জুমাদাল উলা ১৪৩২ হিঃ (২০)

তোমাদের চিঠি / আমাদের পত্র

একটি চিঠি (এবং সম্পাদকের উত্তর)

লিখেছেনঃ বশীরুদ্দীন মুহম্মদ শাহ / ঢালকানগর, ঢাকা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

০ হামদ ও ছালাতের পর, কিছু তিক্ত কথা বলতে আজ কলম ধরেছি। .... তবে আমার কলম ধরা ধৃষ্টতা প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং ভালোবাসার দাবীতে।

প্রথমেই বলতে হয় বানানভুলের কথা, যদিও তা প্রিন্টিং মিস্টেক, কিন্তু চালকের সামান্য বে-খেয়ালি ডেকে আনতে পারে অসংখ্য যাত্রীর অপূরণীয় ক্ষতি, তেমনি পুষ্পের সামান্য মুদ্রণপ্রমাদও হতে পারে তার মুগ্ধ অনুসারিদের ভ্রান্তি ও ভোগান্তির কারণ। দু’টি তাজা উদাহরণ দেখুন। গত সংখ্যার সম্পাদকীয়-এর দ্বিতীয় লাইনে আছে ‘মাহন ভারতের...’ এটি যে মুদ্রণভুল তা আমার এক সহপাঠীকে দিয়ে কবুল করাতে পারিনি।

হযরত মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের ‘তিনি নেই ...’ লেখাটিতে ‘প্রোজ্জ্বল’ শব্দটি দু’বার ছাপা হয়েছে ল-বিহীন ‘প্রোজ্জ্ব’। একজন পুষ্পভক্ত অবিচল কণ্ঠে বললেন, দু’টোই ঠিক আছে। পুষ্পের উপর আবার কিসের দলীল!

এ সংখ্যায় আশির উপরে মুদ্রণভুল। বলা যায়, স্মরণকালের সবচে’ ভয়াবহ বানানবিপর্যয়। জানি, পুরো কাজটা একার হাতে করতে হয়। এও জানি, তাতে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়। কিন্তু পুষ্পই যাদের কাছে অকাট্য দলীল তাদের জন্য তো...

০০ আমার অজুহাত তো তুমি নিজেই বলছো; আমি অবশ্য কোন অজুহাত খাড়া করতে চাই না। ভুল ভুলই, যে কারণেই হোক এবং সীমাবদ্ধতা সীমাবদ্ধতাই, যে অজুহাতেই হোক।

পুষ্প তো সকল পাঠককে লোগাত দেখার পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছে, তবু যদি কেউ এমন অভিধানবিমুখ হয় তাহলে সত্যি তা দুঃখজনক।

আমি সাধ্যমত চেষ্টা করছি বিভিন্ন দুর্বলতা থেকে পুষ্পকে উপরে তুলে আনতে, আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন।

তোমার লেখা অনেকের অনেক লেখার চেয়ে ভালো। তবে তাতে ‘ঝাঁঝ’ ছিলো অনেক বেশী, যা সম্পাদনার মাধ্যমে অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। সার্থক সমালোচনা হলো যাতে ‘ধার কম, ভার বেশী’, এমনকি যার সমালোচনা করছো সে প্রতিপক্ষ হলেও। সৌজন্য ও সংযম হলো লেখার অলঙ্কার। পুষ্পের উদ্যানে আমাদের সমাবেশ তো শেখার জন্য, তাই কথাটা বলা।

০ ‘নারীস্বাধীনতা’ এখন একটি মুখরোচক শেস্নাগান, কিন্তু বড় কষ্ট হয় যখন দেখি পুষ্পের পাতায়ও এ ব্যাধির বিস্তার। হাফীদা শামস তার রোযনামচায় লিখেছেন, ‘মানুষের সমাজে পুরুষ ও নারী একরকম হয় না কেন? স্বাধীনতা যদি হয় একটি পাখী তাহলে তার একটি ডানা ভাঙ্গা কেন? কেউ যদি বলে, এটা স্রষ্টার বিধান তাহলে আমি বলবো...। থাক, নাই বা বললাম, যা বলতে চাই!’

তিনি কী বলতে চান?

০০ যা তিনি বলেননি সেটাই বলতে চান। আর তা এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সমান করেছেন, আমরা ‘অসমান’ করছি, যার কুফল হচ্ছে আজকের তথাকথিত নারী-স্বাধীনতা। এখনো যদি হুঁশ না হয় তাহলে...।

যুগ যুগ ধরে, ইসলামের সোনালী যুগের পর থেকে পাখীর একটি ডানা যে আমরা ভেঙ্গে রেখেছি তা অস্বীকার করি কীভাবে? পাখীর ‘ভাঙ্গা ডানা’টিকে কেন আমরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখেছি? আমাদের দেশে (বিশেষ করে ইলমি মহলে) একটি ছেলের শিক্ষার পিছনে যত অর্থ, চিন্তা ও শ্রম ব্যয় করা হয়, একটি মেয়ের  শিক্ষার জন্য তার অর্ধেকও কি ব্যয় করা হয়?

একটি দুঃখজনক সত্য এই যে, বর্তমানে আলিমসমাজের একটা নারীবিরোধী ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে। এটাই শত্রুদের কৌশল। পুষ্পের মাধ্যমে শত্রুদের এ অপকৌশল আমরা ভেঙ্গে দিতে চাই। আমরা নারী-অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই, যে অধিকার ইসলাম তাদের দিয়েছে, কিন্তু শ্রেণীনির্বিশেষে গোটা মুসলিম সমাজ সে অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে, চিন্তার ক্ষেত্রে, চরিত্র ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে এবং আরো অনেক ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কে সমান অধিকার ও সমান স্বাধীনতা দিয়েছে। এমনকি পর্দার ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ উভয়ের উপর রয়েছে সমান বিধান। কিন্তু আমাদের আচরণ বলে, পর্দা শুধু নারীর জন্য। নারীর কর্মক্ষেত্র গৃহাঙ্গন, আর পুরুষের কর্মক্ষেত্র বহিরাঙ্গন, কিন্তু অধিকার ও স্বাধীনতা উভয়ের সমান।

বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর রয়েছে ‘অনুমতি’র স্বাধীনতা। তুমি নিশ্চয় জানো, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একছাহাবী তাঁর মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভাতিজার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন, পারিবারিক সুবিধা চিন্তা করে। অসহায় মেয়েটি কী করেছিলো? অভিযোগ করেছিলো আল্লাহর নবীর কাছে। এ যুগের মেয়ে যদি এমন করতো তাহলে? কিন্তু আল্লাহর নবী মেয়েটিকে তিরস্কার করেননি, বরং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তোমার বাবার এ অধিকার নেই। এ বিয়ে তুমি ভেঙ্গে দিতে পারো।

এর পর মেয়েটি যা বলেছিলো এবং যা করেছিলো তা শুধু মেয়েরাই পারে, ছেলেরা পারে না। মা হয়ে, বোন হয়ে, স্ত্রী হয়ে এবং মেয়ে হয়ে, মেয়েরা শুধু ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের জন্য। বাবার এমন অবিচার, এত বড় অধিকার পেয়েও, মেনে নিয়ে মেয়েটি বলেছিলো, ‘আমার বাবাকে আমি লজ্জিত করতে চাই না। আমি শুধু চাই, সবাই জানুক মেয়েদের অধিকার কী?’

ঠিক জানি না, হয়ত আজকের হাফীদা শামস এবং নিকট অতীতের বেগম রোকেয়া, উভয়ের বক্তব্য অভিন্ন ছিলো, নিজ নিজ সময়ের ভাষায়, কিন্তু সে যুগে আমরা রোকেয়ার পাশে দাঁড়াইনি, তাকে ঠেলে দিয়েছি সুযোগ-সন্ধানীদের দিকে। যদি ভাষাপ্রয়োগ ভুল না হয় তাহলে বলবো, তুলনারূপে নয়, উপমারূপে, হয়ত ঐ মেয়ে-ছাহাবীও ছিলেন তাঁর যুগের..., যিনি আল্লাহর নবীর অনুকূল্য লাভ করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য পরবর্তী যুগের রোকেয়াদের; তারা তাদের যুগের ধর্মপুরুষদের আনুকূল্য পায়নি। ফলে সুযোগসন্ধানী ধর্মবিদ্বেষীরা তাদের বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে মহাফিতনা সৃষ্টি করেছে।

০ পুষ্পের পাতায়ও দেখি ‘নারী-আধিপত্য’। গত সংখ্যায় আঠারো জন নারীর লেখা এসেছে। কচি ও কাঁচা বিভাগ পুরোটাই তাদের দখলে ....

০০ ছি, এমন করে বলতে নেই। প্রকৃত অবস্থা হলো, কচি ও কাঁচা বিভাগে ছেলেদের লেখা বলতে গেলে আসেই নি। তাছাড়া সত্যের অনুরোধে স্বীকার করতে হবে, ওরা লিখছে ভালো।

০ হযরত মাওলানা আব্দুল মালিক ছাহেবের ‘অন্যরকম শব্দদূষণ’ লেখাটি খুবই সুন্দর হয়েছে। আশা করি এমন লেখা তাঁর কলম থেকে আরো আসবে।

০০ যিনি সুন্দর তার লেখা সুন্দরই হয়। আমরা নিজেরা সুন্দর হতে চাই না, শুধু চাই, লেখাটি যেন সুন্দর হয়।

০ বোন সাফফানার লেখাটি তুলনাহীন। হৃদয়ের সামান্য কিছু অনুভূতির, সাধারণ কিছু অভিব্যক্তির কী অসামান্য, অসাধারণ প্রকাশ!

০০ তুমি যার লেখার কথা বলছো, সে পুষ্প ও তার সম্পাদকের লেখা ছাড়া আর কোন ‘সাহিত্য’ এখনো পড়েনি, হাফীদা শামসও তাই।

পক্ষান্তরে আমার ছেলে-ছাত্ররা সর্বপ্রকার সাহিত্যই তো পড়ে, পার্থক্যটা তাহলে কোথায়?

০ অসম্ভব ভালো লেগেছে; তবে .. তবে হাঁ, যদি বুঝতাম, ‘তাঁর’ সারাদিনের কঠিন দৌড়ঝাঁপ ও কঠোর পরিশ্রম ইলমের জন্য হয়!

০০ সমালোচনার সময় আমাকে জানতে হবে, আমার সীমা কতটুকু! এখন থেকে এই প্রশিক্ষণটুকু গ্রহণ না করলে কলমের যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

যদি হয় শুধু জীবিকার দৌড়ঝাঁপও আল্লাহর নবীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে ‘কাসবুল হালালি ফারীযাতুন’ বলে, আর যদি ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা শুধু প্রশংসাযোগ্যই নয়, অভিনন্দনযোগ্যও।

জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে মেধাবী, পরিশ্রমী, যোগ্য ও প্রতিভাবান আলিমের এগিয়ে যাওয়া উচিত; তবে দু’টি শর্তে। বিজ্ঞ মুরুবিবর পূর্ণ তত্ত্বাবধানে ও পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু আমাদের সমস্যা এই যে, এত তারবিয়াতের পরো আমরা প্রতিকূল পরিবেশে সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যাই ।

০ ‘তালে তালে’ অনেক কথা বলে ফেললাম, তবে বিরক্তির আশঙ্কায় অনেক কিছুই চেপে গেলাম।

০০ আচ্ছা, আরো কিছু বলার ছিলো!

কোট করা শব্দটি এখানে শোভন নয়, তুমি বলতে পারো, ‘কথায় কথায়/ কথার স্রোতে/ বলতে বলতে অনেক কথা বলে ফেললাম।’

০ নিকট অতীতে পুষ্পের পাতায় এমন অপ্রিয় লেখা চোখে না পড়ায় শঙ্কা ও আশঙ্কার মধ্যে লিখলাম। অনেকে বলে পুষ্পের লাগামহীন প্রশংসা ছাড়া কোন লেখা ছাপা হয় না।

০০ এখানে তোমার কলম সংযম থেকে খুব বেশী বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। আমি যথেষ্ট পরিমার্জনের পর প্রকাশ করলাম। তারুণ্যের অতিউচ্ছ্বাসে এমন হয়, হতে পারে, তবে কলমের সকল সেবককে এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

০ আমি অবশ্য তা বিশ্বাস করি না।

০০ ধন্যবাদ। 

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা