আরাকান সংখ্যা (৩/১)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

বার্মার যমিনে হযরত আলী নাদাবীর চোখের পানি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

(আজ থেকে অন্তত চারদশক আগে হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন সফর করেছিলেন। বার্মার মুসলিম কমুনিটির উদ্দেশ্যে তখন তিনি যে ইলহামী বয়ান বা ‘অন্তর্জ্যেতিতে জ্যেতির্ময়’ যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন, সময় ও পরিস্থিতির প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে এখানে তার অনুবাদ পেশ করা হলো। তখন বার্মায় গণতান্ত্রিক সরকার ছিলো। জীবন ছিলো নিরুদ্বিগ্ন ও সুখী সচ্ছল। মুসলিম জনগোষ্ঠীর সম্পদ প্রাচুর্য ছিলো ঈর্ষণীয়। তখন হয়ত কারো কল্পনায়ও ছিলো না এখানে এই নিরুপদ্রব জনপদেও এমন ইনকিলাব আসতে পারে। এভাবে জনপদের পর জনপদ জ্বলে পুড়ে সারখার হতে পারে। পুরো একটি জনগোষ্ঠী এভাবে নিধনযজ্ঞের শিকার হতে পারে! বার্মার মুসলিম জনগোষ্ঠীর কর্তব্য তো ছিলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে আকড়ে ধরা এবং অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। কিন্তু তারা তা করেনি, বরং ডুবে ছিলো গাফলতের মধ্যে। ফলে যা অকল্পনীয় ছিলো, শেষ পর্যন্ত সেটাই হলো তিক্ত বাস্তব। ১৯৬৪ সালে সামরিক বিপ্লব এলো, যা সুখী সচ্ছল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। আর এখন তো যেন রোয কেয়ামতই নেমে এসেছে বিশেষ করে আরাকানী মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর। হযরত মাওলানা তাঁর বয়ানে পূর্ণ দরদের সঙ্গে মুসলমানদের সতর্ক করেছিলেন, যেন নিজের চোখে সবকিছু তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। আপনিও বয়ানটি পড়ে দেখুন, শব্দে শব্দে কী দরদ ব্যথা এবং কী শিক্ষণীয় কথা!!)

  (বয়ানটি তরজমা করেছেন আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফ্ফানা)


হামদ ও ছালাতের পর ...

আমার প্রিয় ভাই ও বন্ধু! দেখুন, আল্লাহ তা‘আলা বলছেন ثم جعلناكم خلائف في الأرض لننظر كيف تعملون অতপর আমি তোমাদেরকে তাদের পরে যমিনে স্থলবর্তী নিযুক্ত করেছি, যেন দেখতে পাই কেমন আমল তোমরা কর।
আপনারা জানেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবকালে পৃথিবী ও মানবজাতির কী দূরবস্থা ছিলো! দেশ-মহাদেশ এবং প্রতিটি জনপদ আল্লাহর পরিচয় ও মা‘রিফাত থেকে, ঈমান ও তাওহীদের নূর থেকে, আখলাক ও চরিত্রের মহত্ত্ব থেকে একেবারেই বঞ্চিত ছিলো। ইরশাদ হয়েছে (তরজমা) মানুষের কর্মফলের কারণে জলে স্থেল ফাসাদ-গোলযোগ দেখা দিয়েছে .... এমন ফিতনা-ফাসাদ, এমন গোলযোগ ও নৈরাজ্য যা থেকে পৃথিবীর কোন জনপদ মুক্ত ছিলো না। এমন একজন মানুষও ছিলো না যার অন্তরে রয়েছে ঈমান ও তাওহীদের নূর, খালিক ও স্রষ্টার প্রকতৃ পরিচয় বা মা‘রিফাত, যার অন্তরে রয়েছে মৃত্যুর ভয় এবং আখেরাতের চিন্তা। প্রতিটি হৃদয় ছিলো শিরক ও কুফুরের অন্ধকারে আচ্ছন্ন। চারদিকে শুধু অনাচার, পাপাচার, অশ্লীলতা ও ভ্রষ্টাচার। শুভ্রতা ও পবিত্রতা, মহত্ত্ব ও মানবিকতা ছিলো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। মূর্তির পূজা, আগুনের পূজা, চাঁদ সূর্যের পূজা, গাছ-পাথরের পূজা; এককথায় লা-শরিক আল্লাহর ইবাদত ছাড়া, সবকিছুরই পূজা হচ্ছিলো। আল্লাহর ইবাদত করার এবং এক আল্লাহর সামনে সিজদায় মাথা নত করার মানুষ বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছিলো। যুলমু অনাচার ছড়িয়ে পড়েছিলো সর্বত্র। উদরপূর্তি ও খাহিশাত ছাড়া আর কোন চিন্তাই যেন ছিলো না। মানবতার যে বৃক্ষটি পৃথিবীরমাটিতে রোপণ করে আল্লাহ তা‘আলা ছায়াদার ফলদার বানিয়েছিলেন, প্রবল কোন ঝড়ের ঝাপটায় যেন তা তছনছ হয়ে গিয়েছিলো। মানবতা ছিলো অন্তহীন এক লাঞ্ছনার শিকার। এত বড় এই পৃথিবীতে মানবতার প্রতি দরদ-ব্যথা অনুভব করবে, বিপদগ্রস্ত মানুষের কল্যাণ- চিন্তায় যন্ত্রণাদগ্ধ হবে এমন কোন দিল যেন যিন্দা ছিলো না। শুধু আত্মচিন্তা ও স্বার্থপরতা। সবাই ভুখা মরুক, আমার পেট ভরা চাই। রাজা, প্রজা, আমীর- গরীব, অভিজাত ও সাধারণ সবার একই অবস্থা। কবি - সাহিত্যিক ও জ্ঞানী-চিন্তাবিদ, তাদেরও আপনস্বার্থ ছাড়া আর কিছুতে আকর্ষণ ছিলো না। এমনকি যাদের অন্তরে আল্লাহর সামান্য কিছু পরিচয় ছিলো, অল্পবিস্তর ধর্মচিন্তা ও পরকালচর্চা ছিলো তাদেরও অন্তর ছিলো মানুষ ও মানবতার প্রতি দরদ-ব্যথা থেকে বঞ্চিত, তারাও ছিলো ‘আমি’ ছাড়া আর সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত। নিজের কুঁড়েঘরটি নষ্ট হওয়া ছিলো কষ্টের বিষয়, কিন্তু মানবতার অবক্ষয় ও বরবাদি যেন কোন চিন্তারই বিষয় নয়। আরাম আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে মগ্ন সবাই, কিন্তু মানবতার উপর এবং সেই সূত্রে নিজেরও উপর যে ঘনায়মাণ বিপদ, সে সম্পর্কে কারো কপালে ছিলো না সামান্য কুঞ্চন। সমাজের নষ্টাচার ও ভ্রষ্টাচারে কেউ যদি খুব বেশী ‘নাখোশ’ হতো তাহলে? সব ছেড়েছুঁড়ে পাহাড়-চূড়ায় ও পর্বত-গুহায় আশ্রয় নিতো, আর ভাবতো, ‘পৃথিবী পাপের ভারে ডুবছে। এখন এই ক্লেদাক্ত জীবনের
মধ্যে বাস করা কিছুতেই সঙ্গত নয়। এখন জীবন থেকে, সমাজ থেকে পলায়ন করাই নিরাপদ। কিন্তু জীবন থেকে, জীবনের দায় ও দায়িত্ব থেকে পলায়নের ফল কী হতে পারে? এর উদাহরণ তো এই যে, সাগরে জাহায চলছে এবং ভুল পথে চলছে। সামনে ঝড়তুফানের আলামত পরিষ্কার। জাহায দুলছে। এখন ডোবে কি তখন ডোবে!! অথচ যাত্রীরা গাফেল বেখবর! তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে আত্মকলহে লিপ্ত। আরেক দল মনের সুখে নাচগানে মগ্ন, আরেক দল হয়ত ধুমসে তাস পিটছে। আসন্ন বিপদ সম্পর্কে কারো কোন খবর নেই। এর মধ্যে আল্লাহর এক বান্দা ঠিকই বিপদের কথা বুঝলো। এ অবস্থায় যদি সে জাহায যেদিকে যাচ্ছে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে, বা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে, আমি কিছুই দেখতে চাই না। জাহাযের বেহুদা যাত্রীদের গাফলত বরদাশত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমি সেদিকে তাকাবোই না। জাহায যাচ্ছে পূবে বিপদ ও বরবাদির দিকে, আমি বসে থাকবো পশ্চিম মুখে। ওদের বিপদ- বরবাদি ওরাই বুঝকু! আমার চিন্তা কি! আমি তো বিপদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বসেছি। বলুন তো, ডোববে কি শুধু জাহাযের গাফেল যাত্রীরা, আর এই ‘ভালো’ মানুষটি বেঁচে যাবে?! জাহায যখন ডোববে, নিদ্রিত ও জাগ্রত সবাইকে নিয়েই তো ডোববে!! ঠিক এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ উদাহরণই পেশ করেছেন পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পেয়ারি উম্মতের সামনে। তিনি বলেছেন, যদি তোমরা নেক আমলের আদেশ না করো এবং মন্দ আমলের প্রতিরোধ না করো তাহলে তোমাদের উদাহরণ হবে সাগরে ভাসমান ঐ জাহাযের মত যাতে রয়েছে উপরে প্রথম শ্রেণী আর নীচে সাধারণ শ্রেণী। পানির ব্যবস্থা ছিলো উপরে। তাই নীচের সাধারণ যাত্রীরা পানির প্রয়োজনে উপরে আসতো, যা ছিলো প্রথম শ্রেণীর অভিজাত যাত্রীদের জন্য বিরক্তির কারণ। তাই তারা ছাফ জানিয়ে দিলো খবরদার. পানির জন্য কেউ যেন উপরে না আসে। প্রয়োজন তোমাদের, ভোগান্তি আমাদের, এ কী অনাচার!! যাও একফোঁটা পানিও পাবে না। নির্বোধেরা ভাবলো শুধু নিজেদের অসুবিধার কথা, একবারও ভাবলো না যে, উপরে বা নীচে সবাই তো একই জাহাযের যাত্রী, আর পানি তো সবার জরুরত! উপরে যদি আসতে না দাও তাহলে পানির কী উপায় হবে বেচারাদের! নীচের যাত্রীরা বাধ্য হয়ে ভাবলো, উপরের বাবুদের চোখরাঙ্গানি সহ্য করা কী জন্য! তার চেয়ে আমরা নীচে ছিদ্র করে নিই! বালতি ভরে পানি তোলবো, ব্যস কিস্সা খতম! কিন্তু কিস্সা কি তাতে খতম হবে? নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এখন যদি আল্লাহ তা‘আলা তাদের সুবুদ্ধি দেন এবং তাদের হুঁশ ঠিকানায় এসে যায় তাহলে তো নীচের লোকদের তারা নিষেধ করবেই না, বরং খোশামুদ করবে যে, ভাই ভুল হয়েছে, মাফ করে দাও। উপরে এসে খুশিমত পানি নিয়ে যাও। আল্লাহর দোহাই নীচে ছিদ্র করো না। জাহাযে যদি পানি ওঠে তাহলে তো ডুবে যাবে। তখন উপরে নীচে কেউ তো বাঁচবে না! দরিয়া তো উপর নীচের তামীয করবে না!

নবুয়তের সূচনাযুগের অবস্থা

তো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় সারা দুনিয়ায় ফিতনা-ফাসাদ, গোলযোগ ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিলো। আল্লাহর যে এক- দু’জন নেক বান্দা ও সাধু পুরুষ ছিলেন যদি সমাজের পাপাচার ও নষ্টাচারে খুব বেশী ত্যক্ত বিরক্ত হতেন তখন তারা সবকিছু ছেড়ে পাহাড়ের চূড়ায় বা নির্জন গুহায় চলে যেতেন যে, এ দুর্ভাগাদের কথা ভেবে আর কী লাভ! মরে মরুক! আমরা তো বাঁচি আসমানি গযব থেকে!! আল্লাহর এত বড় দুনিয়ায় সাধুপরুুষ হয়ত ছিলো, কিন্তু এমন একজনও সাহসী পুরুষ ছিলো না যিনি মানুষ ও সমাজের ফিতনা-ফাসাদ ও পাপাচার-অনাচারের মোকাবেলা করতে পারেন; জীবনকে সঠিক ধারায় পরিচালিত করতে পারেন। জানজীবনের পরোয়া না করে মুমুর্ষ মানবতাকে উদ্ধারের মহাকর্ম -যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। বড় বড় দেশ ছিলো। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুখ্যাতিও ছিলো। ইরান ছিলো, ভারত ছিলো। সেখানে শিক্ষাদীক্ষা ছিলো, জ্ঞানের চর্চা ছিলো, সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিলো, কিন্তু যুগের নষ্টতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং জীবন ও সমাজকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যে ময়দানে আসার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। রাজপুরুষদের তো ছিলো ভোগবিলাস, রাজ্যজয় ও প্রজাশোষণের নেশা। জ্ঞানী, গুণী ও কবি সাহিত্যিকদের তো ছিলো রাজতোষণের পেশা, আর ছিলো যশখ্যাতি অর্জনের লিপ্সা। মানবতার কল্যাণ ও সমাজ- সংস্কারের চিন্তা করার ফুরসতই ছিলো না কারো জীবনে। একজন দু’জন সাধুপুরুষ, যারা সততা ও সাধুতার টিমটিমে বাতি প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন তারা ‘আল্লাবিল্লা’ ও ধর্মচিন্তার স্বাদ ও শান্তি ত্যাগ করে মন্দলোকের সংশোধন প্রচেষ্টায় ‘জান ভুনা করার’ কথা চিন্তা করতে পারেন কী ভাবে! আপনিই বলুন, তাহলে দুনিয়ার এই বিগাড় ও ফাসাদের বিরুদ্ধে লড়বে কে? ইনসান ও ইনসানিয়াতকে সত্যের পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব পালন করবে কে? রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক জনপদে, এমন এক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, জ্ঞান ও সভ্যতার বিচারে যারা ছিলো একেবারেই পশ্চাদপদ। রোম ও পারস্যের সঙ্গে তো তুলনা করাই ছিলো বৃথা। শুধু শিক্ষা ও লেখাপড়ার কথাও যদি বলি, এমন মানুষ সংখ্যায় এত কম ছিলো যে, হাতের আঙুলে গোণা যায়। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোটা সম্প্রদায়কে বলেছেন উম্মী, আনপড়্! هو الذي بعث في الأميين رسولا

তিনিই ঐ সত্তা যিনি উম্মী, আনপড়দের মধ্যে প্রেরণ করেছেন একজন রাসূল।তো নিরক্ষর ও আনপড়, এটা ছিলো তাদের জাতীয় পরিচয় এবং জাতীয় উপাধি। অর্থনৈতিকভাবেও তারা ছিলো যাকে বলে দারিদ্র্যসীমার নীচে।ভেড়া-বকরী চরাতো, উটের গোশত ও দুধ দিয়েই দিন গুজরান হতো। উটের পশম দিয়েই তৈরী হতো তাদের তাঁবু ও কম্বল। পানি ও ঘাসের সন্ধানে জাযাবরের মত ঘুরে বেড়াতো এখান থেকে ওখানে। কাফেলা লুণ্ঠন করাই ছিলো তাদের জীবিকার বড় মাধ্যম। এ নিয়ে আবার গর্ব করে কবিতা বলতো!যে যত বড় লুটেরা সে যেন তত বড় বীর ও সাহসী। চরিত্র ও মানবিকতা বলতে কিছুই ছিলো না। কন্যাসন্তানকে  জীবন্ত পুঁতে ফেলতো। শরাব ছিলো প্রিয়তম নেশা। তাদের ভাষায় শরাবের নাম ছিলো অসংখ্য।  তাজির বললে শরাবের তাজির ও মদের ব্যবসায়ীকেই বোঝাতো। অর্থাৎ সেটাই ছিলো প্রধান ব্যবসা। মদের অনিবার্য অনুষঙ্গ হলো যিনা-ব্যভিচার। তো এর চাহিদা ছিলো এমন যে, পতাকা উড়িয়ে জানান দেয়া হতো, এটা ব্যভিচারের আড্ডাখানা! ব্যস যুগটাকেই বলা হতো জাহিলিয়াতের যুগ, অজ্ঞতা, মূর্খতা ও বর্বরতার যুগ এবং অন্ধকারের যুগ। মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য কী?মানবজাতিকে আল্লাহ তা‘আলা অযথা সৃষ্টি করেননি, নিজের ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সবাই তার আনুগত্য করবে, তার ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, এজন্য সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হয়েছে  خلق الموت والحياة ليبلوكم أيكم أحسن عملا মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যেন তিনি পরীক্ষা করেন তোমাদের যে, কে অধিক উত্তম আমলের দিক থেকে। আরো ইরশাদ হয়েছে وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون জিন ও ইনসানকে পয়দা করেছি শুধু এ জন্য যে, তারা আমার ইবাদত করবে। أفحسبتم أنما خلقناكم عبثا وأنكم إلينا لا ترجعون তোমরা কি ধরে নিয়েছো যে, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি অযথা! আর তোমাদের (আমার অভিমুখে) ফেরানো হবে না!বিশ্বজগতের কোন কিছু তো কখনো আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টির আড়াল হয় না। সবসময় সবকিছু তিনি দেখতে পান। তো পৃথিবী ও মানবজাতির এ অবক্ষয়দশা আল্লাহ তা‘আলার খুব নাপছন্দ হলো। কারণ মানুষের ভ্রষ্টাচারের ফলে তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্যই তো ব্যর্থ হতে চলেছে! মানুষকে বানানো হলো কী কাজের জন্য, আর তারা করছে কোন্ কাজ?! আরব-আজম গোটা মানবসম্প্রদায়ই তো সোজা গোমরাহি, বরবাদি ও খাসারার পথে চলেছে!! তখন আল্লাহ তা‘আলার রহমতে জোশ এলো, আর তিনি মানুষের হিদায়াত ও সংশোধনের ইচ্ছা করলেন। তিনি তো নবী ও রাসূলের মাধ্যমে মানুষের হিদায়াতের ব্যবস্থা করেন। আর সেজন্য প্রয়োজন এমন মহামানবের যিনি হৃদয় ও আত্মার পবিত্রতায় এবং আখলাক ও চরিত্রের মহত্ত্বে হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তো এখন দুনিয়ার হিদায়াত ও সংশোধনের জন্য, মানব সমাজে এক সর্বব্যাপী ইনকিলাব ও বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য এবং মন্দ থেকে ভালোর দিকে জীবনের গতিধারা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কে এগিয়ে আসবে? কাকে নির্বাচন করা হবে?! তো এটা ছিলো প্রশ্ন যে,  দুনিয়াকে খাসারা ও বরবাদির পথ থেকে ফিরিয়ে কল্যাণ ও মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন্ জাতি ও কোন্ ভূখণ্ড সামনে আসবে?! তো এ কাজের জন্য তিনি আরবজাতি ও আরবভূখ-কে নির্বাচন করলেন,আল্লাহর নবী আরবভূখণ্ডে আরবদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করলেন। তখন ইরান ছিলো, ভারত ছিলো, রোম ও গ্রীস ছিলো এবং ছিলো বাকি দুনিয়া। এরা ছিলো উন্নত জাতি এবং অগ্রসর সভ্যতার অধিকারী। জ্ঞানসাধনায় ছিলো শীর্ষশিখরে। কিন্তু মুমূর্ষু মানবতার উদ্ধারের জন্য ‘জানজীবন’ থেকে বেপরোয়া হয়ে মানবতার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এজন্য দুনিয়ার কোন জাতি ও সম্প্রদায় প্রস্তুত ছিলো না। কাজও ছিলো কঠিন ও মুশকিল এবং ধৈর্যক্ষয়ী।আমার ভাই ও বন্ধুগণ! পচন ও অবক্ষয়ের শিকড় সভ্যতার এত গভীরে চলে গিয়েছিলো এবং ইনসানিয়াতের দিল-দেমাগে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, সাধারণ প্রয়াস-প্রচেষ্টা এবং মামুলি কোন মেহনত মোজাহাদা অবস্থার আমূল সংশোধনের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। আরাম ও বিশ্রামের সঙ্গে খণ্ডকালীন সময় ব্যয় করা, নিজের সুবিধা ও স্বার্থ রক্ষা করে, সন্তান ও ঘর-পরিবার নিরাপদ রেখে ভেবে চিন্তে কাজ করা, এভাবে আর যাই হোক মানবজাতির নাজাত ও মুক্তি সম্ভব ছিলো না। গাড়ি তখন এমনভাবে কাদায় আটকে গিয়েছিলো যে, এত আরামসে তা বের হয়ে আসার অবস্থায় ছিলো না। বিগাড় ও ফাসাদ এবং বিমারি ও ব্যাধি যখন চরমে পৌঁছে যায় তখন সাধারণ চিকিৎসা ও মামুলি ঔষধ এবং হালকা তিমারদারি ও শুশ্রষায় কাজ হয় না। তখন তো প্রয়োজন হয় সর্বাত্মক চিকিৎসার, বড় বড় ঔষধের। তখন তো প্রয়োজন হয় এমন শুম্রষাকারীর যিনি জানজীবনের পরোয়া না করে দিন-রাত রোগীর সেবাযত্নে নিজেকে সঁপে দেবেন।মনে করো, তোমাদের শহর ঝড় জালোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হলো। (আল্লাহ তোমাদের জনপদকে নিরাপদ রাখুন) এই যে রেঙ্গুন নদী, ধরো এর পানি স্ফীত হয়ে শহরের ভিতরে ঢুকে গেলো। পুরো আবাদি তলিয়ে গেলো। মানুষ জলে ভাসতে লাগলো। তো এ অবস্থায় সাধারণ উদ্ধারতৎপরতায় কী কাজ হবে? সবাই যার যার কাজে লেগে থাকবে। শ্রমিক কলকারখানায়, চাকুরিজীবী অফিস আদালতে, শিক্ষার্থীরা স্কুলে মাদরাসায় যেমন ছিলো তেমনি পড়ে থাকবে। সিনেমা ও খেলার মাঠ আগের মতই সরগরম থাকবে। আহার-নিদ্রায় কোন ব্যঘাত ঘটবে না। এককথায় জীবনের যে ‘যাপনকাঠামো ছিলো তা পুরোপুরি বহাল থাকবে, আর ফাঁকে ফাঁকে উদ্ধারকাজও চলবে। তো এভাবে কিন্তু পরিস্থিতি শামাল দেয়া যাবে না। তুফান ও সায়লাবের তাবাহি থেকে জনপদকে উদ্ধার ক্রা যাবে না। সহসাই মারী ও মহামারী এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, নিজেদের যারা নিরাপদ ভেবেছিলো তাদেরও শেষরক্ষা হবে না। সবাই হালাক হয়ে যাবে।আবার ধরো বস্তিতে আগুন লেগেছে; দেখতে দেখতে পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় গাছাড়া ভাবে আগুন নেভানোর কোন চেষ্টায় কাজ হবে না। আগুন কিছুতেই নিভবে না। ছোট ছোট বোতলে পানি ছিটানো, এতে কিন্তু আগুনের তাবাহি থেকে বস্তি রক্ষা পাবে না। বরং দেখতে দেখতে গোটা বস্তি ছাইভস্মে পরিণত হবে। যারা এই ভেবে নির্লিপ্ত ছিলো যে, আগুন তো অনেক দূরে, তাদেরও শেষ রক্ষা হবে না। একসময় আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরও বাড়িঘর গ্রাস করে ফেলবে। এ অবস্থায় তো সবাই সবকিছু ছেড়ে, যত জরুরি কাজকর্মই হোক, সবকিছু ছেড়ে আগুন নেভাতে ছুটে আসে। কৃষক খেতখামার ছেড়ে, ব্যবসায়ী দোকান ফেলে, ছাত্রশিক্ষক বই কিতাব ভুলে আগুন নেভানোর জন্য ছুটে আসে। এমনকি যে মা বুকের দুধ দিচ্ছে সেও বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে ছুটে যায় বালতি হাতে। শয্যাশায়ী রোগীও ভুলে যায় যে, সে তো নড়তেই পারে না। সেও বিছানা থেকে লাফিয়ে আগুনের দিকে ছুট লাগায়। কারণ তার অবচেতন সত্তা এই বলে তাকে হুঁশিয়ারি দেয় যে, আগুন যদি এসে পড়ে তাহলে বিছানায় পড়ে থেকে তাকেও কয়লা হতে হবে।এমন দুর্যোগর্পূণ পরিস্থিতিতে এটাই আইন, এটাই নীতি ও নৈতিকতা যে, সব কাজ বন্ধ করো, আগে আগুন নেভাও, আগে দুর্গতদের উদ্ধার করো। নইলে আগুনের গ্রাস থেকে না বাজার রক্ষা পাবে, না মসজিদ মাদরাসা, আর না বাড়িঘর ও খেতখামার।ভাই ও বন্ধুগণ! এখনকার মত ঐ যুগেও বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলো,  যাদের বাণিজ্য দূর দূরান্তের জনপদে ছড়িয়ে ছিলো। আল্লাহ তা‘আলা তাদের খুব বাণিজ্যজ্ঞান ও ব্যবসায়িক বুদ্ধি দান করেছিলেন, আর তারাও ‘দুনিয়া ও মা-ফীহা’ থেকে বেখবর দু’হাতে মুনাফা জড়ো করছিলো।এখনকার মত তখনো বিভিন্ন জনপদে জমজমাট শিক্ষাকেন্দ্র ছিলো। তাদের জ্ঞানসাধনার খ্যাতি ও সুখ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো। জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের এমনই বিশাল অবদান যে, এখনো মানুষ বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়।তখনো বড় বড় রাজা ও রাজ্য ছিলো, সেনাবাহিনী ও সেনাপতি ছিলো। রাজ্যচালনা ও যুদ্ধপরিচালনায় তাদের কুশলতা ছিলো। মানুষ ইতিহাস পড়ে, আর ভাবে, এমনও সম্ভব?!ঐ সময় তারা যদি তাদের সাধ্য ও শক্তি নিয়ে মানবতার কল্যাণ সাধনে অগ্রসর হতো তাহলে বিরাট অবদান রাখতে পারতো। কিন্তু তাদের জীবন-পদ্ধতি এমন ভাবে তাদের অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলো যে, কোন দিকে নযর দেয়ার উপায়ই ছিলো না। খাঁচায় বন্দী পাখীর মত তারা ছিলো জীবনপিঞ্জিরায় বন্দী। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভোগবিলাসের নিগড়ে বন্দী যা থেকে তাদের মুক্তির না ছিলো উপায়, না ছিলো ইচ্ছা। এককথায় মানুষ যেন ছিলো জীবনের দাস এবং দাসজীবনে অভ্যস্ত।মানবজাতি ও মানবসভ্যতার ঐ ক্রান্তিলগ্নে আল্লাহ তা‘আলা আরবের এই ‘আধাবন্য’ সম্প্রদায়কে মানবতার মুক্তি ও উদ্ধারকাজের জন্য নির্বাচন করলেন। তাদের মধ্যে সবকিছুরই কমি ও ঘাটতি ছিলো। আখলাকের ঘাটতি ছিলো, চরিত্রের দৈন্য ছিলো। সম্পদ ও সভ্যতার অভাব ছিলো, শৃঙ্খলা ও উন্নত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তাদের কোন পরিচয় ছিলো না। এমন জাতির অন্তরে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের ছোহবত ও সান্নিধ্যের কল্যাণে এ চিন্তা দান করলেন যে, সময় এখন আরাম ও বিশ্রামের নয়, সন্তান-পরিবার প্রতিপালনের নয়, নয় খেতখামার ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার। মানবতা তখন ছিলো বহু শতাব্দীর যিল্লতি ও লাঞ্ছনার শিকার। এমন কোন যুলুম ছিলো না, অনাচার ছিলো না যা মানবতার বিরুদ্ধে করা হয়নি। দুনিয়া থেকে তখন হিদায়াতের আলো একেবারে বিলুপ্ত; হৃদয় ও মস্তিষ্ক থেকে সত্যের আলো সম্পূর্ণ অপসৃত। শামাদানিতে বড় বড় শামা জ্বলতো। ঘরে বালাখানায় ঝলমলে আলোর ব্যবস্থা ছিলো, কিন্তু দিলের জাহান ছিলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দুর্বল সবলের উপর যুলুম চালাতো, ‘বড়’ মানুষ ‘ছোট’ মানুষকে ‘গিলে খেতো’ যেমন সাগরে বড় মাছ ছোট মাছ গিলে খায়। রাজাবাদশাদের যেন কাজই ছিলো প্রজাশোষণ এবং সর্ব- উপায়ে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন। অভিজাত শ্রেণী যখন দুধ-মধুর নহরে ‘হাবুডুবু’ খায়, কৃষক শ্রমিক ও সাধারণ প্রজা তখন একটুকরো রুটির জন্য হাহাকার করে। না পেটে খাবার ছিলো, না দেহে কাপড় ছিলো। তার চেয়ে বড় কথা, পুরো মানবসম্প্রদায় ছিলো আল্লাহর পরিচয় ও মা‘রিফাত থেকে বঞ্চিত। এক আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি থেকে মাহরূম অবস্থায় তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছিলো। তাদের তো জানাই ছিলো না, মৃত্যুর পর কী হবে? হাশরে ছুয়াল-জওয়াব হবে, জান্নাত হবে, জাহান্নাম হবে!! ইনসানিয়াত ও মানবতার এমন দুর্দশার অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা ছাহাবা কেরামের দিলে দান করলেন পথহারা মানুষের প্রতি এবং লাঞ্ছিত মানবতার প্রতি বড় এক দরদ-ব্যথা। তারা আল্লাহর রাসূলের হাতে হাত রেখে বললেন, নিজেকে কোরবান করার জন্য হে আল্লাহর রাসূল আমরা হাযির। যখন যেখানে যেভাবে প্রয়োজন আমাদের ব্যবহার করুন। আমরা কোন ওজর-অজুহাত দেখাবো না। খেতখামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘর ও সন্তান-পরিবারের দিকে ফিরেও তাকাবো না। নিজের আরাম-বিশ্রাম ও পানাহারের কথা চিন্তাও করবো না।তারা যেমন বললেন তেমনি করলেন। ধনী তার বালাখানা এবং গরীব তার কুঁড়েঘর ছেড়ে, আমীর তার আমিরি বর্জন করে, ফকির তার ফকিরি সঙ্গে করে, বড় তার বড়ত্ব বিসর্জন দিয়ে, ছোট তার ছোটত্বের পরোয়া না করে; এভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আল্লাহর রাসূলের দাওয়াতে বের হয়ে এলো। আর তিনি তাদের একত্র করে গড়ে পিটে তারবিয়াত করে একটি জামাতের গোড়াপত্তন করলেন যার নাম হলো উম্মাতে মুসলিমা ও খায়রে উম্মত। সদাঅনুগত এই জামাতকে নিয়ে তিনি দুনিয়ার সমস্ত ফাসাদ ও অবক্ষয়ের মোকাবেলা করলেন। গোমরাহি ও বরবাদির যে আগুন সব জনপদে ছড়িয়ে পড়েছিলো, যা সমগ্র মানবতাকে সারখার করে চলেছিলো সেই সর্বগ্রাসী আগুন নেভানোর জন্য তিনি তাঁর ক্ষুদ্র, দুর্বল ও সহায়-সম্বলহীন জামাতকেই ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিলেন। একদিকে আদেশ হলো, অন্যদিকে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের উদ্দীপনায় উদ্দিপ্ত হয়ে, নিজেদের লাভ-ক্ষতির কোন পরোয়া না করে। তাদের তখন একটাই চিন্তা ছিলো; সুযোগ হলে আবার জীবনের আনন্দ উপভোগ করবো, আবার জীবনের দায়দায়িত্ব পালন করবো। কিন্তু এখন?! ধ্বংসোন্মুখ মানবতার উদ্ধার-চিন্তা ছাড়া, মানবজাতির মুক্তি ও কল্যাণের চিন্তা ছাড়া আর কোন চিন্তা নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর (স্মরণ করো ঐ সময়কে) যখন তোমরা অগ্নিগর্তের কিনারে এসে পড়েছিলে, সেখান থেকে আল্লাহ তোমাদের উদ্ধার করেছেন। এত কিনারে যে, ব্যস শুধু পতনের বাকি ছিলো। এমন কঠিন মুহূর্তে এই ক্ষুদ্র জামাত আগে বাড়লো, আর আল্লাহর পেয়ারা নবী মানুষ ও মানবতার উদ্ধারকাজে তাঁদের ব্যবহার করলেন। এমনকি যখন প্রয়োজন হলো নিজেদের প্রিয় জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে, সম্পদ সম্পত্তির লোভ বর্জন করে তাঁরা মাদীনায় হিজরত করলেন। তাঁরা হলেন মুহাজির, আর মদীনায় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা এই মুহাজিরদের সাদরে বরণ করে হলেন আনছার। এভাবে আনছার-মুহাজির একত্র হয়ে নতুন উদ্যমে মানবতার মুক্তির সংগ্রামসাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন এবং দ্বীনের প্রচার প্রসারের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন।এভাবে কিছুকাল দাওয়াতের পথে দিনরাত এককরা মেহনত মুজাহাদা থেকে যখন একটু শ্বাস নেয়ার সুযোগ হলো এবং ইসলামের গাড়ী নিজস্ব শক্তিতে নিজস্ব গতিতে চলতে থাকলো তখন, ছাহাবা কেরাম যারা ছিলেন মদীনার মূল বাসিন্দা বলেন, আমাদের দিলে খেয়াল পয়দা হলো যে, এত দিন তো দ্বীনের খেদমতে এবং ইসলামের প্রচার প্রসারের মেহনতে মগ্ন ছিলাম। এতদিন তো দ্বীনের পথে আমাদের জানমাল কোরবান হয়েছে; এদিকে খেতখামার ও ব্যবসা-বাণিজ্য সব ‘চৌপাট’ হয়ে গেছে। যাই, আল্লাহর নবীর কাছে গিয়ে কিছু দিনের ছুটি নিই। কিছুদিন জীবন-জীবিকা ও কায়কারবারের দেখশোন করি। অবস্থা যখন কিছুটা ভালো হবে তখন আবার দ্বীনের কাজে ফিরে আসবো। দাওয়াত ও জিহাদের দায়িত্ব থেকে আমরা স্থায়ী অব্যাহতি গ্রহণ করছি না। আমরা তো নিজেদের জীবনে একটু সচ্ছলতা আনয়নের জন্য সাময়িক অবসর প্রার্থনা করছি। ইতিহাস পড়–ন, ইসলামী ফৌজ ইস্তাম্বুল অবরোধ করে আছে। যুদ্ধের কোন ফায়ছালা হচ্ছে না। এমন সময় ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলো, আর আল্লাহর এক গোমনাম বান্দা লশ্কর থেকে বের হলেন এবং খৃস্টান-বাহিনীর সারি ভেদ করে অনেক দূর চলে গেলেন। তার তলোয়ার তখন যেন ঘোর অন্ধকারে বিজলির চমক। বীরত্ব ও সাহসিকতার এমন দৃশ্যে লশকর হতবাক! বলা হলো, এ তো নিছক আত্মহত্যা, ¯্রফে খোদকুশি। এ তো জিহাদের নামে নিজের জানের উপর বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন। আল্লাহ তো বলেছেন ولا تلقوا بأيديكم إلى التهلكة আর তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদেরকে তাবাহি ও বরবাদির মধ্যে নিক্ষেপ করো না। ইস্তাম্বুল অভিযানের ঐ লশকরে ছিলেন হিজরতের সময় আল্লাহর রাসূলের ভাগ্যবান মেযবান হযরত সাইয়েদেনা আবু আইয়ূব আনছারী রা.। তিনি অস্থির হয়ে বলে উঠলেন, লোকসকল, তোমরা ভুল ব্যাখ্যা করছো! আসল তাফসীর আমার কাছ থেকে জেনে নাও না! এ আয়াত তো আমাদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে! শোনো, আমরা আনছারীগণ ছিলাম খেজুর বাগানের মালিক, আবার ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিলো। আমরা দ্বীনের দাওয়াতে নিবেদিত ছিলাম। কিছুদিন পর যখন ইসলামের উন্নতি শুরু হলো তখন আমাদের মধ্যে এ ভাবনা দেখা দিলো যে, এখন তো ইসলামের খাদিমীন অনেক আছে। তাছাড়া দ্বীনের বহুত ‘বোলবালা’ হয়েছে। এখন আমরা আল্লাহর নবীর কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য অব্যাহতি গ্রহণ করি। এতদিন তো দুনিয়াদারির হুঁশ ছিলো না, এখন একটু কাজকর্ম গুছিয়ে নিই, যাতে জীবিকা ও উপার্জনের কিছু উপায় হয়। আল্লাহর নবী তো বড় মেহেরবান! অবশ্যই তিনি আমাদের সদয় অনুমতি দান করবেন। ব্যস, এ চিন্তা আসামাত্র আয়াত নাযিল হয়ে গেলো ولا تلقوا بأيديكم إلى التهلكـة আল্লাহর বান্দাগণ, এ তোমরা কোন চিন্তায় পড়ে গেলে! মানুষ যায় জাহান্নামের দিকে, আর তোমরা তাদের চিন্তা বাদ দিয়ে রোযগারের ফিকিরে পড়ে গেলে! এটা তো নিছক তাবাহি ও বরবাদি! তো নিজের হাতে নিজেকে তোমরা বরবাদির দিকে নিক্ষেপ করো না।যদি এরূপ স্থূল চিন্তায় জড়িয়ে পড়ো তাহলে কিন্তু তোমরা নিজেরাই বরবাদ হবে না, তোমাদের সঙ্গে পুরা ইনসানিয়াতও বরবাদ হবে, পুরা মানবজাতি ধ্বংস হবে। এরপরে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। তোমরা হলে মানবতার শেষ ভরসা। আকাশ ও পৃথিবী বহু যুগ ধরে তোমাদের প্রতীক্ষায় ছিলো; জ্বিন ইনসান ও ফিরেশতা তোমাদের ইনতিযারে ছিলো। তোমরা খেজুরবাগানের চিন্তায় পড়ে গেলে, অথচ ইনসানিয়াতের বাগান উজাড় হতে চলেছে! তোমাদের বাগান উজাড় হলে সামান্য কিছু খেজুরের ক্ষতি। কিন্তু ইনসানিয়াতের বাগান উজাড় হলে! মানুষ হবে জাহান্নামী; মানবতা হবে তাবাহ ও বরবাদ। হযরত আবু আইয়ূব আনছারী রা. বলেন। আমরা তখন ভুল চিন্তা থেকে বিরত হলাম এবং দ্বীনের কাজে যথাপূর্ব নিয়োজিত থাকলাম।এই আনছার ও মুহাজিরীনই তো ঐ সময় আল্লাহর নবীর হাতে নিজেদের সোপর্দ করে বলেছিলেন, আপনি আদেশ করুন, আমরা উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি! কিংবা আদেশ করুন, আমরা দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে যাই!!বন্ধুগণ, একটু চিন্তা করো, এই কোরবানী ও আত্মত্যাগের নতীজা কী হলো?! দুনিয়ার সমস্ত জনপদে ঈমান ও হিদায়াতের এমন শীতল হিমেল বায়ু প্রবাহিত হলো যে, মানবতার বাগানে বসন্তবাহার এসে গেলো। ঘরে ঘরে হিদায়াতের সুবাস পৌঁছে গেলো। মানুষ আল্লাহর পরিচয় ও মা‘রিফাত হাছিল করলো। আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হলো যে জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এভাবে মানুষ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও মাকছাদ পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগ লাভ করলো। মানব- সভ্যতার গতিপথ মন্দ ও অকল্যাণ এবং ধ্বংস ও বরবাদি হতে ন্যায় ও কল্যাণের অভিমুখী হলো। মাতৃগর্ভ থেকে যেখানে জন্ম নিচ্ছিলো মানবতার শত্রু এবং ইনসানিয়াতের দুশমন, জন্ম নিচ্ছিলো হিংশ্র পশু, হায়েনা ও নেকড়ে সেখানে ঐ মায়েদের গর্ভ থেকেই জন্মগ্রহণ করতে লাগলো ইনসানিয়াত ও মানবতার মুক্তির বার্তাবাহক। কার কার নাম নেবো তোমাদের সামনে, আবু হানিফা ও জিলানী! ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী ও মুজাদ্দিদে আলফেছানী!! এমন কোন্ জনপদ আছে যেখানে আল্লাহর নেকবান্দাদের জন্ম হয়নি! যেখানে হিদায়াতের চেরাগ রওশন হয়নি!!কীভাবে সম্ভব হলো ইনসানিয়াতের এই বসন্তবাহার?! মানবতার মুক্তির এ জোয়ার? ছাহাবা কেরামের যে মোবারক জামাত, তাঁদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং মেহনত-মোজাহাদার বদৌলতেই তো!! তখন তাঁরা যদি নিজেদের খেতখামারে, বাগবাগিচায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ে থাকতেন, যদি নিজেদের সুখসচ্ছলতা ও আরাম-বিলাস এবং প্রভাব, প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা অর্জনের চিন্তায় মগ্ন হতেন তাহলে তো পৃথিবীতে এ বিপ্লব আসতো না! এবং ইনসানিয়াতের কিসমতে এই ইনকিলাব লেখা হতো না! দুনিয়া যে পথে ছিলো সে পথেই থাকতো, বরং তার তাবাহি-বরবাদি আরো বাড়তে থাকতো। সমগ্র মানবসম্প্রদায়ের পক্ষ হতে আল্লাহ তা‘আলা এই মোবারক জামাতের উপর রহমত বর্ষণ করুন। তাঁদের পাক রূহকে ইল্লীয়্যীনের আ‘লা মাকাম নছীব করুন, আমীন।পৃথিবীর যে কোন জনপদে খুশি, যাও; আল্লাহর রহমতে দেখতে পাবে, ঈমান ও হিদায়াতের নূর এবং হক ও সত্যের আলো তোমার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। দেখতে পাবে, বড় বড় অলী-দরবেশ তাঁদের খানকায় নিয়োজিত রয়েছেন মানুষের ইছলাহ ও সংশোধনের মহান সাধনায়। বড় বড় আলিম, মুহাদ্দিছ মাদরাসায় মসনদ আলো করে সমাসীন রয়েছেন ইলমের মেহনত-মুজাহাদায়। বিশাল বিশাল কুতুবখানায় শোভা পায় কালজয়ী মনীষীদের রচনাসম্ভার।কোথায় তোমাদের এই শহর রেঙ্গুন, আর কোথায় মক্কা-মদীনার পবিত্র ভূমি! অথচ দেখো, কত শানদার সব মসজিদ, হাজার হাজার মুছল্লীর নামাযে সিজদায় কেমন আবাদ! এ মসজিদে এই যে এত শান শওকতে মাগরিব-এশা আদায় করা হলো, এ তো আর কিছু নয়, ঐ তাঁদেরই ত্যাগ ও কোরবানির নতীজা!পরবর্তী যুগের দিকে দেখুন। একই ভাবে চলে আসছে দ্বীনের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেয়ার ইতিহাস। মুজাহাদা ও কোরবানির মুবারক সিলসিলা!  নিজ নিজ সময়ের বিচারে যারা প্রায় একই রকম উচ্চতায় মহান পূর্ববর্তীদের স্থলবর্তী। প্রত্যেক যুগেই আল্লাহর কিছু বান্দা আপনি পাবেন, যারা সংসার-পরিবার, সন্তান-স্বজন, সম্পদ ও প্রতিষ্ঠা সবকিছুর মায়া ও মোহ ত্যাগ করে দ্বীনের দাওয়াত ও খিদমতের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের যোগ্যতা ছিলো, প্রতিভা ছিলো। জীবনের দৌড়ে সমকালকে অতিক্রম করার সামর্থ্য ছিলো। কিন্তু তাঁদের ছিলো এক কথা, কিছু চাই না; আমরা শুধু চাই ইনসান ও ইনসানিয়াতের এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার পরম সৌভাগ্য। এভাবে আল্লাহর বান্দারা জীবনের সবকিছু ভুলে, সবকিছু ছেড়ে শুধু দ্বীনের দাওয়াতের জাযবায় পৃথিবীর দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। একেকজন বেছে নিয়েছেন একেকটি দেশ, যেখানে মানুষ ও পরিবেশ ছিলো তাঁর প্রতিকূল। আর তিনি ঘোর অন্ধকারে আল্লাহর দ্বীন প্রচার করেছেন, মানুষের দিলে ঈমান  ও তাওহীদের আলো জ্বেলেছেন। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসেছে এবং চেরাগ থেকে চেরাগ রওশন হয়েছে। কোন যুগে, কোন অঞ্চলে একটা খ-কালীন সময়ও এমন ছিলো না যখন সেখানে দ্বীনের প্রচার প্রসার এবং দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিবেদিত কোন মহৎপ্রাণ ব্যক্তির উপস্থিতি ছিলো না। এরই নতীজা ছিলো যে, কোন জনপদ, কোন ভূখ- কখনো আল্লাহর যিকির ও স্মরণ থেকে এবং আল্লাহর পরিচয় ও প্যহচান থেকে খালি ছিলো না। এভাবে চলমান এ সিলসিলা আমাদের পর্যন্ত পৌঁচেছে।কী ছিলো তাঁদের সান্নিধ্যে?!বন্ধুগণ, একটু চিন্তা করে দেখুন, কী ছিলো আল্লাহর এই নেক বান্দাদের ছোহবতে, সান্নিধ্য ও সাহচর্যে, যাদের আমরা অলী-দরবেশ বলে জানি! কী ছিলো রহস্য যে, একজন একদেশে পৌঁছতেন, আর তাঁর নূরানিয়াতে গোটা জনপদ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করতো!!ইতিহাসের পাতায় তো এ প্রসঙ্গে অসংখ্য গৌরবোজ্জ্বল নাম রয়েছে; আমি শুধু একটি নাম নেবো। হযরত  সৈয়দ আলী হামদানী রাহ.। কাশ্মীর অঞ্চলে তিনি তিনবার এসেছেন। প্রথমবার একটি শহরে একটি স্থানে কিছুদিন অবস্থান করে ফিরে গেলেন। দ্বিতীয়বার প্রতিটি শহর, জনপদ ও বস্তিতে গমন করলেন। তৃতীয়বার দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে গেলেন ঘরে ঘরে সবার দুয়ারে। ফল হলো এই যে, এখনো কাশ্মীরের জনসংখ্যার নব্বই শতাংশ মুসলিম! এটা ছিলো আল্লাহর একজন মাত্র বান্দার যিন্দা কারামাত যে, তাঁর একার মেহনতে, বরং শুধু তাঁর চেহারার নূরানিয়াতে কাশ্মীরের সমগ্র জনপদ ইছলামের ছায়াতলে চলে এসেছিলো।আর আজ!! কাশ্মীরে কত শত মাদরাসা! কত হাজার আলেম ওলামা, পীর-মাশায়েখ!! কত বিদ্বান, কত চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কত শিক্ষিত, প-িৎ। সম্পদশালী মানুষেরও অভাব নেই, কিন্তু দশবছর আগে অমুসলিম জনসংখ্যা যা ছিলো এখনো তাই আছে। বরং বাহ্যত এমন আশঙ্কাও হয় যে, সংখ্যার পাল্লা ধীরে ধীরে ...!! পার্থক্যের কী কারণ?শুরুতে আপনাদের সামনে আমি যে আয়াত তিলাওয়াত করেছি ثم جعلناكم خلائف في الأرض من بعدهم لننظر كيف تعملون এটা হচ্ছে ইসলামের সমগ্র ইতিহাসের সারনির্যাস। সব যুগে সব অঞ্চলে আল্লাহর এমন বান্দারা ছিলেন যারা হিদায়াত ও দাওয়াতের মেহনত করেছেন, আর পুরা জনপদ ইসলাম গ্রহণ করেছে। এখন আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের, ঐ পুণ্যাত্মাদের স্থলবর্তী বানিয়েছেন। এখন তিনি দেখতে চান, কেমন হয় তোমাদের  কর্ম ও কীর্তি!! তোমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি ও কর্ম তো ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। হয়ত আঠারো জন এসেছেন, আর মেহনত মোজাহাদা এবং ইখলাছ, তাকওয়া ও লিল্লাহিয়াতের বরকতে আঠারো লাখ রেখে গিয়েছেন!  এই বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে কয়েক শ বান্দাও কি এমন হবে না, যারা অতীতের ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে পারে জীবনের অঙ্গনে!! আল্লাহ তো তাঁর পাক কালামে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, তিনি দেখতে চান কী তোমরা করো! কী তোমরা করতে পারো!! বন্ধুগণ, এটাই হলো প্রতিযোগিতার আসল ক্ষেত্র, যেখানে তোমরা দৌড়ঝাঁপ ও পণ্ডশ্রম করছো সেটা নয় وفي ذلك فليتنافس المتنافسون এটাই হলো প্রতিযোগিতার আসল ময়দান। এখানেই একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মধুর প্রতিযোগিতা করা উচিত সবার। তোমাদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য, পদ ও সম্পদ এবং সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি। কিন্তু কী পরিণতি এই অর্থহীন প্রতিযোগিতার, প্রতিদ্বন্দ্বিতার?! না তুমি নিয়ে যাবে তোমার সম্পদ কবরে, না তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী! সেও যাবে খালি হাতে, তুমিও। যে যত বেশী কামাই করবে, আসলে সে তত বেশী আফসোস ও অনুতাপ নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। তাই বলি, দুনিয়ার পথে দৌড়ঝাঁপ ও প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছেড়ে দাও। দ্বীনের পথে, দাওয়াত ও তাবলীগের পথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও, যেখানে সকল প্রতিযোগীই সফল, সবার প্রতিযোগিতাই সার্থক। তোমার আমলনামায় যদি ইসলামের উন্নতি, অগ্রগতি এবং নতুন নতুন বনী আদমের অন্তর্ভুক্তি লেখা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার জন্য রয়েছে এমন পুরস্কার যা ধারণ করার যোগ্যতা এ তুচ্ছ দুনিয়ার নেই। কিছু অংশ দুনিয়ায়ও হতে পারে, তবে আসল পুরস্কার দেয়া হবে ঐ জগতে, আখেরাতে। খাজা মুঈনুদ্দীন আজমীরী রাহ. খাজা নেযামুদ্দীন আওলিয়া রাহ. হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলয়াস রাহ. এভাবে আল্লাহর আরো বহু বান্দা, যখন তাঁদের দাওয়াতী মেহনতের আজর-ছাওয়াব দান করা হবে, আর প্রত্যেকের ভাগে আসবে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের ঈমান-আমলেরও হিস্সা তখন আল্লাহ চাহে তো বড় দেখার মত দৃশ্যই হবে!! কিন্তু আমাদের হাশর কেমন হবে?! যখন জিজ্ঞাসা করা হবে, আমি তো দাওয়াতের এত বড় ক্ষেত্র তোমাদের দান করেছি, এমন অনুকূল পরিবেশ দান করেছি, তোমরা কী করেছো। আমার কতজন পথহারা বান্দাকে আমার পথে এনেছো? তখন কী জওয়াব হবে?!ভাই ও বন্ধুগণ, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। যিন্দেগীর সবকিছু ক্ষণস্থায়ী। সম্পদ, সম্মান, প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সব ক্ষণস্থায়ী। সম্পদশালীরা শুনে রাখো, তোমার অর্জিত সম্পদ তোমার সঙ্গ ত্যাগ করবে, তোমার সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ করবে। ক্ষমতার গর্বে গর্বিত যারা, কান খুলে শুনে রাখো, ক্ষমতা তোমার হাতছাড়া হবে, এমনকি তা চরম যিল্লতিরও কারণ হতে পারে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যারা স্বাস্থ্যের গর্ব করো, আর মানুষ তোমাদের ঈর্ষা করে, শোনো, স্বাস্থ্য তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে। যা বাকি থাকবে তা শুধু আল্লাহর নাম এবং আল্লাহর পথের সমস্ত কাম। আল্লাহর দ্বীনের পথে যত মেহনত, মোজাহাদা, যত ত্যাগ ও কোরবানি, এগুলোই হবে স্থায়ী এবং চিরস্থায়ী। বড় মূল্যবান সময় হবে, যা আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতের পথে ব্যয় হবে। যদি তোমরা জীবনের যাবতীয় ব্যস্ততা ও ব্যতিব্যস্ততা থেকে সময় বের করে আল্লাহর বান্দাদের হিদায়াতের পথে ব্যয় করতে পারো তাহলে দুনিয়াতেও আল্লাহ তোমাদের অনেক বড় প্রতিদান দেবেন, আর আখেরাতে তো রয়েছে জান্নাতের পুরস্কার!ভাই ও বন্ধুগণ, দিলের কান দিয়ে আজ আমার সতর্কবাণী শুনে রাখো। যদি তোমরা দাওয়াতের পথ গ্রহণ না করো, যদি ত্যাগ ও কোরবানির রাস্তায় না চলো তাহলে এদেশে তোমাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। এটা আমি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে, রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ থেকে বলছি না, ঐ অন্তর্জ্যােতির সাহায্যে বলছি যা আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুমিনকে দান করেছেন, এদেশে তোমাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে, যদি তোমরা ইখলাছ ও লিল্লাহিয়াতের সঙ্গে দ্বীনের কাজ না করো, যদি দাওয়াতের মেহনতে ফাঁক ও ফাঁকির আশ্রয় নাও তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যে, তখন না তোমাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও কলকারখানা (২৮-এর পর  থেকে) নিরাপদ হবে, না তোমাদের ইজ্জত আবরু। মনে রেখো, যে কোন যুগে এবং যে কোন দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার ফায়ছালা আসে উপরে আসমান থেকে। আর তা তখনই হয় যখন তারা দ্বীনের মেহনত করে, ত্যাগ ও কোরবানি স্বীকার করে। দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে যখন তারা জান-জীবনের পরোয়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে; যখন তারা আল্লাহর দ্বীনকে শক্তি ও পুষ্টি যোগায় তখন আল্লাহ তা‘আলা নিজে ঐ জনগোষ্ঠীর হিফাযত ও নিরাপত্তার ফায়ছালা করেন। তাদের জন্য গায়ব থেকে নোছরাত ও সাহায্য নেমে আসে। তখন দুনিয়ার কোন শক্তি তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না।বলো দেখি, এই বার্মাদেশে তোমরা কেন এসেছো? সওদাগরি করার জন্য, ধনদৌলত ও মর্যাদা প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য? না, তোমরা তো এসেছো আল্লাহর পথভোলা বান্দাদের আল্লাহর পথে আনার জন্য। যারা আল্লাহর নাম পর্যন্ত জানে না তাদেরকে আল্লাহর পরিচয় দান করার জন্য। তোমরা তো এজন্য এসেছো যে, জাহান্নামের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে এবং জান্নাত ও তার নাজ নেয়ামতের হকদার বানাবে। তোমরা তাদের থেকে মুনাফা অর্জন করছো। তাদেরকে খরিদ্দাররূপে ব্যবহার করছো। তোমরা তাদের ঝুলি খালি করে নিজেদের ঝুলি পূর্ণ করছো। অথচ এদেশে তোমাদের আগমনের উদ্দেশ্য ছিলো, তোমরা হবে তাদের খরিদদার। তোমরা তাদের ঝুলি পূর্ণ করে দেবে জান্নাতের নায নেয়ামত দ্বারা আর নিজেদের ঝুলি পূর্ণ করবে আজর ও ছাওয়াব দ্বারা। তোমরা তো তাদের থেকে কিছু নিতে আসোনি, বরং তাদের কিছু দিতে এসেছো, ইসলামের তোহফা, নবীর তরীকা ও সীরাত এবং জান্নাতের নেয়ামত। কিন্তু এখানে এসে তোমরা জড়িয়ে পড়েছো হাজারো ধান্ধায়। তোমাদের তো পেয়ে বসেছে বাণিজ্যের নেশা, ইমারাত ও বালাখানা তৈরীর খাহেশাত। এখন আজমীরে কত সওদাগর আছে, আফগানিস্তানে রেঙ্গুনে কত ব্যবসায়ী আছে, বাগদাদে খোরাসানে কত তাজির আছে? তারা আজ কত মুনাফা অর্জন করেছে? বলো, তারা বেশী লাভবান, নাকি আজমীরের খাজা মুঈনুদ্দীন, যার আমল-নামায় আজ অসংখ্য মানুষের ঈমান, আমল জমা হয়েছে? বলো, এর চেয়ে বেশী লাভের ব্যবসা আর কী হতে পারে?!হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমাদের তো এদেশে রাখা হয়েছে দ্বিমুখী দায়-দায়িত্ব পালন করার জন্য। তোমাদের তো নিজেদের ঈমান আমলের যেমন হিফাযত করতে হবে তেমনি  করতে হবে তোমাদের সহজ সরল মুসলমান ভাইদের ঈমান আমলেরও হিফাযত। আল্লাহ না করুন, কোন বদকিসমত যদি মুরতাদ হয়ে যায়, তার ঈমান আকীদা বা আমল নষ্ট হয়ে যায় তাহলে পুরা কাউমকে আল্লাহর সামনে জওয়াবদেহি করতে হবে। একথা তখন কোন কাজে আসবে না যে, আমি এতটা মসজিদ বানিয়েছি, এত নামায পড়েছি, রোযা রেখেছি, এত মাহফিলের ব্যবস্থা করেছি। এই এই দ্বীনী কাজে শরীক হয়েছি। এগুলো কিন্তু আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য জবাব বলে গণ্য হবে না। একই ভাবে সুয়াল হতে পারে তোমাদের অমুসলিম প্রতিবেশীদের সম্পর্কে যে, আমি তো তোমাদের সুযোগ দিয়েছিলাম, অনুকূল পরিবেশ দান করেছিলাম। তোমরা তো তাদের ইসলামের ছায়াতলে টেনে আনতে পারতে। বলো তোমরা কী করেছো?!এ আয়াত আবার শুনুন ثم جعلناكم خلائف في الأرض من بعدهم অনন্তর ভূখণ্ডে আমি তোমাদের বানিয়েছি স্থলবর্তী তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরে। لننظر كيف تعملون আমি দেখতে চাই তোমরা কী করো, কীভাবে স্থলবর্তিতার দায়িত্ব পালন করো?!এটা ঠিক যে, যে যুগে আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে তা খুবই নাযুক ও কঠিন যুগ। কিন্তু সত্য তো এই যে, যুগে যুগে আল্লাহর সাহসী বান্দারা আল্লাহর উপর ভরসা করে দাওয়াতের কাজ করেই গিয়েছেন। মাথার উপর তলোয়ার ঝুলছে। জানের নিরাপত্তা নেই। শ্বাস নেয়ারও যেন স্বাধীনতা নেই। তখনো আল্লাহর বান্দারা মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। তাতারীদের হাতে মুসলিম শাসকদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। যুদ্ধের সিপাহীরা ময়দান ছেড়ে পালিয়েছে, কিন্তু দাওয়াতের সিপাহিরা তাদের ময়দানে অটল ছিলো, অবিচল ছিলো। ফল কী হয়েছে? তাদেরই হাতে তাতারী কাউম ইসলাম গ্রহণ করেছে।এই যে আজ বার্মার বিশাল ভূখ- ও জনপদ তোমাদের সামনে পড়ে আছে। বার্মার বাসিন্দাদেরকে কুদরত তোমাদের হাওয়ালা করেছেন যে, তোমরা তাদের ঈমান ও তাওহীদের পথে আনো। ইসলামের আলো দ্বারা তাদের হৃদয়কে আলোকিত করো। বিশ্বাস করো, তোমাদের এখানে আনা হয়নি শুধু কামাইরুজির জন্য, ধনদৌলত অর্জনের জন্য। আল্লাহ তো তোমাদের স্থলবর্তী করেছেন ঐ সকল মহান পূর্ববর্তীদের, যারা দুনিয়াতে হিদায়াত ও তাবলীগের মেহনত করেছেন, যাদের হাতে জনপদের পর জনপদ মুসলমান হয়েছে। সেই মহান ব্যক্তিগণের উত্তরসূরীরূপে আল্লাহ তা‘আলা আজ তোমাদের হাতে এই বিশাল জনপদ, এই বিপুল জনগোষ্ঠী অর্পণ করেছেন যেন তোমরা তাদের পিছনে দাওয়াতের মেহনত করো। আগামীকাল তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে যে, কী করেছো?!তোমরা ভেবেছো, এখানে তোমরা নিজেদের পক্ষ হতে এসেছো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা ধনদৌলত কামাই করার জন্য এসেছো, অথচ হাকীকত এই যে, আল্লাহ তোমাদের এখানে এনেছেন হিদায়াতের মেহনত করার জন্য, দাওয়াত ও তাবলীগের মোজাহাদা করার জন্য। আল্লাহর বান্দাদের আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু এখন তো অবস্থা বিপরীত দেখা যাচ্ছে। এখন তো আঠারো বিশলাখ মুসলমানের যে আবাদী তাদেরই ঈমান খাতরায় পড়ে গেছে। ইরতিদাদ ও ধর্মত্যাগের ফিতনা শুরু হয়ে গেছে। বৌদ্ধধর্ম ও খৃস্টধর্ম গ্রহণের প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। ভাই ও বন্ধুগণ, এখন তো আপনাদের দায়িত্ব হবে দ্বিমুখী। প্রথম দায়িত্ব হবে এই সহজ সরল মুসলিম ভাইদের ঈমান ও আমলের হিফায, দ্বিতীয় দায়িত্ব হবে এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে সত্যের পথ দেখানো, জাহান্নামের আগুন থেকে উদ্ধার করা এবং জান্নাতের পথে টেনে আনা। তাদের প্রতি এমনিতেও তোমাদের দায়দায়িত্ব রয়েছে। একই বাতাসে তোমরা শ্বাস গ্রহণ করো। একই পানিতে তোমরা পিপাসা নিবারণ করো এবং একই যমিনে তোমরা বিচরণ করো। তাহলে কীভাবে তারা জাহান্নামের দিকে যাবে, আর তোমরা নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থাকবে?! আজ তোমরা বুঝতে পারছো না, বরং বুঝতে চাচ্ছো না, কিন্তু মৃত্যু তো আসবে এবং হাশরে হাউযে কাউছারের পাড়ে আল্লাহর নবীকে তো মুখ দেখাতে হবে। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে হিসাব দিতে হবে নিজেদের এবং এই জনপদের মানুষের।দ্বীনের ফিকির যদি না করো।বার্মার ভূমিতে আজ সবচে জরুরি কাজ এবং সবচে’ বিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার কাজ হচ্ছে পূর্ণ একাগ্রতার সঙ্গে জানমাল সব খাপিয়ে দ্বীনের দাওয়াতের পিছনে মেহনত করা। এটাই আজ তোমাদের জন্য সময়ের একমাত্র দাবী। এটাই এ দেশে তোমাদের জন্য একমাত্র রাজনীতি। আল্লাহ না করুন, যদি তোমাদের এ দেশ বুদ্বিস্ট স্টেট হয়ে যায় তখন ভাবো তো কী কঠিন পরিস্থিতি হতে পারে?! শোকর করো যে, এখনো তা হয়নি। এখনো যদি তোমরা দ্বীনের ফিকির না করো, দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত মোজাহাদার ফায়ছালা না করো, আর ঐ পরিস্থিতি এসে যায়, যার আশঙ্কা করা হচ্ছে তখন কিন্তু কেউ তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না। আল্লাহ যদি তোমাদের বুঝ দান করে থাকেন, একেবারে সাধারণ মোটা বুঝ তাহলেও তো একখা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ততা ও দায়বদ্ধতা ছাড়া এ দেশে তোমাদের থাকা সম্ভব নয়। এখন তোমাদের নিজেদের প্রতি সবচে’ বড় দয়া ও কল্যাণকামিতা এটাই হবে যে, ইসলামের জন্য নিজেদের ফানা করে দাও। হার মুসলিমকে এমন ঈমানদার বানাও যেন বড় থেকে বড় তুফান, ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পও ঈমান থেকে তাদের বিচ্যুত করতে না পারে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর দ্বীনের পায়গাম পৌঁছে দাও। ব্যাপকভাবে তা‘লীমের ব্যবস্থা করো। ঘরে ঘরে প্রত্যেক পরিবারে ইসলামী তাহযীব, ইসলামী আখলাকের চর্চা করো। শিরক ও বিদ‘আতমুখী রসম রেওয়াজ সম্পর্কে মুসলমান ভাইদের সতর্ক করো যে, এটা তাদের জন্য মৃত্যুর শামিল, এটা তাদের জাতীয় অস্তিত্বের জন্য আত্মঘাতী কাজ। শরীয়তবিরোধী কোন কাজে শরীক হওয়া, বিদআতের কোন মাহফিলে শামিল হওয়া এমনই যেমন বিষের পেয়ালায় চুমুক দেয়া, বরং এটা আরো বেশী খতরনাক। শিরক ও বিদআতের প্রতি ঘৃণা তাদের অন্তরে, নতুন প্রজন্মের দিল ও দেমাগে বদ্ধমূল করে দাও। মেরে ভাই, যদি তোমরা এ বিষয়ে সামান্য শিথিলতা বা গাফলত প্রদর্শন করো তাহলে এখন তো আমি আছি তোমাদের সতর্ক করার জন্য, জানি না আমার কথাগুলো ধরে রাখার জন্য টেপরেকর্ডার আছে কি না, তবে যারা দিলের কান দিয়ে শোনবে তারা একসময় আমার কথা অবশ্যই স্মরণ করবে। আমি কোন অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী ‘ছাহিবে ফিরাসত’ মানুষ নই, যাকে দশবিশবছর আগেই আল্লাহ তা‘আলা গায়বের কিছু দেখিয়ে দেন। এটা তো এত মোটা দাগের, এত খোলা চোখের কথা যে মেঘ জমতে দেখে, মেঘের ডাক শুনে ঠা-া বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে বলে দিলো, বৃষ্টি হবে, আর বৃষ্টি হয়ে গেলো। এতে বুযুর্গির কী আছে! বাচ্চাও তো এটা বুঝতে পারে। তো আমি তোমাদের তেমনি মোটা দাগের একটা কথা বলছি যে, সামনে খুব কঠিন দিন আসছে। আল্লাহর ওয়াস্তে এখন তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্মকে এতটা গুরুত্ব দিয়ো না যতটা দিয়ে চলেছো। এখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু দ্বীনের জন্য কিছু কাজ করো। বার্মার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঈমান ও তাওহীদ এবং ইসলামী তাহযীব ও নবীর সুন্নাতের আওয়ায প্রত্যেক মুসলমানের কানে পৌঁছে দাও। মুসলিম শিশুদের তা‘লিম ও তারবিয়াতের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা করো। এমন সব গ্রামও খুঁজে বের করো যার নাম কখনো শোনা যায়নি। দেখো ঐ গ্রামে কোন মুসলাম আছে কি না। গিয়ে তার পায়ে পড়ো। দিলের দরদ ঢেলে বলো, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি তো মুসলামান! ইসলামের উপর বেঁচে থাকো এবং ইসলামের উপর মৃত্যু বরণ করো। এখনো এরূপ কাজ করার সুযোগ আছে, জানি না কত দিন এ সুযোগ থাকবে। যদি তোমরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার শুরু করে দাও, ইনশাআল্লাহ তাহলে আল্লাহ তা‘আলা এই ভূখ-ে দ্বীনের হিফাযতের, বরং প্রচার প্রসারের ফায়ছালা করবেন এবং এর ছায়ায় তোমাদের, তোমাদের বিবিবাচ্চা-দেরও হিফাযতের ফায়ছালা হবে। এদেশের মানুষের কাছে তোমাদের এমন ইযযত ও মর্যাদা দেবেন যে, কল্পনাও করতে পারবে না। এমনকি অবাক হওয়ার কিছু নেই, যদি এ দেশের শাসনব্যবস্থার দায়িত্বও আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের হাওয়ালা করে দেন। কারণ হুকুমত বলো, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রক্ষমতা যাই বলো এগুলো হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের জন্য মেহনত ও কেরাবানির অনুগত। দেখো না, আল্লাহর বান্দারা বদরে অহুদে কিছু মেহনত করেছেন, কিছু কোরবানি দিয়েছেন, দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য কিছু আরাম আয়েশ ত্যাগ করেছেন, আর তার নতীজা হলো এই যে, পরবর্তী যুগে তাঁদেরই বংশধর হারুন রাশীদ আকাশে ভাসমান মেঘকে খেতাব করে বলছেন, যাও যেখানে ইচ্ছা বর্ষণ করো, তোমার খারাজ, তোমার ফসলের দানা তো আমার কাছেই আসবে। কত বিশাল বিস্তৃত রাজত্বের অধিকারী ছিলেন তাহলে! এটা তো আল্লাহর দ্বীনের জন্য মেহনত-মোজাহাদা এবং ত্যাগ ও কোরবানির অতি সামান্য পুরস্কার। আসল পুরস্কার তো হবে আখেরাতে। আজ আমি তোমাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, তোমরা যদি রুষ্ট হও তবু বলতে চাই। আমার যদি সাধ্য থাকতো, তোমাদের উপর ক্ষমতা চলতো তাহলে দু’চার মাসের জন্য নয়, দু’চার বছরের জন্য সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় আমি তালা লাগিয়ে দিতাম, আর বলতাম, এখন সব কাজবন্ধ করে শুধু এই এক কাজ করো, দ্বীনের মেহনতের কাজ, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ। ঘরের চিন্তা করো না, পরিবার পরিজনের চিন্তা করো না। প্রয়োজনে তালিযুক্ত কাপড় পরো, শুকনো রুটি খাও, তাও যদি না পাও অনাহারে থাকো, পেটে পাথর বাঁধো। কিন্তু দশবছর পর্যন্ত শুধু দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত করো। তারপর দেখো, কী ফল তোমাদের হাতে আসে! দ্বীনের গাড়ী দেখবে তখন নিজের গাতিতেই চলতে থাকবে আর তোমরা বসে বসে ফল ভোগ করবে। ছাহাবা কেরামের মেহনত মোজাহাদার ফলই তো এখনো আমরা ভোগ করছি, যদিও সময়ের দীর্ঘ দূরত্বের কারণে গাড়ীর গতি কমে এসেছে। তাই এখন প্রয়োজ নতুন গতি সৃষ্টি করার। এখনো গাড়ীর চাকা চলছে, একেবারে থেমে যায়নি। তোমরা যুগে যুগে নিজেদের পাপাচার ও স্বেচ্ছাচারের বোঝা, ভ্রান্ত শাসনের বোঝা এই গাড়ীর উপর চাপিয়ে দিয়েছো তাই গাড়ীর গতি কমে গিয়েছে। না হলে এখনো জোর গতিতেই দ্বীনের গাড়ী চলতে থাকতো।  এখনো ইসলামের অগ্রগতি অব্যাহত থাকতো। ছাহাবা কেরাম তো সেই মোবারক জামাত যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট, আর তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁদের মাত্র তেইশ বছরের ধাক্কায় এখনো দ্বীনের গাড়ি ধীর গতিতে হলেও চলছে। আর ধীর গতির কারণও আমাদের কর্মফল। ছাহাবা কেরামের জামাত তো এমনই মোবারক যে, যেখানে যেখানে তাদের পদধূলি পড়েছে সেখানকার মৌসুম বদলে গেছে, আবহাওয়া বদলে গেছে। যমিন-আসমান বদলে গেছে। ধর্ম বদলে গেছে, ভাষা বদলে তাহযীব ও তামাদ্দুন বদলে  গেছে। এমনকি সেখানে এখনো ইসলাম বিজয়ী অবস্থানে রয়েছে। ভাই ও বন্ধুগণ, আমি তো মনে করি, পরিবেশ এতই অনুকূল যে, তোমরা যদি এই অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মেহনত করো তাহলে তারা তোমাদের ইশারার উপর চলতে প্রস্তুত, কিন্তু তোমরাই তো মেহনতের জন্য তৈয়ার নও। কত বড় যুলুমের কথা যে, এর পরো তোমরা বসে আছো!তোমাদের এ দেশের সমস্যা বড়ই নাযুক। যত দল আছে, উপদল আছে সব ভেঙ্গে দাও, এক হয়ে যাও। এখন বিভেদ বিলকুল হারাম। তোমরা সারা দেশে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ো যেন কোন জনপদ, কোন শহর ও বস্তি বাদ না যায়। প্রত্যেক জনপদে, প্রত্যেক ঘরে পৌঁছে যাও। প্রতিটি মুসলিম পরিবারে ইসলাম ও তাওহীদের আওয়ায পৌঁছে দাও। ইসলামের তাহযীব ও আখলাকের উপর প্রজন্মকে গড়ে তোলো। মুসলিমকে পোক্ত করো তাওহীদের উপর, ঈমানের উপর, ইসলামী তাহযীবের উপর। আর অমুসলিমকে নরম ও নমনীয় করো, উদারতা ও মহত্ত্ব দ্বারা, হামদর্দি ও সহানুভূতি দ্বারা। মুসলমান এখন মোমের মত নরম। যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে নোয়ানো যায়। তো মুসলমানকে ইস্পাতের মত দৃড় করো। আর অমুসলিম, যাদের দিল এখন লোহার মত, পাথরের শক্ত সেই দিলকে মোমের মত নরম করো। যখন সে ইসলাম গ্রহণ করবে তখন তাকে ইস্পাতের মত দৃড় করো। তোমার অমুসলিম ভাইকে প্রথমে ঈমানের উষ্ণতা দ্বারা, আখলাকের উষ্ণতা দ্বারা বিগলিত করো। যখন সে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং শিরক ও কুফুরি ছেড়ে দেবে  তখন তাকে ইসলামের উপর, ঈমান ও তাওহীদের উপর ইস্পাতের মত দৃঢ় করো।ব্যস, এ দুটোই হলো তোমাদের করণীয়। তৃতীয় কোন কাজ নেই। মসলিমকে ইসলাম ও তাওহীদের উপর অনমনীয় করা, অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি নমনীয় করা, যাতে সে ভিতরের ডাকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। যদি তোমরা এ কাজদুটি করো তাহলে নিজেদেরই উপর ইহসান ও অনুগ্রহ করা হবে, ইসলামের উপর নয়। স্পেনের মুসলমানগণ এটা করেনি। তাই কান ধরে তাদের বের করে দেয়া হয়েছে। চাচা-ভাতিজার মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। ভোগবিলাসে কেউ কারো চেয়ে কম নয়। ইমারত, আর বালাখানা বানাতের ব্যস্ত। একটির চেয়ে একটি শানদার মসজিদ, প্রাসাদ। আলহামরা তো এখনো দুনিয়ার জন্য তাজ্জবের বিষয়! আজো তা পর্যটকদের বিস্ময় আকর্ষণ করে। কিন্তু আল্লাহর কাছে এগুলো যিন্দেগির যামানত এবং জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারে না। ঐতিহাসিকগণ লিখছেন, স্পেনে মুসলিম জাতির পতনের একটি বড় কারণ এই যে, তারা ইসলামের দাওয়াত ছেড়ে দিয়েছিলো। তাবলীগের মেহনত থেকে সরে গিয়েছিলো। তারা ভুলেই গিয়েছিলো যে, এমন দেশে তারা বাস করছে যেখানে অমুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। চারদিকে খৃস্টান জনপদ, আর তাদের অবস্থান হলো বত্রিশ দাঁতের মধ্যে যেন জিহ্বা! তাদের তো কর্তব্য ছিলো ইসলামের প্রচার প্রসারে সর্বশক্তি ব্যয় করা, ঈমানের উষ্ণতা দ্বারা, আখলাকের কোমলতা দ্বারা। তাদের তো কর্তব্য ছিলো এমন পরিবেশ তৈরী করা যাতে ইসলামের সেখান থেকে বের হওয়ার কোন প্রশ্নই না ওঠে। কিন্তু কোথায় আজ স্পেনে ইসলাম! নিজেদের ঈমান হয়েছে কমযোর, আত্মকলহ দ্বারা, ভোগবিলাসের মগ্নতা দ্বারা। আর অমুসলিমদের দিল হয়ে গেছে বিদ্বেষে কঠিন।ফল এই হলো যে, আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হলো। আসমানের ফায়ছালা নেমে এলো যে, বের হও। আমি না তোমাদের শানদার মসজিদের পরোয়া করি, না আলহামরার। না তোমাদের কর্ডোভার পরোয়া করি, না গ্রানাডার। কত বড় আলিম, ইমাম, মুজতাহিদ পয়দা হয়েছেন স্পেনের মাটিতে, কিন্তু এসবের কোন পরোয়া নেই আমার। যিন্দেগির যামানত এবং জীবনের নিরাপত্তা লাভের জন্য যা করণী তা তো তোমরা করোনি, সুতরাং إن الله لا يغير ما بقوم جتى يعيروا ما بأنفسهم আমি তো কোন কাউমের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাই না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।আল্লাহ তা‘আলা কাউকে কোন নেয়ামত দান করে ততক্ষণ তা ছিনিয়ে নেন না, যতক্ষণ না নিজেরাই তারা নেয়ামত থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে।ব্যস, বন্ধুগণ, এটাই হলো সময়ের দাবী, ইসলামের দাবী। দোকান থাকবে, কলকারখানা থাকবে, পদ ও সম্পদ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সবই থাকবে, নিশ্চিন্ত থাকো, সবই তোমাদের অপেক্ষায় থাকবে, শুধু ইসলামের জন্য আজ কিছু কোরবানি করো। এখানের মাটিতে ইসলামের শিকড় মজবূতভাবে গেড়ে দাও। ইসলামের পরিধি বিস্তৃত করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ এ দেশ তোমাদেরই থাকবে চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করছি, এ দেশ তোমাদের। কারণ আল্লাহ বলছেন ولقد كتبنا في الزبور من بعد الذكر أن الأرض يرثها عبادي الصالحون * إن هذا لبلاغا لقوم عابدين ক্ষমতা ও ভূখণ্ডের মালিকানা বড় কোন কথা নয়। তবে তা অর্জনের পথ এটাই যে, মুমিনের যিন্দেগির উদ্দেশ্য যেন ক্ষমতা ও হুকূমত না হয়। দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগ যেন হয় উদ্দেশ্য। আল্লাহর পথভোলা বান্দাদের আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনাই যেন হয় উদ্দেশ্য। যমিনে হিদায়াতের ফসল চাষ করো। হুকুমতের ঘাস নিজে নিজেই তাতে গাজিয়ে ওঠবে।ব্যস, আমার কথা শেষ। হাকীকত ও সত্য তো এই যে, আল্লাহ তাআলা যখন দয়া ও করুণা করতে চান তখন সঠিক সমঝ ও বুঝ দান করেন।
 


     
        






























শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা