্য তুলে ধরেছেন স্পষ্ট ভাষায়। তিনি বলেন, শুধু কথায়, আর মুখের নিন্দায় তো কিছু হবে না। শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে কাজ দেখাতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করতে হবে, তার দেশের নাগরিক নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে। উল্লেখ্য, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ- কারীদের কেন বিচারের আওতায় আনা যাবে না, এ প্রশ্ন এখান থেকে শুধু বেগম জিয়াই উত্থাপন করেছেন, যদিও তিনিও বাস্তব কারণেই বিচারের দাবী তুলতে পারেননি। জাতিসঙ্ঘের আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে সম্প্রতি একটি আলোচনায়। এখন বলা হচ্ছে যদিও প্রকতৃপক্ষে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধদের চালানো বর্বরতা, গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের প্রকষ্টৃ উদাহরণ, কিন্তু জাতিসঙ্ঘ এটাকে ‘অফিসিয়ালি’ গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে পারে না। জাতিসঙ্ঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায়বলা হয়েছে, ‘গণহত্যার অর্থ হবে কোন জাতি, ধর্ম বা গোষ্ঠীকে আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে নারী ও পুরুষ সদস্যদের ব্যাপক হারে হত্যা করা, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন চালানো, সন্তান জন্মদানে বাধা সৃষ্টি (গণধর্ষণও এর অন্তর্ভুক্ত) এবং শিশুসন্তানদের জোরপূবর্ক অন্যত্র সরিয়ে নেয়া (শিশুহত্যা এর অন্তভর্ক্তু নয়?)। উপরের সংজ্ঞা অনুসারে রাখাইনে চলমান নৃশংসতাকে গণহত্যা না বলার কোন কারণই থাকতে পারে না। কিন্তু সমস্যা নাকি সৃষ্টি করেছে কনভেনশনের প্রথম ধারায় উল্লেখকৃত কিছু বক্তব্য, যাতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এনিশ্চয়তা দেয় যে, হত্যাকা-গুলো ছিলো প্রতিরোধ বা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে, প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে নয়। উপরের ধারাটিকে অজুহাতরূপে খাড়া করেই মিয়ানমারের নযির- বিহীন বর্বরতা ও নৃশংসতাকে নাকি গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া আরেকটি সমস্যা হলো, জাতিসঙ্ঘ যদি কোন হত্যাকা-কে গণহত্যা বলে অফিসিয়ালি স্বীকৃতি দেয় তাহলে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী ১৪৭টি দেশের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট দেশটির উপর ‘পর্যাপ্ত’ চাপ সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করা, বাস্তব কারণেই যা
এখন সম্ভব নয় বলে জাতিসঙ্ঘ মনে করে। একারণেই জতিসঙ্ঘ আনঅফিসিয়ালি কঠোর ভাষা ব্যবহার করলেও অফিসিয়ালি নমনীয় ভাষা ব্যবহার করে চলেছে। এখন এটাকে আমরা কী বলতে পারি নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভাগ্য ছাড়া যে, গণহত্যার শিকার হয়েও তারা গণহত্যার শিকার নয়! সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে এবং কোন কোন পক্ষ সে প্রশ্ন তুলছেনও যে, জাতিসঙ্ঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি এত চুলচেরা বিশ্লেষণের তোয়াক্কা করতো যদি নির্যাতিত জনগোষ্ঠী অমুসলিম হতো, ইহুদি, খৃস্টান! আর নির্যতনকারী পক্ষ যদি হতো মুসলিম! পূর্ব তিমূরে এবং দক্ষিণ সুদানে গণহত্যা না হয়েও গণহত্যা হলো কি এ কারণেই? যে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের পুরো জনপদে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, বাড়িঘর ও সহায়সম্পদ জ্বালানো হয়েছে তার উদ্দেশ্য যে প্রতিরোধ নয়, প্রতিশোধ তা কি কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? আর শিশুদের জীবন্ত আগুনে নিক্ষেপ?! ৩০শে আগস্ট রাখাইন রাজ্যের তুলাতুলি গ্রামে যা ঘটে গেলো, যা সিএনএন প্রচার করেছে এবং যা একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে তাও কি প্রমাণরূপে যথেষ্ট নয়? মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বারবার বলে বেড়াচ্ছে, প্রমাণ ছাড়া কথার কোন মূল্য নেই। আমাদের বিরুদ্ধে কোন জোরালো প্রমাণ থাকলে তা সামনে আনুন। আমরা জানতে চাই আর কত জোরালো প্রমাণের প্রয়োজন?! দশলাখ বনিআদমের দেশত্যাগ কি যথেষ্ট নয়? সঙ্গত কারণেই আমরা প্রশ্ন করতে পারি, জাতিসঙ্ঘের ‘অফিসিয়াল’ সিদ্ধান্ত কি গৃহীত হয় ন্যায়, ইনছাফ ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নয়, নিছক সুবিধা- অসুবিধা, বা পরিবেশ পরিস্থিতির ভিত্তিতে?
তুলাতুলি গণহত্যার প্রামাণ্য তথ্যচিত্র

সিএনএন জানায়, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রবাদী বৌদ্ধদের সঙ্ঘটিত গণহত্যার ভয়াবহ এক নজির সৃষ্টি হয়েছে রাজ্যটির তুলাতুলি গ্রামে। সেটা ছিলো গত ৩০শে আগস্ট রাতের আঁধারের ঘটনা। সেদিন তুলাতুলি গ্রমের লোকদের জড়ো করা হয় নদীতীরে। তারপর লাইনে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবাইকে হত্যা করা হয় এবং পুরো গ্রামের সমস্ত ঘরবাড়ী ও ফসল জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত শিশুদের ছুঁেড় ছুঁেড় ফেলা হয়। তুলাতুলির ভয়াবহ নৃশংসতার শিকার যারা তাদের একজন হলেন গণধর্ষণে ক্ষতবিক্ষত মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, তারা মানুষকে ূস্তপ করছিলো, যেন বাঁশ কেটে জড়ো করছে। সেনাসদস্যরা মমতাজকে তার তিন সন্তানসহ একটি ঘরে আটক করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমার দুই সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি। আমি নিজেও বাঁচতে পারতাম না। কারণ আমার অবস্থা এমনই শোচনীয় ছিলো যে, কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভবই ছিলো না। আমার সাতবছরের মেয়ে রাজিয়ার কারণেই বেড়া কেটে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়। একদল গ্রামবাসীর সঙ্গে বাংলাদেশে তাকে নিবিড় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। তুলাতুলির নৃশংস ঘটনার উপর একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরী করা হয়েছে। এটি করেছেন শফিকুর রহমান নামে একজন বাংলাদেশী-বৃটিশ নির্মাতা। নাফনদী পার হয়ে আসা তুলাতুলি গ্রামের নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের দৃশ্য ধারণ করার সময় তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অবস্থা জানার চেষ্টা করেন। আর তাতেই বেরিয়ে আসে তুলাতুলি গ্রামে সঙ্ঘটিত নৃশংসতম গণহত্যার ঘটনা। শফীক প্রায় ত্রিশজন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তার বিখ্যাত প্রামাণ্য চিত্রটি নির্মান করেন। এধরনের আরো বহু ঘটনাই রয়ে গেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গোচরের বাইরে। জানা যায়, তুলাতুলির ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে গ্রামের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছিলো, যাতে বলা হয়েছিলো গ্রামে রোহিঙ্গা-রাখাইন একসঙ্গে মিলে মিশে থাকবে। তাদের গ্রাম ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। পরে দেখা গেলো, এটা ছিলো নিছক প্রতারণা। উল্লেখ্য, তুলাতুলি গ্রামে ৪৩৬০ জন রোহিঙ্গার বিপরীতে মাত্র ৪৩৫ জন রাখাইনের বসবাস ছিলো।