জুমাদাল উলা ১৪৩২ হিঃ (২০)

তোমাদের জন্য

সজ্জার প্রয়োজনে সম্পাদনা

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ বিন মিছবাহ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

কলমের কোন নতুন মুসাফিরের জন্য বড় সৌভাগ্যের বিষয় কী? বিভিন্ন উত্তর হতে পারে এবং সেগুলোর নিজস্ব মূল্যও থাকতে পারে, তবে এখন আমার যা মনে হয় তা হলো, কোন আদর্শ সম্পাদকের সান্নিধ্য লাভ করা এবং তাঁর কাছে থেকে, বরং তাঁর ছায়ায় থেকে; না শুধু ছায়ায় থেকে নয়, বরং তাঁর মায়ায় থেকে সম্পাদনা অবলোকন, অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম করা, আর হৃদয়-উদ্যান থেকে তাঁকে কৃতজ্ঞতার ফুল নিবেদন করা।

‘কায়া, ছায়া ও মায়া’, এই তিনের মোহনায় দাঁড়িয়ে কিছু অর্জন করার কত সুযোগ ও সম্ভাবনা আমার ছিলো, কিন্তু ...!

তবে আল্লাহর শোকর। কিছু না হওয়ার মধ্যেও একটি উপলব্ধি হয়েছে। সেটি বলি; হয়ত আল্লাহর কোন বান্দার দু‘আ পাবো। কথাটি হলো, ‘ভুগোলের মানচিত্রে যারা দূরে, ভালোবাসার মানচিত্রে তারা অনেক কাছে থাকতে পারে, আবার কাছে থেকেও হৃদয়ে যদি ভালোবাসার মানচিত্র না থাকে, তারা পড়ে থাকে অনেক দূরে।

আজ সম্পাদক বাবার ছায়ায় ও মায়ায় বসে তাঁর কিছু সম্পাদনা অবলোকন করার সৌভাগ্য আল্লাহ দান করেছিলেন। এ সৌভাগ্যে, আমি মনে করি, সবার হক আছে। আর হকদারের কাছে হক পৌঁছে দেয়া কর্তব্য। সে জন্যই আজকের এ লেখা।

কাকে বলে সম্পাদক, আর কত প্রকার হতে পারে সম্পাদনা তা বোঝার না আমার বয়স হয়েছে, না যোগ্যতা। তবু কীভাবে যেন সাহস করে বললাম, সম্পাদক ও সম্পাদনা বিষয়ে তিনি যেন পুষ্পের পাতায় কিছু লেখেন, আর আশ্চর্য, তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা’।

আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন, আমীন।

সম্পাদনার একটি প্রকার যা আমরা পুষ্প-সম্পাদকের কাছে পেয়েছি তা হলো সজ্জার প্রয়োজনে সম্পাদনা। এসম্পর্কে কিছু কথা তিনি এসো কলম মেরামত করি বইয়ে (পৃ. ২৯, ৩৫, ৩৭) বলেছেন।

তো সজ্জার প্রয়োজনে সম্পাদনার একটি নমুনা আজ দেখতে পেলাম; সেটাই এখানে তুলে ধরছি।

হযরত মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের লেখা মিছবাহী আদবের একটি ঝলক ছাপা হয়েছে বর্তমান সংখ্যার দ্বাদশ পৃষ্ঠায়। সম্পাদক সাহেব প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলেন, লেখাটি পৃষ্ঠার বাইরে যাবে না। তাতে প্রথম সম্পাদনার পর লেখাটি হয়ে গেলো দশ পয়েন্টের খুব ছোট টাইপে। পরবর্তী সম্পাদনার পর  লেখাটি ভাষা ও কাঠামোগত দিক থেকে মোটামুটি সুন্দর হলো এবং কলেবরেও কমে এলো। ফলে একটু বড় টাইপ (সাড়ে দশ পয়েন্ট) ব্যবহার করা সম্ভব হলো।

সম্পাদক সাহেব বলেন, লেখাটি এখন গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে চলে এসেছে। আর সম্পাদনা না করলেও চলে। কিন্তুযে কোন মূল্যে লেখাটিকে একপৃষ্ঠায় এগার পয়েন্টে আনতে হবে। তো সজ্জাগত এই প্রয়োজনের তাগিদে তৃতীয় সম্পাদনাটি করা হয়েছে। তাতে উদ্দেশ্য যেমন অর্জিত হয়েছে তেমনি লেখাটি কাঠামো ও ভাষা- সৌন্দয আরো বেড়েছে।

সম্পাদক বাবা আমাকে নীচের নমুনাটি দেখালেন-

তো দেখুন, একটা বাক্য নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা করলাম, এতক্ষণে হয়ত চার/পাঁচ পৃষ্ঠা পড়া হয়ে যেতো, কিন্তু সাহিত্যের  রুচি, বোধ  ও বিচারশক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সেটা বেশী কল্যাণকর, না এটা? 

দশ পয়েন্টের টাইপে যা এসেছে ছয় লাইনে এগার পয়েন্টে তা আসবে সাত লাইনে। সুতরাং আমাকে যথাসম্ভব শব্দ কমাতে হবে।

আমি বললাম, সজ্জার প্রয়োজনে যে সম্পাদনা তাতে তো লেখার সৌন্দর্যহানি হতে পারে?

তিনি বললেন, কমে গেলে তো সম্পাদনা হলো না। সম্পাদনা তো তখনই বলা হবে যখন সংকোচন বা সম্প্রসারণের কারণে সজ্জা সুন্দর হবে, আবার ভাষাসৌন্দর্যও বাড়বে, অন্তত কমবে না।

তিনি আরো বললেন, আসল ও মূল সম্পাদনা হয় লেখাটির শরীর-কাঠামো ও ভাষাগত দিক থেকে। সেটা চলতে থাকে যতক্ষণ না লেখাটি মানোত্তীর্ণ হয়। যখন মনে হয়, মোটামুটি মানোত্তীর্ণ হয়েছে, তখন আর ভিতর থেকে সম্পাদনার তাগাদা আসে না। কিন্তু সজ্জাগত প্রয়োজন দেখা দিলে তখন ভিতর থেকে একটি বাধ্যতামূলক প্রেরণা আসে এবং দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। ফলে এমন কিছু বিষয় নযরে আসে যা মূল সম্পাদনার সময় আসেনি। তাতে সজ্জাগত সৌন্দর্য যেমন আসে তেমনি শরীর কাঠামো ও ভাষাগত দিক থেকেও বাড়তি সৌন্দর্য আসে।

আমি বললাম, পত্রিকার সজ্জা তো বই আকারে ছাপার সময় থাকবে না; তখন তো নতুন সজ্জা আসবে?

তিনি বললেন, তা আসবে, তবে তখন বর্তমান সৌন্দর্যের সঙ্গে নতুন সৌন্দর্য যুক্ত হবে। ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’-এ বিষয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা সংরক্ষণ করতে পারলে ভালো হতো।

তিনি আরো বললেন, সজ্জাগত কারণে যে সম্পাদনা তাতে সংকোচন ও সম্প্রসারণ দু’টোই হতে পারে। এখন যে নমুনাটি দেখাবো তাতে অবশ্য সংকোচনের প্রয়োজন ছিলো। পরে সুযোগ হলে সম্প্রসারণের নমুনাও দেখাবো ইনশাআল্লাহ।

এরপর তিনি সজ্জাগত সম্পাদনা শুরু করে বললেন, উপরের নমুনাটি আবার পড়ো। পড়লাম। তখন তিনি বললেন, চিন্তাকে শাণিত, দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ এবং কানকে সজাগ করে নমুনাটি পড়লাম। প্রথমেই নযরে পড়লো ‘বোধ’ শব্দটি। মনে হলো এর প্রয়োজন নেই। বাদ দিয়ে লিখলাম, ‘কিন্তু সাহিত্যের রুচি ও বিচারশক্তি’। একটা শব্দ কমলো, আবার! পাশাপাশি দু’টি রহ্র-ইকারে ছন্দের সৌন্দর্য এলো।

(সর্বশেষ তিনি বললেন, তার চেয়ে ভালো হয়, রুচিবোধ একসঙ্গে বলি, তাতে দুদিকে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়ে আরো সুন্দর হয়যেমন সাহিত্যের রুচিবোধ ও বিচার শক্তির ক্ষেত্রে কোনটি উত্তম?)

তারপর মনে হলো ‘সেটা না এটা’ বাদ দিয়ে প্রশ্নটিকে ছোট করা যায়, আর কল্যাণকর-এর চেয়ে উপকারী শব্দটি যেমন ছোট তেমনি এখানে অধিকতর উপযোগী। তারপর মনে হলো ‘উত্তম’ শব্দটি আরো উত্তম। তখন লিখলাম, ‘কিন্তু সাহিত্যের রুচি ও বিচারশক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে কোনটি উত্তম?

শব্দ কমে এলো, কিন্তু উত্তম শব্দটি নীচে রয়ে গেলো। সেটা উপরে আনতে পারলে একটি লাইন কমে। তখন আবার শুরু থেকে চিন্তা শুরু হলো, হঠাৎ মনে হলো ‘করলাম’ ক্রিয়াটিতে ছন্দপতন ঘটে এবং ভাবের গতিটা হারিয়ে যায়। যদি বলি, ‘এই যে একটা বাক্য নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা, এতক্ষণে হয়ত চার/পাঁচ পৃষ্ঠা... তাহলে কথার অসমাপ্তির একটি ‘ধাক্কা’ সৃষ্টি হয় এবং বক্তব্যটা জোরালো হয়। তুমি দু’রকম করে পড়ে দেখো।

এখন ‘উত্তম’ উপরে এসে গেছে। দশ থেকে এগার পয়েন্টে আনলাম। কিন্তু হায়, এত চেষ্টা করে লাইন কমালাম, এখন আবার ‘উত্তম’ নীচে চলে গেলো।

সম্পাদক সাহেব বললেন, হতাশ হলাম যে, লাইনটা বোধ হয় আর কমানো গেলো না। কিন্তু হঠাৎ দেখি, একটা উপায় এখনো আছে। ‘চার/পাঁচ পৃষ্ঠা’ বলার দরকার কী? ‘কয়েক পৃষ্ঠা’ বললেই তো হয়! লিখলাম। তাতে কলেবর কমলো, কিন্তু উপরে ‘উত্তম’-এর জন্য যথেষ্ট জায়গা হলো না। কী মুশকিল! হঠাৎ মনে হলো। পড়া হয়ে যেতো-এর স্থানে ‘পড়া হয়ে যায়’ যদি বলি, আরো সুন্দর হয় এবং ‘উত্তম’ উপরে চলে আসে। তারপর মনে হলো, যদি বলি, ‘অনেক দূর পড়া হয়ে যায়’ তাহলে কেমন হয়? লিখলাম-

তো দেখুন, এই যে একটা বাক্য নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা, এতক্ষণে হয়ত অনেক দূর পড়া হয়ে যায়, কিন্তু সাহিত্যের রুচি ও বিচারশক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে কোনটি উত্তম? 

এখন সজ্জাগত সম্পাদনার পূর্বাপর রূপদু’টি পড়ে তুমিই বলো, দশ পয়েন্টের সাত লাইন থেকে এগার পয়েন্টের পাঁচ লাইনে এসেছে, সেই সঙ্গে ভাষা-সৌন্দর্য বেড়েছে কি না?

অথচ সজ্জাগত প্রয়োজন দেখা না দিলে এই সম্পাদনার জন্য তো বসতাম না!

আমি বললাম, এজন্য তো অক্ষর-বিন্যাস ও সজ্জার কাজ লেখক ও সম্পাদককেই করতে হবে?

তিনি বললেন, হাঁ, তবে প্রুফের সময়ও কিছু করা যায়। যখন কম্পিউটার ছিলো না তখনো আমি এই সম্পাদনা করেছি। আচ্ছা, পরে আবার কথা হবে, ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহর শোকর, অল্প সময়ে অনেক কিছু শেখা হলো।

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা